ফেনীর ৭০ ভাগ নলকূপে মিলছে না পানি, পানির জন্য হাহাকার

প্রকাশ | ১৯ এপ্রিল ২০২৫, ১৩:৪২

আজাদ মালদার, ফেনী থেকে
ছবি: যায়যায়দিন

প্রচণ্ড দাবদাহ আর অনাবৃষ্টির কারণে পানিশূন্য হয়ে পড়ছে ফেনী জেলা। জেলার ৬ উপজেলার নলকূপ, পুকুর-খাল,বিলসহ কোথাও নেই পর্যাপ্ত পানি। প্রচণ্ড খরতাপে চারিদিকে যেন ধুধু মরভূমি। ফলে চরম দুর্ভোগে রয়েছেন স্থানীয়রা। টানা কয়েক মাস অনাবৃষ্টির কারণে জেলার ৭০ভাগ গভীর ও অগভীর নলকূপে পানি ওঠছেনা বলে জানান জনস্বাস্থ্য বিভাগ।

জেলা জনস্বাস্থ্য প্রকৌশল অধিদপ্তরের তথ্যমতে, ফেনী জেলায় সরকারি নলকূপের সংখ্যা ৩৬ হাজার ৮১১টি। এর মধ্যে ৯ হাজার ৮৭১টি দীর্ঘদিন ধরে অকেজো। চালু থাকা ২৬ হাজার ৯৪১টি নলকূপের তিন ভাগের দুইভাগ টিউবওয়েলের পানি উঠছে না। পাশাপাশি ব্যক্তি উদ্যোগে স্থাপিত প্রায় দুই লক্ষাধিক অগভীর নলকূপেরও পানি ওঠেনা। এছাড়া সোনাগাজী ও দাগনভূঞা উপজেলা নদীমাতৃক হওয়ায় এসব এলাকার অধিকাংশ টিউবয়েলে লবণাক্ত পানি ওঠছে বলে জানা গেছে।

ফুলগাজী উপজেলার জি এম হাট ইউনিয়নের শরীফপুর গ্রামের কাজী বাড়ীতে  ১৭ এপ্রিল সরেজমিনে গিয়ে দেখা যায়, বাড়ীতে বসবাস করেন ১১টি পরিবার। তাদের ১১পরিবরের মধ্যে ব্যক্তি উদ্যোগে সবানো পাঁচটি টিউবওয়েলের রয়েছে। এসব টিউবওয়েলের একটিতেও মিলছেনা সুপেয় পানি। তাই বাড়ীর নারী-পুরুষ সকলের খাবার পানি ও রান্নাবান্নার পানি সংগ্রহে চরম ভোগান্তি পোহাতে হয়। তারা পাশের খাল থেকে পানি সংগ্রহ করে সেগুলো রান্না-বান্না সহ বিভিন্ন কাজে ব্যবহার করেন।

স্থানীয়দের সাথে কথা বলে জানা যায়, শুধু এই বাড়ী নয় আশপাশের অধিকাংশ বাড়ির নলকূপে মিলছেনা সুপেয় পানি। যার ফলে সুপেয় পানি, রান্না-বান্না ও দৈনন্দিন কাজে ব্যবহারের পানি নিয়ে চরম ভোগান্তি পোহাতে হচ্ছে স্থানীয়দের।খাবার পানি ও রান্নাবান্নার পানি দূর-দূরান্তে থেকো আনতে দেখা যায়।

জি এম হাট ইউনিয়নের শরীফপুর গ্রামের কাজী বাড়ীর আবদুল কাদের এর সাথে কথা বলে তিনি বলেন, গৃষ্মকাল আসলে বাড়ির অধিকাংশ টিউবলের পানি উঠে না। সকল কাজের জন্য পানির প্রয়োজন হয়। এতে দূর-দূরান্ত থেকে পানি আনতে হয়। ফলে চরম ভোগান্তি পোহাতে হয় আমাদের।

একই বাড়ীর ৭০ ঊর্ধ্বে নারী হাজেরা খাতুন। তিনি বলেন, গত চার-পাঁচ বছর এ সময় আমরা পানির জন্য কষ্ট করি। নামাজ পড়ার জন্য অজু যে পানি সেটি অন্যস্থান থেকে আসতে হয়। কল (টিউবওয়েলের) গুলো নষ্ট পানি উঠে না।  আধা কিলোমিটার কষ্ট করে হেঁটে খালে গিয়ে অজু, গোসলের পানি আনতে হয়।

একই ইউনিয়নের বসিকপুরের বাসিন্দা আনিস আহমেদ জানান, এই জিএমহাট ইউনিয়নের শরিফপুর, শ্রীপুর গ্রামের ৩৫টি গভীর নলকূপের একটিতেও মিলছেনা সুপেয় পানি। তাই খাবার পানি ও রান্নাবান্নার পানি সংগ্রহে চরম ভোগান্তি পোহাতে হয় তাদের। দূর দূরান্তের জলাশয় থেকে পানি সংগ্রহ করে সেগুলো রান্না-বান্না সহ বিভিন্ন কাজে ব্যবহার করেন তারা।

