দেখতে যেমন সুন্দর, খেতে তার চেয়ে বেশি সুস্বাদু। খুব সহজেই গ্রামের নারীরা তৈরি করে থাকেন। প্রায় প্রতিটি সবজি বা মাছ রান্নায় দিলে বেড়ে যায় স্বাদ। বলা হচ্ছে কুমড়ো বড়ির কথা।শীতের শুরুতেই এ বড়ি তৈরি শুরু করেন সারিয়াকান্দি উপজেলার বিভিন্ন পাড়া মহল্লার নারীরা। বাণিজ্যিকভাবে বড়ি বিক্রি করেও অনেকে সংসারে আনেন স্বচ্ছলতা।
কুমড়ো বড়ি তৈরির একমাত্র প্রধান উপাদান হলো মাসকলাই ডাল। বড়ি বানানোর সহজ কোনো বিষয় নয়। এখানে একাধিক ধাপ রয়েছে। প্রথমে মাসকালাই যাতায় পিষে অর্ধেক করতে হয়। খোষা ছাড়ানোর জন্য সন্ধ্যায় সারা রাতের জন্য জলে ভিজে রাখতে হয়। ভোরে ভিজানো কালাই থেকে খোষা ছাড়িয়ে শিলপাটায় পিষে খামির তৈরি করতে হয়। এটা একটি সহজ পদ্ধতি।
আরেকটি বিশেষ পদ্ধতিতে কুমড়ো বড়ি তৈর করা হয় এটি একটু বেশি পরিশ্রম করতে হয় বলে এটা সাধারণ নিজেরা খাওয়ার জন্য বানানো হয়।অথবা কেউ অগ্রিম টাকা দিয়ে বানিয়ে দিতে বললে তাদেরকে বানিয়ে দেওয়া হয়। এই বিশেষ পদ্ধতিতে লাগে মাসকলাই ও গাছপাকা সাদা বর্ণের চালকুমড়া কুচি কুচি করে কাটতে হয়, অনেকে কুড়ে কুড়েও তোলেন।তারপরে কলাইয়ের ডাল ভিজিয়ে সেটা বেটে, চালকুমড়া আর কলায়ের ডাল একসঙ্গে অনেকক্ষণ ধরে ভালো করে মথে (মাখা) বাঁশের চাটাইয়ের ওপরে ছোট ছোট করে বড়ি বিছিয়ে দেওয়া হয়। তারপর দুই-তিন দিন ভালো করে রোদে শুকালেই খাওয়ার উপযোগী হয়ে যায় সুস্বাদু কুমড়ো বড়ি। শীতের আভাস আসার সঙ্গে সঙ্গে গ্রামের নারীরা বড়ি তৈরি করে থাকেন। সেটা পুরো শীতকাল জুড়েই বিভিন্ন সবজির সঙ্গে রান্না করে খাওয়া হয়।
পৌরসভার সাহাপাড়া গ্রামের ২ ও ৭ নং ওয়ার্ডের বনিতা সাহা, সাথি সাহা, শ্যামলি দেবনাথ, ডলি সাহা, অর্না সাহা, সাধনা সূত্রধর রেবা সাহা, শংকরি রানী, মুনজুরী , গীতা রানী ও নিহার রানী সাহা সঙ্গে কথা বলে জানা যায় , বাংলা সনের কার্তিক মাস থেকে ফাল্গুন মাস পর্যন্ত এ কুমড়ো বড়ির চাহিদা বেশি থাকে। পূর্বের ন্যায় এবারও আগাম অক্টোবর মাস থেকে বড়ি তৈরি শুরু হয়েছে। চলবে মার্চ মাস পর্যন্ত। গত বছরে অক্টোবরে মাসকালাই এর ডাল প্রতি কেজি ১৩০ টাকা দাম ছিল। এ বছর এ ডাল ১৪০ টাকা থেকে ১৪৫ টাকা কেজি কিনতে হচ্ছে।
গত বছর সাধারণ মানের কুমড়ো বড়ি ১৫০ টাকা এবং ভালো মানেরটা ৪০০ টাকা কেজি দরে বিক্রি হয়েছিল । এবার সাধারণ মানের কুমড়ো বড়ি ২০০ টাকা এবং ভালো মানের বড়ি ৪৫০ টাকা কেজি দরে বিক্রি হচ্ছে।একেক জন কারিগর দিনে ১২'শত টাকা থেকে ১৫'শত টাকা পর্যন্ত কুমড়ো বড়ি বিক্রি করে থাকেন।শীত মৌসুমে এ এলাকায় প্রায় ১২ থেকে ১৪ লক্ষ টাকার কুমড়ো বড়ি বেচা-কেনা হয়ে থাকে। এই কুমড়ো বড়ি তৈরি করে পরিবারের নারী সদস্যরা, আর পুরুষরা হাঁট-বাজারে বিক্রি করে ।
