টঙ্গীর সেই “কামু” ডিবি পুলিশের হাতে গ্রেফতার

প্রকাশ | ০২ ডিসেম্বর ২০২৪, ১৮:০৫

টঙ্গী (গাজীপুর)প্রতিনিধি
ছবি: যায়যায়দিন

গাজীপুরের টঙ্গীর আলোচিত সন্ত্রাসী বাহিনীর “কামু” বাহিনীর প্রধান কামরুল ইসলাম কামু (৫৩) কে গ্রেপ্তার করেছে গাজীপুর মহানগর দক্ষিণ গোয়েন্দা পুলিশ (ডিবি)।

সোমবার ভোর চারটার দিকে গাজীপুরের বাঘের বাজার এলাকার সাবাহ গার্ডেন নামক একটি রিসোর্টে অভিযান চালিয়ে তাকে গ্রেপ্তার করা হয়।

গ্রেপ্তারকৃত কামরুল ইসলাম কামু টঙ্গী থানা যুবদলের সাবেক সহ-সাংগঠনিক সম্পাদক। তিনি টঙ্গীর এরশাদ নগর এলাকার ৪ নম্বর ব্লকের তমিজ উদ্দিনের ছেলে।

সোমবার দুপুরে গাজীপুর মহানগর দক্ষিণ গোয়েন্দা পুলিশের পরিদর্শক মো. ফরিদুল ইসলাম এ তথ্য নিশ্চিত করেছেন।

এদিকে,তাকে গ্রেপ্তার এর বিষয়টি প্রকাশ পেলে সোমবার বেলা সাড়ে ১১টার দিকে টঙ্গীর ৪৯ নং ওয়ার্ড এরশাদ নগর এলাকায় তার সহযোগীদের গ্রেপ্তার ও কঠোর বিচারের দাবিতে বিক্ষোভ মিছিল করেছে স্থানীয় বিএনপি ও এলাকাবাসী।

মিছিলটি এরশাদগর বিএনপি কার্যালয়ে থেকে বের হয় ঢাকা-ময়মনসিংহ মহাসড়ক প্রদর্শন করে আবারও বিএনপি'র কার্যালয়ে গিয়ে শেষ হয়। এসময় তারা মিষ্টি বিতরণ করেন।  

উপস্থিত ছিলেন, ৪৯ নং ওয়ার্ড বিএনপি'র সাবেক সাধারণ সম্পাদক মো.নূরুল হক,সাবেক সি:সহ-সভাপতি আলিউল্লাহ, ওয়ার্ড বিএনপির সি:সহ-সভাপতি হেলাল উদ্দিন,সাধারণ সম্পাদক মো.চাঁন মিয়া প্রধান, আবুল কালাম নূর, নাজিউর রহমান সুমন,লিপু মোল্লা,রশিদ আহমেদ, পারভিন বেগম প্রমুখ।

পুলিশ জানায়, গত ৫ আগস্ট ছাত্র-জনতার গণ-অভ্যুত্থানের পর গাজীপুরের টঙ্গীতে ফেরেন ২৪ মামলার সাজাপ্রাপ্ত আসামি কামরুল ইসলাম ওরফে কামু। টঙ্গীতে ফিরেই তিনি টঙ্গীর উত্তর পূর্বাঞ্চলের অপরাধ জগতের নিয়ন্ত্রণে নেন। নিজ নামেই গড়ে তোলেন সন্ত্রাসী ‘কামু বাহিনী’। এলাকার বাসিন্দাদের কাছে আতঙ্কের প্রতিশব্দ ছিল কামু। তার বিরুদ্ধে টঙ্গী পূর্ব থানায় অবৈধ অস্ত্র বেচাকেনা করায় ৩টি, মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ আইনে ১১টি, বিস্ফোরক দ্রব্য আইনে দুটি, জোড়া হত্যা মামলাসহ ৩টি হত্যা মামলা, চাঁদাবাজি ঘটনায় একটি ও সরকারি সম্পত্তি দখলের অভিযোগে একটি ও দাঙ্গা-হাঙ্গামার অভিযোগে ৩টি মামলাসহ অন্তত ২৪টি মামলা রয়েছে।