ফেনী সদর উপজেলার লেমুয়া ইউনিয়নের লেমুয়া বাজারের ব্যবসায়ি নেতা মোস্তফা হোসেন, বাজানে ৩টি চাপাকল ও ১০/১২টি পানি তোলার মোটর রয়েছে।এসব চাপাকল ও পানির মোটর থেকে পানি ওঠে না। এছাড়া আশেপাশে অনেক টিউবওয়েলেও পানি উঠে না।

ছাগলনাইয়া উপজেলার পাঠানগড় ইউনিয়নের পাঠান নগর এলাকান খোকন চন্দ্র পাটোয়ারী বলেন, ইউনিয়ন পরিষদের ভীতরের গভীর নলকূপটি তিন বছর যাবৎ নষ্ট পানি ওঠে না। পানির স্তর নীচে নেমে যাওয়ায় এ সঙ্কট দেখা দিয়েছে। সরকার যদি বিকল্প ব্যবস্থা করে সমস্যার সমাধান করে তবে জনগন উপকৃত হবে।

টিউবওয়েলের পানি সংকটে তথ্য পাওয়া গেছে পরশুরাম, ছাগলনাইয়া সহ সদর উপজেলায় বিভিন্ন বাড়ীগুলোতে। ফলে পানি যোগাড়ে দূর দূরান্তে ছুটছেন ভুক্তভোগীরা। এতে অনেকে পুকুর অথবা ডোবার অস্বাস্থ্যকর পানি পান করে ডায়রিয়াসহ পড়ছেন স্বাস্থ্য ঝুঁকিতে।

ফেনী সদর উপজেলার কাজিরবাগ ইউনিয়নের রানীর হাট এলাকার কৃষক দিদারুল আলম জানান, আমাদের নিজস্ব জমিগুলোতে এবার স্কিমধানের চাষ করেছি কিন্তু পানির অভাবে ধানের থোর্ড় এখন ভুষি হয়ে যাচ্ছে। পুকুর, জলাশয়ের ও খালের পানি শেষ হওয়ায় সেচ দেয়া সম্ভব হচ্ছে না। বিএডিসি কৃষি জমিতে পানি দেয়ার কথা থাকলেও এখন দিতে পারছে না। তাই আমরা বিপাকে আছি।পুকুর, খাল ও জলাশয় শুকিয়ে যাওয়ায় পানির অভাবে ফসল উৎপাদনে চরম সংকটে রয়েছি।

পরশুরামের কৃষক আবু আহাম্মদ জানান ৫ একর জমিতে ধান করেছেন। কিন্তু পানির না পাওয়ার কারণে সব ধান নষ্ট হয়ে যাচ্ছে। আশপাশের নদী-নালা-খাল-বিল সব শুকিয়ে গেছে। কোথাও পানি নেই।

ফেনী পরিবেশ ক্লাবের সভাপতি নজরুল বিন মাহমুদুল বলেন, অতিরিক্ত তাপমাত্রার কারণে পুকুরের পানি পর্যন্ত শুকিয়ে গেছে। আশপাশের নদী-নালা জলাশয় গুলোতেও পানি কমে গেছে। যার ফলে পানিরস্তর নিচে নেমে গেছে তাই নলকূপে পানি ওঠেনা। এতে করে জনস্বাস্থ্য হুমকির মুখে পড়েছে।

জনস্বাস্থ্য প্রকৌশল অধিদপ্তর ফেনীর নির্বাহী প্রকৌশলী মোঃ শফিউল হক জানান, গত ৫ মাস অনাবৃষ্টির পাশাপাশি গরমের তীব্রতা বাড়ায় ভুগর্ভের স্তর অনেক নিচে নেমে গেছে। ফলে গভীর নলকূপেও পাওয়া যাচ্ছে না প্রয়োজনীয় পানি। জেলার ৬ উপজেলায়  ১৮লাখ বাসিন্দাদের মধ্যে প্রায় ২লাখ নলকূপ রয়েছে। এর মধ্য সরকারিভাবে বসানো হয়েছে ৩৪ হাজার সাধারণ ও গভীর নলকূপ। দুই লাখের মধ্যে ৬০-৭০ ভাগ নলকূপের এমন সমস্যা। এছাড়া জেলার দাগনভুঞা উপজেলার নলকূপের পানিতে লবনাক্তের জন্য পান করা যাচ্ছেনা পানি। এই সঙ্কট কাটিয়ে উঠতে বিকল্প ব্যবস্থা চালুর বিষয়ে মন্ত্রনালয়ে আলোচনা করার কথা জানান তিনি।

যাযাদি/ এসএম