সরেজমিনে গিয়ে দেখা যায়, কুমড়ো বড়ি তৈরিতে ব্যস্ত সময় পার করছেন পৌর এলাকার সাহাপাড়ার নারীরা।পরে পাইকারী বিক্রিসহ স্থানীয় হাট-বাজারে খুচরা বিক্রি করেন কারিগররা।কুমড়ো বড়ির কারিগররা জানা যায়,
আমাদের গ্রামের হিন্দু সম্প্রদায়ের প্রায় অধিকাংশ মানুষেরই তেমন কোনো জমি-জমা নেই। শীতের এ মৌসুমে কুমড়ো বড়ি বিক্রি বেশি হয়। ধারাবাহিকভাবে আমি ও আমার পরিবারের লোকজন সংসারের অন্যান্য কাজের পাশাপাশি এ কুমড়ো বড়ি তৈরির করছি ।
এ বছর উপকরণের দাম বেড়ে যাওয়ায় হাটবাজারে কুমড়ো বড়ি বিক্রি করতে গিয়ে ক্রেতাদের সঙ্গে দর কষাকষি করতে হচ্ছে। অনেকেই দেশ-বিদেশে স্বজনদের কাছে পাঠিয়ে থাকেন হাতে তৈরি এ বড়ি। আবহাওয়া ভালো না হলে কুমড়া বড়ি তৈরিতে ধস নামে। তখন বড়ি প্রস্তুত করতে অনেক সময় লাগে। বড়ি নষ্ট হয়ে যায়।
তারা আরও জানান, বাজারে কলাইয়ের দাম বেশি এবং হাড়ভাঙা পরিশ্রমে কুমড়ো বড়ি তৈরি করে বিক্রির পর এখন আর আগের মতো তেমন একটা লাভ হয় না। সরকারি সহজ শর্তে ঋণ পেলে আমরা আরও বেশি কুমড়ো বড়ি তৈরি করতে পারবো এবং আরও বেশি উন্নতমানের কুমড়ো বড়ি তৈরি করতে পারবো।
সারিয়াকান্দি উপজেলার পৌর এলাকার ডলি সাহা বলেন,প্রতি বছরের মতো এবারও তিনি কুমড়ো বড়ি তৈরি করেছেন।
শীত আসলেই শীতের জন্য আমরা মজাদার চালকুমড়ার বড়ি তৈরি করি। শীতকালীন সবজির সঙ্গে এ বড়ি রান্না করলে পরিবারের সবাই খুব পছন্দ করে। আলু, বেগুন মাছ আর পালং শাকের সঙ্গে কুমড়ো বড়ি খেতে খুব ভালো লাগে। যারা বাড়িতে বড়ি তৈরি করেন না, তারা শীতে বাজার থেকে এসব বড়ি কিনে থাকেন। স্থানীয় বাজারে এর চাহিদা বেশি থাকায় দামও বেশ ভালো।
মৌসুমি কুমড়ো বড়ি ব্যবসায়ী সারিয়াকান্দি বাজারের রুবেল জানান, শীতকালে এ কুমড়ো বড়ি বিক্রি বেশি হয়। তাই বাড়িতে এসব বড়ি তৈরি করে বাজারে বিক্রি করি। এখন প্রতিদিন আমি ১৫-২০ কেজি কুমড়ো বড়ি বিক্রি করি। সাদা বড়ির চাহিদা বেশি। ২০০-২৫০ টাকা কেজি দরে এসব বড়ি বিক্রি করি। এভাবে পুরো শীত মৌসুম চলে বড়ি বিক্রি। ভালো মানের কুমড়ো বড়ি কিনতে চাইলে ৪০০-৫০০ টাকা কেজি পড়বে দাম।
সারিয়াকান্দি উপজেলা কৃষি কর্মকর্তা জানান, কুমড়ো বড়ির তৈরীর প্রধান উপকরণ হলো মাসকলাইয়ের ডাল। এই উপজেলার প্রতিবছর অনেক জমিতে এই ডাল চাষ করেন কৃষকেরা। এবার অনেক জমিতে ডালের চাষ হয়েছে। এছাড়া চাল কুমড়া ও ডালের মিশিয়ে যে কুমোড় বড়ি তৈরী করা হয় এই চাল কুমড়া কৃষকরা যথেষ্ট পরিমান আবাদ করেন।
যাযাদি/ এসএম