আওয়ামীলীগ ক্ষমতায় থাকাকালীন সময়ে দলীয় প্রভাবখাটিয়ে হাসপাতালের টাইলস নিজ বাড়িতে লাগানো,ঊধ্বর্তন কর্মকর্তাদের সঙ্গে দুর্ব্যব্যবহার,কর্মচারীদের চাঁদা দিতে বাধ্য করার অভিযোগ তদন্তের মাধ্যমে প্রমাণিত হওয়ায় ২০১৬ সালে মানিকগঞ্জ সদর হাসপাতালের তৎকালিন প্রধান অফিস সহকারী আব্দুল করিম মিয়াকে ঢাকার নবাবগঞ্জ উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে বদলী করা হয়।
এরপর সেখানে কয়েকমাস থাকার পর আব্দুল করিম মিয়ার বিরুদ্ধে উঠে নানা অনিয়মের অভিযোগ। এরপর সেখান থেকে আব্দুল করিমকে ঢাকার চক্ষু বিজ্ঞান ইনষ্টিটিউট হাসপাতালে বদলী করা হয়। সেখানেও তিনি এক বছরের কম সময় থাকার পর সাবেক সংসদ সদস্য এবং সাবেক স্বাস্থ্য মন্ত্রী জাহিদ মালেক স্বপনের পিএস সামছুল আলমকে ম্যানেজ করে করিম গাজিপুর জেলার টঙ্গি হাসপাতালে চলে যায়। এরপর তৎকালিন মানিকগঞ্জ কর্ণেল মালেক মেডিকেল কলেজ ও হাসপাতাল (বর্তমানে মানিকগঞ্জ মেডিকেল কলেজ ও হাসপাতাল) আনুষ্ঠানিক চালু হলে স্বাস্থ্য মন্ত্রী পিএসের মাধ্যমে নিজ জেলায় চলে আসেন। কিন্তু মানিকগঞ্জ মেডিকেল কলেজ ও হাসপাতালে যোগদান করার পর আব্দুল করিম বেপরোয়া দুর্নীতি ও স্বজনপীতি শুরু করেন। একদিকে আওয়ামী পরিবারের সন্তান অন্যদিকে স্বাস্থ্য মন্ত্রীর ছেলে রাহাত মালেক ও পিএস সামছুল আলম ম্যানেজ থাকায় একজন হিসাব রক্ষক কর্মকর্তা (নিজ বেতনে) হয়ে সুকৌশলে ঢাকার প্রভাবশালী ঠিকাদারদের কাজ পাইয়ে দিয়ে লাখ লাখ টাকা আয় করতে থাকেন।
মানিকগঞ্জ মেডিকেল কলেজ ও হাসপাতালে থাকাকালীন সময়ে আব্দুল করিমের বিরুদ্ধে চুক্তি ভিক্তিক নিয়োগ,পথ্য,ধোলাই,ষ্টেশনারী,খাবার ও ঔষুধ সরবরাহের কাজ তার পছন্দের ঢাকা এবং গাজিপুর জেলার প্রভাবশালী ঠিকাদারদের কৌশলে পাইয়ে দেয়ার অভিযোগ উঠে। এর বিনিময়ে আব্দুল করিম তাঁর পছন্দের মানুষদের নিজ ক্ষমতাবলে চুক্তিভিক্তিক নিয়োগ দিয়ে অবৈধ ভাবে লাখ লাখ টাকা আয় করেন। এ নিয়ে সাবেক স্বাস্থ্য মন্ত্রীর ফুপাতো ভাই তৎকালিন উপজেলা চেয়ারম্যান এবং সদর উপজেলা আওয়ামীলীগের সভাপতি ইসরাফিল হোসেনের সঙ্গে করিমের চরম বিরোধ সৃষ্টি হয়। এক পর্যায়ে ইসরাফিল হোসেন বিষয়টি জাহিদ মালেককে অবগত করলে গত ২০২১ সালের ৮ নভেম্বর আব্দুল করিমকে শহীদ জিয়াউর রহমান মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে বদলী করা হয়। ওই খানে চার থেকে পাঁচমাস থাকাকালীন সময়ে অনিয়মিত উপস্থিতি এবং দুর্নীতির অভিযোগ উঠায় করিমকে সিরাজগঞ্জ শহীদ এম মুনসুর আলী মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে বদলী করা হয়। শহীদ এম মুনসুর আলী মেডিকেল হাসপাতালে থাকাকালীন সময়ে স্থানীয় সংসদ সদস্য (সিরাজগঞ্জ-২ সদর ও কামারখন্দ) ডা. হাবিবে মিল্লাত মুন্নার সহযোগীতায় বিএনপি নেতাকর্মীদের সঙ্গে খারাপ আচরন,অফিসে অনিয়মিত উপস্থিতি সহ হাসপাতালে প্রভাবখাটাতে থাকেন। গত ৫ আগষ্ট শেখ হাসিনা দেশ ছেড়ে পালানোর পর আব্দুল করিম মানিকগঞ্জ চলে আসেন। এরপর মাস খানেক নিজ বাড়িতে চুপচাপ থেকে গত মাসে ভোল পাল্টিয়ে বিএনপি সেজে উর্দতন কতৃপক্ষকে ম্যানেজ করে সিরাজগঞ্জ শহীদ এম মুনসুর আলী মেডিকেল হাসপাতাল থেকে মানিকগঞ্জ মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে বদলী হয়ে চলে আসেন।
