ছোট সন্তানগুলো খাবারের জন্য কান্না করছিল। এসময় তাদের একটু পানি খাওয়ায়ে নাস্তা আনতে যাচ্ছি বলে আমি আমার মেয়ে দুইটাকে নিয়ে বস্তা কাধে করে প্লাস্টিক কুড়াতে বের হলাম।
সৈকতের বিভিন্ন জায়গা থেকে কুড়িয়ে পাওয়া তিন বস্তা প্রায় সাড়ে আট কেজি প্লাটিক বর্জ্য নিয়ে গিয়ে সৈকত সুপারশপে জমা দিয়ে দিই। বিনিময়ে পেয়েছি নিজের পছন্দের চাল তেল ডিমসহ অনেক বাজার পণ্য। এটা আমাদের মতো নিম্নবিত্ত পরিবারের জন্য অনেক বড় উপকার। কিযে আনন্দ আজ সন্তানদের নিয়ে দুবেলা পেট ভরে তৃপ্তি করে খাওয়া যাবো কথাগুলো বলার সময় চোখের পানি ছলছলিয়ে আসছিল আয়েশা বেগমের। থাকেন ঝাউবন বস্তীর ঝরাজীর্ণ ঘরে।
প্লাস্টিক বর্জ্য দিন,বাজার নিন, এই প্লাস্টিকেই খেয়ে ফেলবে আমাদের ভবিষ্যৎ, সবাই মিলে প্লাস্টিক দূষণ রোধ করি সুন্দর দেশ গড়ি। প্লাস্টিক পুনর্ব্যবহার ও রিসাইক্লিং করে পরিবেশ বাঁচাই” এমন সব শ্লোগান নিয়ে প্লাস্টিক বিনিময় বাজার চালু হয়েছে।
সৈকতে প্লাস্টিক দূষণ কমাতেসেই সাথে অসহায় মানুষদের সহায়তা করতে বিদ্যানন্দ ফাউন্ডেশন
চার মাসের জন্য একটি সুপারশপ বসানো হয়েছে কক্সবাজার সমুদ্র সৈকতের সুগন্ধা পয়েন্টে। প্লাস্টিক বর্জ্য দিয়ে প্রায় ১৯টি পণ্য থেকে পছন্দমতো পণ্য কেনার সুযোগ রয়েছে।গবেষকদের মতে, প্লাস্টিক বর্জ্য শুধু পরিবেশ দূষণই করেনা, এটি জনস্বাস্থ্যের জন্যও মারাত্নক হুমকি সৃষ্টি। বিভিন্ন রাসায়নিক উপাদানে প্লাস্টিক তৈরি,ফলে খাদ্য ও পানিতে মিশে এসময় মাইক্রো প্লাস্টিকে পরিণত হয়। পরে মাছসহ জলজ প্রাণী এসব বর্জ্য খাওয়ার ফলে এক সময় খাদ্য শৃঙ্খলের মাধ্যমে মানব শরীরেও পৌঁছে যায়। এই মাইক্রো প্লাস্টিক মানুষের শরীরে ক্যান্সার, হরমোনের ভারসাম্যহীনতা, বন্ধ্যাত্ব ও অন্যান্য স্বাস্থ্য সমস্যা সৃষ্টি হ্েচ্ছ। বিশেষ করে সৈকতে ময়লা আবর্জনা ও প্লাস্টিক বর্জ্য জোয়ারের পানিতে মিশে যাওয়ায় ব্লু-ইকোনমি বা সমুদ্র অর্থনীতিও হুমকির মুখে পড়ছে।
সোমবার সকালে সরেজমিন দেখা যায়, সমুদ্র সৈকতের সুগন্ধা পয়েন্টে একটি সুপারশপ বসেছে নানা রকমের নিত্যপ্রযোজনীয় পণ্যের পসরা নিয়ে। কমবেশি সবার হাতে প্লাস্টিকের বোতল। প্রতিদিন সকাল থেকেই বিভিন্ন স্থান থেকে ব্যবহৃত প্লাস্টিক পণ্য কুড়িয়ে বস্তাভর্তি করে নিয়ে এসে সুপারশপে জমা দিচ্ছে পর্যটক থেকে শুরু করে স্থানীয় আর নিম্ন আয়ের মানুষ। “প্লাস্টিক বিনিময় বাজার”নামের সুপারশপে এসব প্লাস্টিক জমা দিয়ে কেউ নিচ্ছেন টি–শার্ট, কেউ নিচ্ছেন উপহার। আবার নিত্যপণ্য বাজার নিয়েছেন। এসব প্লাস্টিক পণ্য সৈকত থেকে কুড়িয়ে, কেউ ঘরে জমানো প্লাস্টিক নিয়ে স্বল্পমূল্যে বিক্রি করতেন ভাঙারি ব্যবসায়ীদের কাছে।
