চাঁপাইনবাবগঞ্জের চরাঞ্চলে খুন-মাদকের রাজত্ব: নেতৃত্বে গডফাদার’ শাহীদ রানা টিপু
প্রকাশ | ২৪ এপ্রিল ২০২৫, ১৪:৪৯

চাঁপাইনবাবগঞ্জ সদর উপজেলা ১২নং চরবাগডাঙ্গা ইউনিয়ন একসময় ছিলো শান্তিপ্রিয় মানুষের আবাসস্থল। কিন্তু বর্তমানে চারপাশ জুড়ে অস্ত্র, মাদক, খুন আর ভয়ের নিঃশব্দ রাজত্ব। এই ভয়াল বাস্তবতার নেপথ্য নায়ক- মোঃ শাহীদ রানা টিপু। স্থানীয়দের কাছে যিনি ‘মাদকের গডফাদার’ নামে পরিচিত। এই ব্যক্তি এখন শুধু মাদকের সম্রাট নন, বরং পুরো চাঁপাইনবাবগঞ্জ চরাঞ্চলের একচ্ছত্র ক্ষমতাধর শাসক।
মাদকের ফাঁদে যুবসমাজ যখন একে একে নিঃশেষ হচ্ছে, তখন টিপুর সাম্রাজ্য আরও বিস্তৃত হচ্ছে। তার বিরুদ্ধে রয়েছে ১০টিরও বেশি হত্যা, বিস্ফোরক ও মাদক মামলা-যার মধ্যে রয়েছে পিন্টু, জিয়া, জেম ও আইয়ুব হত্যাকাণ্ড। তবুও তার গায়ে একটি আঁচড়ও লাগেনি। চাঁপাইনবাবগঞ্জ জেলা প্রশাসন ও আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর কাছে তার বিস্তারিত ঠিকানা, মামলার তথ্য, এমনকি সীমান্ত হয়ে ভারত থেকে মাদক আসার ট্রেইল পর্যন্ত জানা। তবুও তিনি বরাবরের মতো অধরাই থেকে যাচ্ছেন।
তার পারিবারিক শিকড়ও আওয়ামী লীগ রাজনীতির কেন্দ্রস্থলে।
বাবা আবু বকর (ঝাটু) দুইবার চরবাগডাঙ্গা ইউনিয়ন আওয়ামী লীগের সভাপতি ছিলেন, আর ভাই এখন ইউনিয়ন আওয়ামী লীগের সভাপতির দায়িত্বে। এই পারিবারিক প্রভাব ও দলীয় সুরক্ষা সবসময় তাকে দিয়েছে ‘অভেদ্য ঢাল’। তথ্য মতে, টিপুর অপরাধ জগতের পৃষ্ঠপোষকতায় ছিলেন ফ্যাসিস্ট আওয়ামী লীগের সাবেক স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খাঁন কামাল, রাজশাহীর সাবেক মেয়র ও দলটির প্রেসিডিয়াম সদস্য খায়রুজ্জামান লিটন, এবং চাঁপাইনবাবগঞ্জ-০৩ আসনের সাবেক সংসদ সদস্য আব্দুল ওদুদ বিশ্বাস। এই কেন্দ্রীয় রাজনৈতিক সম্পর্কই তাকে স্থানীয় রাজনীতি ও অপরাধ সাম্রাজ্যে অপরাজেয় করে তোলে।
শুধু তাই নয়, তৎকালীন র্যাব ও পুলিশের ডিআইজি পর্যায়ের একাধিক উচ্চপদস্থ কর্মকর্তার সঙ্গে তার সখ্যতা, তার জন্য খুলে দেয় ‘আইনের ঊর্ধ্বে’ অবস্থানের দরজা।
শুধু রাজনৈতিক সুরক্ষা নয়, টিপু বরাবরই চতুরভাবে খেলে চলেছেন দ্বৈত রাজনৈতিক খেলা। ক্ষমতাসীনদের সঙ্গে যেমন ঘনিষ্ঠতা ছিল, তেমনি ছাত্র-জনতার গণ-অভ্যুত্থানের মাধ্যমে সরকার পরিবর্তনের পর ভোল্ট পাল্টিয়ে দ্রুত সখ্যতা গড়ে তুলেছেন জামাত-বিএনপির একটি অংশ ও প্রশাসনের সুবিধাভোগী গোষ্ঠীর সঙ্গে। এই দ্বিমুখী সম্পর্কের কারণেই টিপু হয়ে উঠেছেন ‘অপরাধের অদৃশ্য বর্মধারী’।
স্থানীয়দের অভিযোগ, “বর্তমান অন্তবর্তীকালীন সরকারের সময়ে যখন আওয়ামী স্বৈরাচারের দোসররা পালিয়ে বেড়াচ্ছে, তখন টিপু কীভাবে প্রকাশ্যে ঘুরে বেড়ায়? কীভাবে সে আবারও জামাত-বিএনপি ও প্রশাসনের একাংশের সঙ্গে সখ্যতা গড়ে তোলে? কাদের ছত্রছায়ায় আজও তার অপরাধ সাম্রাজ্য সম্প্রসারিত হচ্ছে?” তারা প্রশ্ন ছুঁড়ে দেন—এই বৈষম্যহীন নতুন সময়ে, যেখানে ন্যায়বিচারের আশায় মানুষ বুক বাঁধে, সেখানে টিপুর মতো কুখ্যাত অপরাধী কি আবারও ধরা-ছোঁয়ার বাইরে থাকবে?