গাজীপুর মহানগরী দক্ষিণ গোয়েন্দা পুলিশের উপকমিশনার মো. আকবর আলী মুন্সি বলেন, সোমবার ভোরে কামু বাহিনীর প্রধান কামুকে গ্রেফতার শেষে গোয়েন্দা পুলিশের কার্যালয় এনে জিজ্ঞাসাবাদ করা হয়। তাকে ২টি পৃথক মামলায় গ্রেপ্তার দেখিয়ে সোমবার দুপুরে আদালতে মাধ্যমে জেল হাজতে পাঠানো হয়েছে।

এদিকে, এলাকাবাসী সূত্রে জানা গেছে, শেখ হাসিনা সরকারের পতনের পর ১০ আগস্ট বিএনপির কেন্দ্রীয় কমিটির নির্বাহী সদস্য ও সাবেক সংসদ সদস্য হাসান উদ্দিন সরকারের ছত্রচ্ছায়ায় টঙ্গীতে ফিরেছেন কামু। আগে এরশাদনগরের ৪ নম্বর ব্লকে একটি টিনশেড বাড়িতে থাকতেন তিনি। অথচ ফিরে আসার তিন মাসের মধ্যেই টঙ্গীর দত্তপাড়া চানকিটেক এলাকার পাঁচ কাঠা জমি, এরশাদনগর এলাকায় সরকারি জমি দখল, প্রায় ৫০ লাখ টাকার একটি প্রাইভেট কারসহ কয়েক কোটি টাকার সম্পদের মালিক হয়ে গেছেন কামু।

কামুর ঘনিষ্ঠ একটি সূত্র জানায়, কামুর বাবা তমিজ উদ্দিন ছিলেন ডাকাত দলের সদস্য। তমিজ উদ্দিন তাঁর পরিবার নিয়ে মুন্সিগঞ্জে থাকতেন। প্রায় চার দশক আগে ডাকাতির ঘটনায় স্থানীয়রা তমিজ উদ্দিনের বসতবাড়িতে আগুন ধরিয়ে দেন। পরে পরিবারের সদস্যদের নিয়ে তমিজ টঙ্গীর এরশাদনগর এলাকার ওই বস্তিতে ঠাঁই নেন। কামু ১৯৮০ সালে টঙ্গীতে জাতীয় পার্টিতে যোগ দেন। কয়েক বছর পর দল পাল্টে বিএনপিতে যোগ দেন। তবে বিগত আওয়ামী লীগ সরকারের শাসনামলে তাঁকে দেখা যায়নি।

কামুর অপরাধ জগতে বিচরণ শুরু হয় ২০০৪ সালে। সেই সময় অবৈধ অস্ত্র বেচাকেনা করতে গিয়ে র‍্যাপিড অ্যাকশন ব্যাটালিয়নের (র‍্যাব) কাছে একটি পিস্তলসহ কামু গ্রেপ্তার হন। ওই ঘটনার ১০ বছর পর বিদেশি পিস্তলসহ তৎকালীন টঙ্গী মডেল থানা-পুলিশের কাছে (বর্তমানে টঙ্গী পূর্ব থানা) গ্রেপ্তার হন তিনি। এ ছাড়া ২০১৪ সালে মাদক কারবারের তথ্য পুলিশকে দেওয়ায় পুলিশের সোর্স রাসেল, র‍্যাবের সোর্স ফয়সাল এবং ২০১৬ সালে মাদক বেচাকেনাকে কেন্দ্র করে এরশাদনগর এলাকায় শরিফ হোসেন ও জুম্মনকে কুপিয়ে হত্যা করেন কামু ও তার বাহিনী।

স্থানীয়রা জানান, এলাকায় ফিরেই কামু তাঁর বাহিনী দিয়ে টেকনাফ থেকে ইয়াবা বড়ি এনে বিক্রি শুরু করেছেন। মোবারক হোসেন ও নাসির উদ্দিন ওরফে টাকি নাসির নামের দুজন কামুর হয়ে এই কাজ করেন।

সরজমিনে এরশাদনগর এলাকার একাধিক ব্যক্তির সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, কামু বাহিনীতে রয়েছেন দ্বীন মোহাম্মদ দিলা, মোবারক হাসেন ওরফে পাকিস্তানি মোবারক, হিরা, আলমগীর ওরফ পোটকা আলমগীর, নাসির উদ্দিন ওরফে টাকি নাসির, ওয়াসিম, রুবেল, সাগর, সাদিকুল ইসলাম, সোহেল, আরিফ, বাবুল চৌধুরী, নাইমসহ অর্ধশত অস্ত্রধারী ক্যাডার। তাঁদের মধ্যে দিলা ও মোবারক কামুর প্রধান সহযোগী হিসেবে এলাকায় সন্ত্রাসী কার্যক্রম পরিচালনা করে।

