স্বামী জোবায়ের শহীদ হওয়ার চার মাস পেরিয়ে গেলেও তাঁর পাঞ্জাবি, টি-শার্ট আর টাওয়ালে জড়িয়ে থাকা নানান স্মৃতি রোমন্থন করে স্বামীর অস্তিত্ব খুঁজে ফিরছেন স্ত্রী মোছাঃ মারজিনা আক্তার। স্বামীকে ভুলতে পারছেন না এক মুহুর্তের জন্যও তিনি। প্রতি রাতেই চোখের পানিতে খুঁজে ফিরছেন স্বামীকে।
এভাবেই দিন কাটাচ্ছে ময়মনসিংহের গৌরীপুরে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনে শহীদ জোবায়ের আহম্মেদের স্ত্রী মোছাঃ মারজিনা আক্তারের। তিনি ঈশ্বরগঞ্জ উপজেলার বড়হিত ইউনিয়নের বৃ-পাঁচাশি গ্রামের মোঃ শহীদুল্লাহর মেয়ে।
গত বুধবার তার বাবার বাড়িতে গিয়ে দেখা গেছে, মারজিনা আক্তারের বিছানার এপাশ-ওপাশে স্বামীর পাঞ্জাবি-টিশার্ট আর টাওয়েল ছড়িয়ে আছে। জুলাই-আগস্ট গণঅভ্যূত্থানে ময়মনসিংহ-কিশোরগঞ্জ মহাসড়কে উপজেলার কলতাপাড়ায় ২০ জুলাই পুলিশের গুলিতে শহীদ হন জোবায়ের আহম্মেদ। ২০২৩ সালের জুন মাসে জোবায়ের-মারজিনার বিয়ে হয়।
কোটাবিরোধী আন্দোলনকে ঘিরে একই স্থানে আরও ২ জন শহীদ হয়েছেন। তারা হলেন উপজেলার ডৌহাখলা ইউনিয়নের চূড়ালী গ্রামের বাবুল মিয়ার ছেলে বিপ্লব হাসান (১৯) ও রামগোপালপুর ইউনিয়নের দামগাঁও গ্রামের মধ্যপাড়ার আব্দুল হালিম শেখের ছেলে নুরে আলম সিদ্দিকী রাকিব (২২)।
কোটাবিরোধী আন্দোলন থেকে বৈষম্যবিরোধী আন্দোলনের মিটিং- মিছিলে নিয়মিত মুখ ছিলো জোবায়ের আহম্মেদ।
ঘটনার দিনের বর্ণনা দিতে গিয়ে মোছা. মারজিনা আক্তার বলেন, ২০ জুলাই কলতাপাড়ার আন্দোলনে যেতে সকালেই খাওয়া-দাওয়া করে জোবায়ের আহম্মেদ বাসা থেকে বের হওয়ার জন্য প্রস্তুতি নেয়। এ সময় তার মোবাইলে একটি কল আসলে ওই প্রান্তে যারা ছিলো তাদের বলতে শুনেছি একটু দাঁড়া এখনই বের হচ্ছি। যাওয়ার আগে জোবায়ের বলেছে দোকানে পরে যাবে, এখন খেলতে যাবে বন্ধুরা দাঁড়িয়ে আছে। চিন্তা করো না,চলে আসবো। এ সময় সে আমার কাছে ১০০ টাকা চায়, ওরই দেয়া টাকা ছিলো। বললাম ৫০ টাকা খরচ হয়ে গেছে, বাকি ৫০ টাকা নিয়েই সে বেড়িয়ে পড়ে আন্দোলনে।
কান্নায় ভেঙ্গে পড়ে হাউমাউ করে তিনি বলেন, ঘর থেকে বেরিয়ে যাওয়ার দেড়-দুই ঘন্টার মধ্যেই একটি অ্যাম্বুলেন্স আসে। দেখি এ আমার প্রিয় স্বামী জোবায়ের। ওর নিথর দেহ দেখে আমি জ্ঞান হারিয়ে ফেলি, হাত-পা অবশ হয়ে যায়। ৮ দিন পর আমার জ্ঞান ফিরে। জোবায়ের, জোবায়ের বলে ডাকি, ওতো সাড়া দেয় না, কথা বলে না, এরপর মানসিকভাবে ভেঙ্গে পড়ি।