পিন্টু হত্যা মামলার বাদী ও নিহতের পিতা মো. হুমায়ুন বলেন, “আমার ছেলেকে নির্মমভাবে হত্যা করা হয়েছে তিন মাস আগে। অথচ এখনো পর্যন্ত মূল হোতা শাহীদ রানা টিপু, মোবারক, মিজান ও সাহারুল ওরফে কালু— এদের একজনকেও গ্রেপ্তার করা হয়নি। আমি স্বরাষ্ট্র উপদেষ্টা, মহাপুলিশ পরিদর্শক (আইজিপি), চাঁপাইনবাবগঞ্জের পুলিশ সুপারসহ সংশ্লিষ্ট সব কর্তৃপক্ষের কাছে অনুরোধ করছি—দয়া করে তাদের দ্রুত গ্রেপ্তার করুন।
আমরা বিচার চাই। আমরা ন্যায়বিচার চাই। প্রতিনিয়ত ভয় আর আতঙ্কে দিন কাটছে। আর কতদিন এই ভয়ংকর অপরাধীরা আমাদের মতো সাধারণ মানুষকে তাড়িয়ে বেড়াবে? আর কত অন্যায় সহ্য করব আমরা? ন্যায়ের আশায় আছি, কিন্তু সহ্যের সীমা ছাড়িয়ে যাচ্ছে। এখনই ব্যবস্থা না নিলে হয়তো আমাদের কণ্ঠও চিরতরে স্তব্ধ হয়ে যাবে।”
নাম প্রকাশ না করার শর্তে চাঁপাইনবাবগঞ্জ জেলা পুলিশের এক কর্মকর্তা বলেন, “টিপুর বিরুদ্ধে কোনো ফাইল খুললেই উপরের মহল থেকে ফোন আসে”—এই একটিমাত্র কারণেই তিনি বছরের পর বছর ধরে ধরাছোঁয়ার বাইরে রয়েছে।
হেরোইন, ফেনসিডিল, গাঁজা, মদসহ নানা মাদকের অবাধ ব্যবসা করে কোটি কোটি টাকার সম্পদ গড়ে তুলেছেন মোঃ শাহীদ রানা টিপু। এই টাকার পাহাড়ই হয়ে উঠেছে তার রক্ষাকবচ। প্রশাসনের থাবা থেকে নিজেকে নিরাপদ রাখতে আওয়ামী লীগের রাজনীতিতে সক্রিয় হয়েছিলেন তিনি। তবে আওয়ামী সরকারের পতনের পর চাঁপাইনবাবগঞ্জ জেলা জামাত-বিএনপির কিছু অসাধু ব্যক্তি শাহীদ রানা টিপুকে আশ্রয় দিচ্ছে এবং তার অপরাধ সাম্রাজ্য বিস্তৃত করতে সহযোগিতা করছে। এসব নেতাকর্মীরা সমাজের অস্থিরতা বাড়ানোর পাশাপাশি, প্রশাসনের যারা টিপুর বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতে চাচ্ছেন, তাদেরকেও বাধার মুখে ফেলছে। অভিযোগ উঠেছে যে, এই নেতাকর্মীরা টিপুর করা মিথ্যা মামলা নিতে থানায় চাপ প্রয়োগ করেছে।
মাদক বাণিজ্যের পাশাপাশি টিপু জড়িয়ে পড়েন খুন, বোমাবাজি, ভূমিদস্যুতা ও রাজনৈতিক সন্ত্রাসের মতো ভয়াবহ অপরাধে—যার ফলে তার বিরুদ্ধে একের পর এক মামলা হলেও, বাস্তবে একটিও মামলা ফলপ্রসূ হয়নি। কারণ, এসব মামলার অন্তরালে সক্রিয় রয়েছে এক প্রভাবশালী ‘রক্ষা সিন্ডিকেট’।
