শুক্রবার, ১৫ নভেম্বর ২০২৪, ২৯ কার্তিক ১৪৩১

ঘাটাইলে বিলুপ্তির মুখে প্রাকৃতিক বন, হুমকিতে জীববৈচিত্র্য

উত্তম কুমার আর্য্য, ঘাটাইল (টাঙ্গাইল) থেকে
  ১৪ নভেম্বর ২০২৪, ১৩:৩০
আপডেট  : ১৪ নভেম্বর ২০২৪, ১৩:৩২
ছবি: যায়যায়দিন

নানা কারণেই টাঙ্গাইলের প্রসিদ্ধি রয়েছে। তার মধ্যে আমাদের পূর্বাঞ্চলের পাহাড়ী এলাকা। যেখানে সেগুন, গজারী সহ বিভিন্ন প্রজাতির গাছ ছিলো। সেখানে ছিলো মানুষের রোগ নিরাময়ের জন্য ঔষধি গাছ। কালের বিবর্তনে কিছু অসাধু ব্যক্তির থাবায় আজ সেগুলো হুমকিতে মুখে। একসময় শাল-গজারিসহ নানা প্রজাতির দেশীয় গাছে আচ্ছাদিত ছিল টাঙ্গাইলের ঘাটাইল উপজেলার বনাঞ্চল।

স্থানীয়দের অভিযোগ, সামাজিক বনায়নের নামে কৃত্রিম বনায়ন সৃষ্টি করে ধ্বংস করা হয়েছে সেই প্রাকৃতিক বন।ফলে প্রচলিত প্রবাদ এখন ম্লান হয়ে যাচ্ছে। গজারি বন থেকে দেশীয় অন্যান্য গাছের পাশাপাশি শাল-গজারিও বিলুপ্তির পথে। সেই সাথে বনে বাস করা বিভিন্ন প্রজাতির বন্য প্রাণীও বিলুপ্তপ্রায়।

পরিবেশবিদদের দাবি, প্রাকৃতিক বন ধ্বংস করে কৃত্রিম বনায়ন করা হলে পরিবেশ তার ভারসাম্য হারাবে। ঘাটাইলের বনাঞ্চল শাল-গজারির বন হিসেবে খ্যাত মধুপুর গড় এলাকার একটি অংশ। প্রাকৃতিকভাবে গড়ে ওঠা এ বনে শাল-গজারির পাশাপাশি ছিল আমলকি, হরিতকি, বহেড়া, অর্জুন, তিতিজাম, আজয়, আনাইগোটা, খেজুর, বট, শিমুল, ছাগলনাদি, চুকাইগোটা, জয়নাগোটা, পিতরাজ, শাল, গর্জন, সোনালু লটকন, নাগেশ্বর, বন আমড়া, খাড়াজোড়া, গামার, নেওড়, কানাইডাঙ্গা, জলপাই, কদমসহ নানা প্রজাতির গাছ। বনে দেখা মিলত মেছোবাঘ, বাগডাশ, বুনো শূকর, হাতি, বানর, সজারুসহ বিভিন্ন প্রজাতির প্রাণী। এছাড়াও প্রায় অর্ধশত প্রজাতির পাখির কিচিরমিচির শব্দে মুখর থাকতো বন।

এখন পুরো বন ঘুরেও দেখা মিলবে না প্রাকৃতিকভাবে বেড়ে ওঠা কোনো প্রাচীন গাছ। বানর, হাতি দূরের কথা, দেখা মিলবে না বাগডাশের। শেয়ালের হাঁকও মেলে কালেভদ্রে। স্থানীয়দের দাবি, প্রাকৃতিক বন ধ্বংস করে সামাজিক বনায়নের নামে কৃত্রিম বনায়ন করে পশু-পাখির অভয়ারণ্য ধ্বংস করাই এজন্য দায়ী।

বনবিভাগ সূত্রে জানা যায়, ঘাটাইল উপজেলায় বনভূমির পরিমাণ ২৫ হাজার ৭১১ একর। তিন দশক আগেও এই বনাঞ্চলটি ছিল শাল-গজারিসহ বিভিন্ন প্রজাতির প্রাকৃতিক গাছপালায় ঘেরা ঘন জঙ্গল। ১৯৮৪ সালের দিকে এ অঞ্চলে সামাজিক বনায়ন কর্মসূচি শুরু হয়, যা এখনো চলছে। এ বছরও ঘাটাইল বন বিভাগের আওতায় ৯৩ একর জমিতে সামাজিক বনায়ন করা হয়েছে।

সামাজিক বনায়ন হওয়ায় পর থেকেই শুরু হয় প্রাকৃতিক বন ধ্বংসের কার্যক্রম। বনের আগাছা নিধনের নামে শুরু হয় বনের বিভিন্ন প্রজাতির প্রাকৃতিক গাছ কাটা। দেশীয় বৃক্ষের স্থানে লাগানো হয় আকাশমনি, সেগুন, মেহগনি, ইউক্যালিপটাসসহ নানা জাতের বিদেশি গাছ।