তিনি আরও বলেন, বাবা বাসায় নিয়ে আসেন আমাকে। তখনো সোজা হয়ে দাঁড়াতে পারছিলাম না। হাতেও কোনো শক্তি ছিল না। অন্যের সহযোগিতায় কাপড়-চোপড় বদলাতে হতো। আমিও জোবায়েরের সঙ্গে যেতে চাই, সে তো আমাকে নিলো না। একাই চলে গেলো।
মারজিনার বাবা মো. শহীদুল্লাহ জানান, মেয়ের জামাই নেই,মেয়ে অসুস্থ। মেয়েকে সুস্থ করার জন্য একেকবার একেক ডাক্তারের পরামর্শ নিয়েছি। সে তো মানসিকভাবে অসুস্থ হয়ে পড়েছিল। আমার ২ ছেলে আর ৩ মেয়ের মধ্যে সে চতুর্থ। তাকে ভালো করার জন্য পরিবারের সবাই অস্থির হয়ে পড়ে। প্রায় ৪০ হাজার টাকা তখন ব্যয় করতে হয়।
মারজিনার মা মোছা. মনোয়ারা খাতুন বলেন, টেলিভিশনে বা পত্রিকায় গণঅভ্যুত্থানের ছবি বা খবর দেখলেই সে হাউমাউ করে কান্না জুড়ে দেয়। জোবায়েরকে খোঁজে, তখন সে বিয়ের পাঞ্জাবি, টি-শার্ট আর টাওয়ালের গন্ধ শুঁকে। এমন দৃশ্য দেখলে পৃথিবীর কোনো মা স্থির থাকতে পারে না, আমিও মেয়ের জন্য অস্থির হয়ে পড়েছি। ওকে সান্তনা দেবার ভাষা হারিয়ে ফেলেছি। তিনি জানান ছেলে-মেয়ের বয়স সংক্রান্ত জটিলতা থাকায় ধর্মীয় ও সামাজিকভাবে ২০২৩ সালের জুন মাসে দু'জনের বিয়ে হয়। তাদের বিয়ের রেজিস্ট্রি হয় চলতি বছর ২০২৪ সনের ১৩ এপ্রিল।
শহীদ জোবায়ের আহম্মেদের লাশ আন্দোলনকারীরা বাড়িতে ঘটনার দিনই পৌঁছে দেয়। ছেলের জানাজায় ইমামতি করেন তার বাবা মো. আনোয়ার উদ্দিন।
জোবায়ের ময়মনসিংহের গৌরীপুর উপজেলার মইলাকান্দা ইউনিয়নের পূর্বকাউরাট গ্রামের অবসরপ্রাপ্ত শিক্ষক মোহাম্মদ আনোয়ার উদ্দিনের ছেলে । ৬ মেয়ে আর ৩ ছেলে সন্তানের মাঝে জোবায়ের ছিলো ৮ম।
জোবায়ের কাউরাট আকবর আলী দাখিল মাদ্রাসা থেকে ৮ম শ্রেণি পাশ করেন। এরপর গৌরীপুর টেকনিক্যাল স্কুল অ্যান্ড কলেজে ৯ম শ্রেণিতে ভর্তি হন। দিয়েছিলেন এসএসসি পরীক্ষা। এক বিষয়ে ফেল করায় আবারও পরীক্ষা দেন। এই কারিগরি কলেজে পড়া অবস্থাতেই শম্ভূগঞ্জ দোকান ঘর ভাড়া নিয়ে শুরু করেন পুরাতন মোবাইল ও মোবাইলের যন্ত্রাংশ বিক্রির ব্যবসা। পরে ভারত ও চীন থেকে মোবাইলের যন্ত্রাংশ, নতুন মোবাইল ফোন আমদানী এবং পুরাতন মোবাইলের যন্ত্রাংশও রপ্তানি করতেন জোবায়ের। তার আয়েই চলতো পুরো সংসার।
যাযাদি/এআর