বাজারে ১ কেজি প্লাস্টিকের দাম ২০-৩০ টাকা হলেও সেখানে বিক্রি করা হয় ৬০-৮০ টাকায়। এতে ১ কেজি প্লাস্টিক দিয়ে ১ কেজি চাল বা ৬টি ডিম পাওয়া যাচ্ছে। তাছাড়া প্রায় ১৯ টি পণ্য থেকে নিজেরাই তাদের পছন্দের পণ্য নিচ্ছে ক্রেতা। অনেকে প্লস্টিকের বোতল জমা দিয়ে পর্যটকরা বিভিন্ন উপহার জিতে নিচ্ছেন। প্লাস্টিকের বিনিময়ে পণ্য কিনতে পেরে খুশি তারা। এই উদ্যোগটি স্থানীয় মানুষের মধ্যে প্লাস্টিক দূষণ সম্পর্কে সচেতনতা বৃদ্ধি করতে সহায়তা করছে সেইসাথে দারিদ্রতার াথে যুদ্ধ করা জনগোষ্ঠীর আর্থিক সহায়তা হিসেবে কাজ করছে।
খুলনার পর্যটক ব্যবসায়ী আবসারুল ইসলাম বলেন, সৈকতে এসে প্লাস্টিক জমা দিয়ে টি-শার্টের মতো উপহার পাওয়া এক নতুন অভিজ্ঞতা। এটি যেমন আমাদের জন্য আনন্দদায়ক, তেমনই সৈকতের পরিবেশকে পরিষ্কার রাখতে সাহায্য করছে।
একটা বিষয় শেয়ার করছি, আমি সৈকতে এসে নিজেও বেশ কয়েকজন পর্যটককে যত্রতত্র প্লাস্টিক পণ্য না ফেলে নির্দিষ্ট ডাসবিনে ফেলতে বলেছি। এই সৈকতকে সম্পূর্ণ দূষণমুক্ত রাখতে হলে সচেতনতা ও কার্যকর পদক্ষেপ গ্রহণের পাশাপাশি সবার সম্মিলিত প্রচেষ্টার বিকল্প নেই।
প্লাস্টিক কুড়িয়ে মাথায় করে আনা রেহেনা আকতার বলেন, প্লাস্টিক কুড়িয়ে বিক্রি করা আমাদের জন্য এখন কাজের সুযোগ হয়েছে। প্রতিদিন সকাল থেকে প্লাস্টিক কুড়াতে বের হয়। সেগুলো জমা দিয়ে অনেক বাজার পণ্য পায়। সুন্দরভাবে এমন বাজার করার সুযোগ পাবো কখনো ভাবিনি।
রিকশা ভর্তি করে প্লাস্টিক নিয়ে এসেছেন আবু সুলতান। তিনি বলেন, প্লাস্টিক বর্জ্য জমা দিয়ে বাজার মিলছে এমন খবর জানতে পারার পর আমার কুড়ানো প্লাস্টিক পণ্য নিয়ে এসে জমা দিয়েছি। প্রায় ১২কেজি হয়েছে।তার বদলে আমি আমার পছন্দের জিনিসগুলো পেয়েছি। আমাদের মতো সাধারণ মানুষের জন্য অনেক ভালো একটি বিষয়, যে দাম জিনিস পাতির, তেল, ডিম, ডাল নিলাম অনেকগুলো টাকা বাঁচলো।
বিদ্যানন্দ ফাউন্ডেশনের স্বেচ্ছাসেবী রানা আহমেদ বলেন, সৈকতের বিভিন্ন স্থানে প্লাস্টিকসহ বর্জ্য ফেলার ফলে প্রতিনিয়ত পরিবেশের সৌন্দর্য হানি ঘটছে। এসব বর্জ্য পরিষ্কারের পাশাপাশি জনসচেতনতা সৃষ্টি হচ্ছে। তাছাড়া প্লাস্টিক বর্জ্য জমা দিলেই সবার হাতে উপহার বা বাজার সামগ্রী তুলে দেওয়া হচ্ছে।জনসচেতনতা ও বসবাসযোগ্য সুন্দর পরিবেশ তৈরিতে সবাইকে উৎসাহিত করতে এ উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। তাই মানুষকে সম্পৃক্ত করতেই আমরা সারা দেশে াস্টিক এক্সেঞ্জ স্টোর চালু করছি
কক্সবাজারের জেলা প্রশাসক মোহাম্মদ সালাহউদ্দিন বলেন, একবিংশ শতাব্দীতে আমাদের অস্তিত্বের হুমকি হচ্ছে প্লাস্টিক। এই পৃথিবীকে সম্পূর্ণ দূষণমুক্ত ও বাসযোগ্য রাখতে হলে সচেতনতা ও কার্যকর পদক্ষেপ গ্রহণের পাশাপাশি আমাদের সবার সম্মিলিত প্রচেষ্টার বিকল্প নেই। এই উদ্যোগটি শুধু পরিবেশের জন্যই নয়, স্থানীয় দরিদ্র মানুষের জন্যও সহায়ক ভূমিকা পালন করছে।
উল্লেখ্য,বিদ্যানন্দ ফাউন্ডেশন একটি বাংলাদেশি স্বেচ্ছাসেবী সংস্থা। সংগঠনটি পথশিশু, সুবিধাবঞ্চিত দরিদ্র ও অসচ্ছল শিশুদের মৌলিক শিক্ষা, আহার, চিকিৎসা এবং আইন সেবা দিয়ে থাকে।
যাযাদি/ এস