বাংলাদেশে টেকসই কৃষি উৎপাদন ও মাটির স্বাস্থ্য রক্ষার জন্য জৈব কৃষির গুরুত্ব অপরিসীম। কেচো কম্পোষ্ট একটি গুরুত্বপূর্ণ জৈব সার যা মাটির উর্বরতা বৃদ্ধি ও পরিবেশ সংরক্ষণে সহায়তা করে। কৃষকদের মাঝে এই প্রযুক্তি ছড়িয়ে দিতে বারসিক (বাংলাদেশ রিসোর্স সেন্টার ফর ইন্ডিজেনাস নলেজ) এর উদ্যোগে ভেলুয়াতলী কৃষি প্রতিবেশ বিদ্যা শিখন কেন্দ্রে কেচো কম্পোষ্ট উৎপাদন ও ব্যবহার বিষয়ক এক অভিজ্ঞতা বিনিময় সফরের আয়োজন করা হয়। এতে অংশগ্রহন করেন ৭টি গ্রামের মোট ২০ জন আগ্রহী কৃষক কৃষানী।
অভিজ্ঞতা বিনিময় সফরের উদ্দেশ্য হলো- কেচো কম্পোষ্ট তৈরির ধাপ, ব্যবহৃত উপকরণ ও সঠিক ব্যবস্থাপনা পদ্ধতি হাতে-কলমে শিখানো, সফল কৃষক ও উদ্যোক্তাদের অভিজ্ঞতা থেকে বাস্তব জ্ঞান অর্জন করা এবং তাঁদের মুখোমুখি হয়ে বিভিন্ন সমস্যা ও সমাধান জানা, রাসায়নিক সারের ব্যবহার কমিয়ে মাটির স্বাস্থ্য ও পরিবেশ রক্ষার উপযোগী জৈব কৃষি পদ্ধতি ছড়িয়ে দেয়া, কৃষকদের নিজেদের উদ্যোগে কেচো কম্পোষ্ট উৎপাদন ও ব্যবহারে উৎসাহিত করা এবং তাদের দক্ষতা বৃদ্ধি করা, কেচো কম্পোষ্ট উৎপাদনকে আয়বর্ধক কার্যক্রম হিসেবে গড়ে তোলা এবং নতুন উদ্যোক্তা তৈরি করা প্রভৃতি।
সফরের শুরুতে বারসিক এর মাঠ সহায়িকা মুন্না রংদী এর নেতৃত্বে অংশগ্রহনকারীগণ কৃষি প্রতিবেশ বিদ্যা শিখন কেন্দ্রে উৎপাদিত কেচো কম্পোষ্টের হাউজ পরিদর্শন করেন। পরিদর্শন শেষে আল্পনা নাফাক এর সঞ্চালনায় ও কামনা হাজং এর সভাপতিত্বে একটি আলোচনা সভা অনুষ্ঠিত হয়। অভিজ্ঞতা বিনিময় সফরের লক্ষ্য উদ্দেশ্য তুলে ধরেন বারসিক এর উপজেলা সমন্বয়কারী গুঞ্জন রেমা। এসময় তিনি কেচো কম্পোষ্ট উৎপাদনের কিছু দিক তুলে ধরেন যেমন- কেচো কম্পোষ্ট তৈরির উপযুক্ত পরিবেশ ও শর্তাবলী (ছায়াযুক্ত স্থান, তাপমাত্রা নিয়ন্ত্রণ)। কেঁচোর বেড তৈরির পদ্ধতি ও ব্যবহৃত উপকরণ (গোবর, খড়কুটো, কলা গাছের খোল ও রান্নাঘরের জৈব বর্জ্য)। কেচো কম্পোষ্ট সংগ্রহ ও সংরক্ষণের পদ্ধতি। কেচো কম্পোষ্ট ব্যবহারের ফলে মাটির গুণগত পরিবর্তন ও ফসলের উৎপাদন বৃদ্ধি প্রভৃতি।
তারপর একজন সফল কৃষক আব্দুল মোতালেব তার অভিজ্ঞতা সহভাগিতা করেন, যেখানে তিনি কেচো কম্পোষ্ট ব্যবহারের মাধ্যমে কীভাবে তার জমির উর্বরতা বাড়িয়েছেন এবং রাসায়নিক সারের ব্যবহার কমিয়ে লাভবান হয়েছেন। ব্যবহারের পাশাপাশি কি পরিমাণে কম্পোষ্ট সার বিক্রি করে লাভবান হয়েছে প্রভৃতি বিষয় নিয়ে আলোচনা করেন। অংশগ্রহণকারীরা সরাসরি আব্দুল মোতালেব এর সহযোগিতায় কম্পোষ্ট তৈরির নানা ধাপ, যেমন কিভাবে এটি হাউজের বসাতে হয়, কি কি উপকরণ ব্যবহার করেন, কোন উপকরণ কি পরিমাণ দিতে হয়, সার হয়ে গেলে কিভাবে বুঝা যাবে, হাউজ থেকে কিভাবে সার ও কেচো আলাদা করে সার সংগ্রহ করতে হয় সব কিছু পর্যায় আলোচনা করেন।
অভিজ্ঞতা বিনিসয় সফরে অংশগ্রহনকারীদের মধ্যে পরিমল রেমা বলেন- "আগে আমরা রাসায়নিক সার ছাড়া ভালো ফসল কল্পনাই করতাম না। আজ বুঝলাম, কেচো কম্পোষ্ট ব্যবহারে মাটি ভালো থাকে ও নিরাপদ খাদ্য উৎপাদন করা সম্ভব। সুশীলা সরকার বলেন, "আমি আগে শুধু শুনেছি কেচো কম্পোষ্টের কথা। আজ হাতে-কলমে দেখে বুঝলাম এটি কত সহজে তৈরি করা যায় এবং জমিতে ব্যবহার করে কীভাবে ফলন বাড়ানো সম্ভব। এখন আমি নিজেও শুরু করতে আগ্রহী।" কামনা হাজং বলেন, "আগে কেচো নিয়ে ভয় লাগত! এখন বুঝেছি, এরা মাটির বন্ধু। আমি এখন কেচো লালন-পালন করে কম্পোষ্ট উৎপাদন করবো, যা আমার সবজির জমিতে খুবই কার্যকর হবে।"
বারসিকের উদ্যোগে ভেলুয়াতলী কৃষি প্রতিবেশ বিদ্যা শিখন কেন্দ্রে অনুষ্ঠিত কেচো কম্পোষ্ট তৈরী ও ব্যবহার বিষয়ক অভিজ্ঞতা বিনিময় সফরটি ছিল অত্যন্ত ফলপ্রসূ। অংশগ্রহণকারীরা কৃষি পদ্ধতির পরিবেশবান্ধব উন্নয়নের বাস্তব প্রয়োগ শিখে অনুপ্রাণিত হয়েছেন। ভবিষ্যতে এ ধরণের আরো কার্যক্রম আয়োজনের মধ্য দিয়ে স্থানীয় কৃষি উন্নয়নকে আরো টেকসই ও জনবান্ধব করা সম্ভব হবে।