ঈশ্বরদীতে খেজুরের রস সংগ্রহে ব্যস্ত গাছিরা
প্রকাশ | ১৭ নভেম্বর ২০২৪, ১৪:১৮
“মাটির হাঁড়ি কাঠের গায়, গলা কেটে দুধ দোহায়” গ্রাম বাংলার জনপ্রিয় এই শ্লোক মনে করিয়ে দেয় খেজুর গাছের গলায় মাটির হাড়ি ঝুলিয়ে তা থেকে সংগ্রহ করা সুমিষ্ট রস আহরণের মহা উৎসবের কথা। যে উৎসব শুরু হয় নভেম্বরের শুরু থেকে। শীতের আগমনী বার্তার সাথে সাথে তার পূর্ণতা পায় গ্রাম বাংলার প্রতিটি ঘরে। সকালে খেজুরের গাছ থেকে সংগ্রহ করা সুমিষ্ট খেজুর রসের তৈরী পিঠা পায়েশ যেন বাঙ্গালিয়ানাকে পরিপূর্ণতা দান করে প্রাকৃতিক ভাবে।
খেজুর রসের মিষ্টি গন্ধে মৌ মৌ করছে গৃহস্থের রান্না ঘর। নতুন ধানের চাল আর শীত সকালে গরম খেজুর রসে ভেজানো পিঠা সব মিলিয়ে গ্রামগঞ্জে শুরু হয়েছে নবান্ন উৎসব।
ঈশ্বরদী উপজেলার বিভিন্ন এলাকা ঘুরে খেজুর গাছ থেকে শীত কালীন রস সংগ্রহ করতে ব্যস্ত সময় পার করতে দেখা গেছে গাছীদের। কিছু কিছু অঞ্চলে গাছীদের গাছ থেকে রস সংগ্রহ করে সেই রস জ্বালিয়ে গুর তৈরী করতেও দেখা গেছে।
উপজেলার মুলাডুলি ইউনিয়নের মালিথা পাড়ায় কর্মরত গাছী মো: মামুন যায়যায়দিনকে বলেন, খেজুর গাছের রস থেকে গুর তৈরীর প্রক্রিয়াটা মূলত শুরু হয় শীতের শুরু থেকেই। প্রথমে খেজুরের প্রতিটি গাছকে তার কান্ডের দিকের শাখা গুলো ছেটে ফেলা হয়। শাখা গুলো ছেটে পরিষ্কার করার পর গাছ গুলোকে কয়েকদিন ওভাবেই রাখতে হয়। এভাবে রাখার কয়েকদিন পর মূলত গাছগুলো রস সংগ্রহের জন্য প্রস্তুত হয়। সেই মোতাবেক গাছ গুলোতে ধারালো একধরনের হেসে দিয়ে বিশেষ কায়দায় চেঁচে সেগুলোতো একটি করে বাঁশের নল এবং মাটির হাঁড়ি ঝোলানোর জন্য দুটি করে খুঁটি গাড়া হয় প্রতিটি কান্ডে। এরপর হাঁড়িতে চুনকাম করে রোদে শুকানোর পর রস সংগ্রহের জন্য প্রস্তুত সেই হাঁড়ি সন্ধ্যা রাতে ঝোলানো হয় প্রতিটি গাছে।
তিনি আরও বলেন, সারারাত হাড়িতে জমা রস গুলো গাছ থেকে সংগ্রহের কাজ শুরুহয় রাত তিনটা থেকে। সংগৃহীত সেই রস পাতলা কাপড়ে ছেকে গুর তৈরীর জন্য বিশেষ ভাবে তৈরী বড় কড়াইতে বসিয়ে দেয়া হয় চুলায় (উনুনে)। এরপর ধীরে ধীরে জ্বাল করতে থাকলে একটা সময় পর তরতরে তরল রসগুলো গারহো আঠালোতে পরিনত হয়। এরপর স্বাদ মোতাবেক সেগুলোকে বিভিন্ন আকারের পাত্রে ঢেলে কয়েক ঘন্টা ঠান্ডা স্থানে রেখে দিলেই গারহো আঠালো তরল জমে পাটালি গুরের শক্ত ঢিমিতে পরিনত হয়। সে অবস্থাতেই সেগুলো বাজার জাত করনের উপযোগী হয়।
সাঁড়া ইউনিয়নের মাঝদিয়ায় কর্মব্যস্ত গাছী মুক্তার আলী যায়যায়দিনকে বলেন, বছরের শীত মৌসুমে আমাদের ব্যস্ততা বেড়ে যায় বহুগুনে। যদিও আমরা এই সময়টাকেই আমাদের উপার্জনের সেরা সময় হিসেবে বিবেচনায় রাখি। কেননা সারা বছরের ঢিলে ঢালা কাজের মধ্যে এসময়টা আমাদের সারা বছরের আহার সঞ্চয়ের প্রধান সময়। তবে অন্যান্য বছরের তুলনায় এবার খরচ বেড়েছে প্রায় দেড় গুন। জ্বালানির দাম, গাছের বর্গা মূল্য সব মিলিয়ে আমাদের এবার দেড় গুন বেশী খরচ হচ্ছে খেজুরের গুর তৈরীতে। তবে উপযুক্ত বাজার আর অনুকূল আবহাওয়া না থাকলে এবার বড় ধরনের ক্ষতির সম্মুথিন হতে হবে।
তিনি আরও বলেন, এবছর শীত শুরু হতেই দেরী হয়েছে। শীত মৌসুমটাই যেহেতু রস আহরণের মূখ্যম সময় তাই শীত ক্ষণস্থায়ী হলে বিড়ম্বনায় পড়েযাব। কেননা পুরো মৌসুমে শুধু জ্বালানিই প্রয়োজন হয় প্রায় ২ লাখ টাকার। এরপর যে স্থানে থাকি সে স্থানে অস্থায়ী ঘর তৈরী এবং জায়গা ভাড়া। গাছের মালিকদের গাছপ্রতি একটা নির্দিষ্ট অংকের টাকা প্রদানসহ নানা বিদ খরচ মিলিয়ে একটা বড় ধরনের ব্যয় হয় খেজুর গুড় সংগ্রহে। যেটা মৌসুম সীমিত হলে আমাদের (গাছীদের) বড় ক্ষতি হয়ে যাবে।
মাঝদিয়া এলাকার প্রবীন ব্যক্তিত্ব হোসেন শাহ বলেন, খেজুর কাঠের দাম না থাকায় গ্রামে এখন আর কেউ এ গাছ রোপন করে না উপরোন্ত দিনকে দিন কেটে উজার করছে। তবে এভাবে খেজুর গাছ কাটতে থাকলে নিকট ভবিষৎএ খেজুর রস ও গুরের স্বাদই আমরা ভুলে যাব।
যাযাদি/এআর