খোঁজ নিয়ে জানা গেছে,গত পাঁচ আগষ্ট শেখ হাসিনা সরকার পতনের পর আওয়ামীলীগ করা আব্দুল করিম ভোল পাল্টিয়ে নিজ জেলা মানিকগঞ্জ মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে বদলী হয়ে এসেছেন। গত ১৩ নভেম্বর স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের অতিরিক্ত দায়িত্বে থাকা পরিচালক (প্রশাসন) ও পরিচালক (হোমিও ও দেশজ চিকিৎসা) ডা. এবিএম আবু হানিফ স্বাক্ষরিত একটি প্রজ্ঞাপনে আব্দুল করিমকে এই দায়িত্ব দেওয়া হয়। কিন্তু আব্দুল করিমের বিরুদ্ধে মানিকগঞ্জ সদর এবং মানিকগঞ্জ মেডিকেল কলেজ ও হাসপাতালে দায়িত্বে থাকাকালীন সময়ে নানা ধরনের দুর্নীতির অভিযোগ থাকায় হাসপাতালের চিকিৎসক এবং নার্সদের বাঁধায় তিনি যোগদান করতে পারেনি।
ডক্টর অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশ (ড্যাব) মানিকগঞ্জ জেলা শাখার সভাপতি ডা. বদরুল আলম চৌধুরী বলেন, হিসাব রক্ষক কর্মকতা আব্দুল করিম একজন দুর্নীতিবাজ কর্মচারী হিসেবে পরিচিত। আওয়ামীলীগ ক্ষমতায় থাকাকালীন সময়ে সাবেক স্বাস্থ্য মন্ত্রী জাহিদ মালেকের পরিবারের আস্থাভাজন হয়ে সদর হাসপাতালে টাইলস চুরি সহ নানা ধরনের দুর্নীতি অনিয়ম করে বদলী হয়েছিল। তিনি মানিকগঞ্জ থেকে অন্যত্র যেখানে যেখানে গেছেন সব জায়গায় অনুপস্থিত থেকে নিজ জেলায় আসার জন্য বদলীর লবিং করেছেন। মাঝে একবার মেডিকেল কলেজ ও হাসপাতালে এসে অনিয়ম ও দুর্নীতির করে বদলী হয়েছেন। করিমের মত একজন দুর্নীতিবাজ কর্মকর্তা কোন ভাবে যেন মানিকগঞ্জ মেডিকেল কলেজ ও হাসপাতালে যোগদান করতে না পারেন সেদিকে কতৃপক্ষের সেদিকে খেয়াল রাখতে হবে।
মানিকগঞ্জ মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের কর্মরত নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক একাদিক চিকিৎসক ও নার্স জানান, আওয়ামীলীগ ক্ষমতায় থাকাকালীন সময়ে ২০২০ সালের দিকে আব্দুল করিম নানা ধরনের অপকর্ম করেছেন। তাঁর যন্ত্রণায় অতিষ্ট ছিল মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের প্রায় সকল চিকিৎসক ও নার্স। হিসাব রক্ষকের দায়িত্বে থেকে আওয়ামীলীগের প্রভাব খাটিয়ে অবৈধ পক্রিয়ার মাধ্যমে তাঁর পছন্দের ঠিকাদারদের বড় বড় কাজ পাইয়ে দিতেন তিনি। দুর্ণীতির প্রমান হওয়ায় যাকে হাসপাতাল থেকে বদলী করা হয়েছে তাকে আমরা এই হাসপাতালে চাই না।
এ বিষয়ে অভিযুক্ত হিসাব রক্ষক কর্মকতা আব্দুল করিম বলেন, আমি কখনো আওয়ামীলীগ করিনি। চাকরির সুবাদে কতৃপক্ষ আমাকে যেখানে বদলী করেছে আমি সেখানে গিয়ে সুনামের সাথে চাকরী করেছি।
তিনি বলেন, আমার বিরুদ্ধে করা দুর্নীতির অভিযোগগুলো মিথ্যা ও বানোয়াট। একটি সুবিধাবাদি চক্র যারা আমার খারাপ চায় তাঁরা চক্রান্ত করে আমাকে ফাঁসানোর চেষ্টা করেছিল।
মানিকগঞ্জ মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের পরিচালক শফিকুল ইসলামের সঙ্গে কথা হলে তিনি বলেন, হিসাব রক্ষক কর্মকর্তা আব্দুল করিমের যোগদানের প্রজ্ঞাপন আমি পেয়েছি। কিন্তু মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল এবং সদর হাসপাতালে কর্মরত থাকাকালীন সময়ে আব্দুল করিমের বিরুদ্ধে প্রভাবখাটানো সহ নানা ধরনের দুর্নীতির অভিযোগ থাকায় বিএনপি, ড্যাব, হাসপাতালের চিকিৎসক এবং নার্সরা চাচ্ছেননা তিনি যোগদান করুক।
তিনি বলেন, আমি বিষয়টি আমার উর্দতন কতৃপক্ষকে জানিয়েছি। খুব দ্রুত থাঁর বিষয়ে নির্দেশনা পাওয়া যাবে।
এ বিষয়ে কথা বলতে স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের অতিরিক্ত দায়িত্বে থাকা পরিচালক (প্রশাসন) ও পরিচালক (হোমিও ও দেশজ চিকিৎসা) ডা. এবিএম আবু হানিফের সরকারী ফোন নাম্বারে একাদিকবার যোগাযোগের চেষ্টা করেও তাকে পাওয়া যায়নি।
যাযাদি/এসএস