সেই থেকেই কমতে শুরু করে শাল-গজারিসহ প্রাকৃতিক বনের গাছ। সামাজিক বনায়নের সুযোগ ব্যবহার করে শাল-গজারি গাছ নিধন শুরু করে একটি চক্র।

বাসাবাইদ গ্রামের কৃষক জামাল বলেন, ‘কৃত্রিম বনের গাছের নিচে লতাপাতা জাতীয় কোনো গাছ জন্মায় না। ফল না থাকায় গাছে কোনো পশু-পাখিও বসতে চায় না। আকাশমনি ও ইউক্যালিপটাস গাছের নিচে ঘাস পর্যন্ত জন্মায় না।

বনের অধিবাসীরা জানান, সামাজিক বনায়নের কারণে প্রাকৃতিক বনের অন্যান্য গাছের সাথে বিলুপ্তির পথে সংরক্ষিত বনের শাল-গজারি গাছ। বনের কিছু কিছু অংশে এখনো শাল-গজারি দেখা গেলেও আগামী ১৫-২০ বছর পর বিলুপ্ত হতে পারে শাল-গজারি গাছ। শুধু বৃক্ষই নয়, বন থেকে হারিয়ে গেছে নানা ধরনের বন্যপ্রাণী ও বিভিন্ন প্রজাতির পশুপাখি।

গারোবাজার এলাকার মোতালেব হোসেন বলেন, ‘প্রাকৃতিক বনের বৃক্ষের সাথে ছিল বিভিন্ন প্রজাতির প্রাণীর। তিন যুগ আগেও বন্যপ্রাণীর ছোটাছুটি আর পাখির কলকাকলিতে মুখর ছিল এ বনাঞ্চল।’

তার মতে, বন বিভাগের সামাজিক বনায়ন কার্যক্রম শুরুর হওয়ার পর থেকেই বিলুপ্ত হওয়া শুরু করে বিভিন্ন প্রজাতির পাখি ও প্রাণীর। তাদের বাসস্থান নিরাপদ না হওয়ায় খাদ্য সংকট দেখা দেয় এবং বনের জমি দখল করে বসতি স্থাপন করায় এ অবস্থার সৃষ্টি হয়েছে।

বনে আবাসস্থল না থাকায় লোকালয়ে আসতে বাধ্য হচ্ছে বিভিন্ন প্রজাতির প্রাণী। যার কারণে বনের অধিবাসীদের হাতে হত্যার শিকার হচ্ছে বিরল প্রজাতির অনেক প্রাণী।

চাম্বলতলা গ্রামের কৃষক মানিক মিয়া জানান, এখন বনে দেশীয় প্রজাতির গাছ খুঁজে পাওয়া কষ্টকর। বিভিন্ন প্রজাতির পাখি ফসলি জমির ক্ষতিকর পোকা খেয়ে উপকার করে। বিদেশি গাছের কারণে পাখি কমে যাওয়ায় ফসলের জমিতে তেমন পাখি বসে না। তাই পোকা দমনে ক্ষতিকর কীটনাশকের ওপর নির্ভর করে কৃষকরা।

বন এলাকার বাসিন্দা কলেজ শিক্ষক রফিকুল ইসলাম বলেন, ‘সামাজিক বনায়নের সিদ্ধান্তটি সরকারের ভুল সিদ্ধান্ত ছিল। এ প্রকল্পের মাধ্যমে বন সংরক্ষণের পরিবর্তে প্রাকৃতিক বনকে বিনাশ করা হয়েছে। বিলুপ্ত হতে চলেছে বন্যপ্রাণী ও নানা প্রজাতির পশুপাখি। বনকে সৃজন নয়, বনকে বনের মতো বেড়ে উঠতে দেওয়া উচিৎ।’

বাংলাদেশ পরিবেশ আইনজীবী সমিতির (বেলা) বিভাগীয় সমন্বয়কারী গৌতম চন্দ্র চন্দ বলেন, ‘দেশীয় প্রজাতির গাছ পরিবেশের জন্য খুবই গুরুত্বপূর্ণ। এভাবে চলতে থাকলে একদিন শাল-গজারিসহ দেশীয় প্রজাতির গাছ বিলুপ্ত হয়ে যাবে। তাই প্রাকৃতিকভাবে গজানো শাল-গজারি গাছগুলো কীভাবে সংরক্ষণ করা যায় সেই পরিকল্পনা করা উচিৎ। সাথে সাথে দেশীয় প্রজাতির গাছ রক্ষার জন্য পদক্ষেপ নেওয়া দরকার।’

এলাকাবাসী বলছেন, বনে শাল-গাজারি গাছ ফিরিয়ে আনার দাবি জানিয়েছেন। এ বিষয়ে বন বিভাগের ধলাপাড়া রেঞ্জের কর্মকর্তা ওয়াদুদুর রহমান বলেন, ‘সামাজিক বনায়নের কারণে প্রাকৃতিক বনের কোনো ক্ষতি হয় না। বন বিভাগের পতিত জমিতেই সামাজিক বনায়ন করা হয়। এতে শাল বনেরও ক্ষতি হয় না।’

যাযাদি/ এসএম

  • সর্বশেষ
  • জনপ্রিয়

উপরে