স্থানীয় সূত্রে জানা গেছে, কামু বাহিনীর সদস্যরা এলাকায় আধিপত্য বিস্তার ও মাদক স্পট দখলে নিতে প্রায়ই সন্ধ্যার পর এরশাদনগর ও এর আশপাশের এলাকায় আগ্নেয়াস্ত্র, রামদা, হকিস্টিক, চাপাতি নিয়ে মহড়া দেয়। সর্বশেষ গত মঙ্গলবার রাতে এরশাদনগর বস্তি এলাকায় যুবদলের সভাপতি আনোয়ার হোসেনের ভাগনে, রিকশার গ্যারেজের মালিক মঞ্জুরের কাছে পাঁচ লাখ টাকা দাবি করেন। এ নিয়ে উভয় পক্ষের সংঘর্ষের সময় কামু বাহিনীর সদস্যরা ককটেল হামলা ও কয়েকটি ফাঁকা গুলি ছোড়ে। এমনকি টঙ্গী পূর্ব ও পশ্চিম থানা-পুলিশের কয়েকটি দলের উপস্থিতিতে দ্বিতীয় দফার হামলায় পুলিশের একটি গাড়ির কাচ ভেঙে যায়। সংঘর্ষে উভয় পক্ষের ৫ জন আহত হন।

এ ছাড়া গাজীপুর মহানগরীর ৪৯ নম্বর ওয়ার্ড যুবদলের সভাপতি আনোয়ার হোসেনের ভাগনে হৃদয়কে (২৯) কুপিয়ে জখম করে কামু বাহিনী। এর আগে গত শনিবার রাতে হিমারদিঘী এলাকার দুটি রিকশার গ্যারেজ দখল করে নেন কামু। পরে গ্যারেজ মালিক রহিমকে তুলে নিয়ে হাতুড়িপেটা করে ফাঁকা স্ট্যাম্পে সই নেন। এ ঘটনায় টঙ্গী পূর্ব থানায় সাধারণ ডায়েরি (জিডি) করার পর কামুর লোকজন রহিমের বাড়িতে হামলা চালায় বলে জানান ভুক্তভোগী। এখন তিনি পরিবার নিয়ে পালিয়ে আছে বলেও জানান। এর আগে গত ২৩ সেপ্টেম্বর এরশাদনগর ৩ নম্বর ব্লকে ব্যবসায়ী ও যুবদলের কর্মী স্বপন মিয়াকে বেধড়ক পিটিয়ে হাত ও পা ভেঙে দেয় কামুর বাহিনী।

এরশাদ নগর এলাকার বাসিন্দা মুক্তা বেগম বলেন,কামু সুযোগ সন্ধানী, সে সুযোগ বুঝে এরশাদ নগরে ডুকে ত্রাসের রাজত্ব কায়েম করতে নতুন নতুন সন্ত্রাসী বাহিনী সৃষ্টি করে। স্কুল কলেজ পড়ুয়া ছেলে মেয়েদের হাতে অস্ত্র মাদক তুলে দেয় তিনি। তার বিরুদ্ধে কথা বলা তো দূরের কথা তাকে নিয়ে চিন্তা করলেও হামলার শিকার হতে হয়।

টঙ্গী পূর্ব থানা মহিলা দলের সাধারণ সম্পাদক রাবেয়া বেগম বলেন,এরশাদ নগরের মানুষ শান্তি প্রিয় কিন্তু কামু ও তার সন্ত্রাসী বাহিনীর আধিপত্যের কারণে এই এলাকার মানুষের মাঝে মৃত্যু ভয় কাজ করছে। আমরা এখনো আতঙ্কিত তার সন্ত্রাসী বাহিনীরা যেকোনো মুহূর্তে আমাদের উপর হামলা চালাতে পারে। কামুসহ তার সন্ত্রাসী বাহিনীদের কঠোর শাস্তির দাবিও জানান তিনি।
যাযাদি/এসএস