অপরদিকে, সম্প্রতি পিন্টু হত্যাকাণ্ড যেন চরাঞ্চলের রাজনীতির কালো অধ্যায়ের জ্বলন্ত উদাহরণ। মৃত্যুর আগে পিন্টু স্পষ্ট করে ভিডিও বার্তায় খুনীদের নাম বলে গেছেন। অথচ সেই মামলায় এখনো তিনি ও তার সিন্ডিকেটের সদস্যরা গ্রেফতার হননি। বরং নিহত পিন্টুর পরিবার ও প্রতিবাদকারীদের বিরুদ্ধে দায়ের করা হয়েছে দুটি মিথ্যা মামলা। অভিযোগ উঠেছে, ২টি মিথ্যা মামলার বাদী আসামিদের ঠিক মতো চিনেনই না।
সম্প্রতি বাদীর একটি কল রেকর্ড ফাঁস হয়েছে, যেখানে মিথ্যা মামলার কথা বাদী স্বীকার করেছেন, এবং এর পেছনে যে টিপু ও তার সিন্ডিকেট রয়েছেন সেটিও তিনি স্পষ্ট করেছেন।
চাঁপাইনবাবগঞ্জ সদর মডেল থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) মো. মতিউর রহমান বলেন, “শাহীদ রানা টিপুসহ অন্যান্য আসামিদের গ্রেপ্তারে আমরা নিয়মিত অভিযান পরিচালনা করছি। প্রক্রিয়া অনুযায়ী তদন্ত চলছে, এবং আমরা সর্বোচ্চ চেষ্টা করছি যাতে অপরাধীরা আইনের আওতায় আসে। আশা করি, খুব শিগগিরই দৃশ্যমান অগ্রগতি দেখা যাবে।
অনুসন্ধান রিপোর্ট উঠে এসেছে, চাঁপাইনবাবগঞ্জের চরাঞ্চলের সীমান্ত দিয়ে নিয়মিত প্রবেশ করে হেরোইন ও ইয়াবার বড় বড় চালান। এই রুটের প্রধান নিয়ন্ত্রক হিসেবে রয়েছে তিনজন—শাহীদ রানা টিপু, মুবারক হোসেন গুধা এবং মিজানুর রহমান মিজান। এসবের নেতৃত্বে রয়েছে শাহীদ রানা টিপু। এদের মাধ্যমে মাদক পৌঁছে যাচ্ছে ঢাকা, রাজশাহী, চট্টগ্রাম, এমনকি রাজধানীর অভিজাত আবাসিক এলাকাগুলোতেও। তারা নামে-বেনামে গড়ে তুলেছেন বিলাসবহুল ফ্ল্যাট, জমি, গাড়ি—অর্থপাচারের অভিযোগেরও প্রমাণ মিলেছে গোয়েন্দা প্রতিবেদনে।
চাঁপাইনবাবগঞ্জ জেলা পুলিশ বলছে, “আমরা জিরো টলারেন্স নীতিতে কাজ করছি।” কিন্তু বাস্তবতা হলো, পুলিশ জানে, জনগণ জানে, এমনকি সরকারও জানে—তবুও শাহীদ রানা টিপু অধরা থেকে যাচ্ছেন?
এই সিন্ডিকেট ভাঙা এখন শুধু একটি জেলার প্রশ্ন নয়—এটা এখন একটি রাষ্ট্রের নৈতিকতার প্রশ্ন। যদি একটি গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রে খুনের আসামি, মাদকের গডফাদার, রাজনৈতিক সহিংসতার মূল কুশীলব প্রশাসনের প্রশ্রয়ে পার পেয়ে যায়, তবে এ দেশের ভবিষ্যৎ কোন পথে এগোবে?
জনগণের প্রশ্ন স্পষ্ট—আর কতদিন এই অন্ধকারের মধ্যে থাকবে
চাঁপাইনবাবগঞ্জের এই চরাঞ্চলের মানুষ? আর কত রক্ত ঝরলে থামবে টিপুর অপরাধ সাম্রাজ্য?
এখনই সময়—মোঃ শাহীদ রানা টিপুর গ্রেপ্তার ও তার সিন্ডিকেট ধ্বংসের দাবিতে গড়ে তোলা হোক সর্বজনীন প্রতিরোধ। নতুবা একদিন শুধু চরবাগডাঙ্গা নয়, সমগ্র বাংলাদেশই পরিণত হবে মাদকের ভয়ঙ্কর ‘নয়ারাষ্ট্রে’।