মামলা করেও বন্ধ হচ্ছেনা পাহাড় কাটা, নবীগঞ্জে রাতভর চলছে পাহাড় কাটার মহোৎসব

প্রকাশ | ০৫ নভেম্বর ২০২৪, ১৬:২১

নবীগঞ্জ (হবিগঞ্জ) প্রতিনিধি
ছবি: যায়যায়দিন

সরকার পতনের পর হবিগঞ্জের নবীগঞ্জ উপজেলার পাহাড়ি অঞ্চল খ্যাত দিনারপুর পরগণায় চলছে পাহাড় কাটার মহোৎসব। পাহাড়ের লাল মাটি উচ্চদামে বিক্রি করা হচ্ছে বিভিন্নস্থানে। অন্যদিকে ঝুঁকি বাড়ছে পাহাড়ের পাদদেশে বসবাসকারীদের। প্রশাসনের নজর এড়াতে রাতভর কাটা হচ্ছে পাহাড়। সম্প্রতি পাহাড় কাটা নিয়ে সংবাদ প্রকাশের পর মামলা দায়ের করে পরিবেশ অধিদপ্তর। কিন্তু মামলা দায়েরের পরও পুনরায় একই অপরাধে জড়াচ্ছেন আসামীরা ফলে থামছেনা পাহাড় কাটা। জড়িতদের গ্রেফতার করতে না পারা ও দায়সারা মামলার কারণে বন্ধ করা যাচ্ছেনা পাহাড় নিধন এমনটাই মনে করছেন পরিবেশবিদেরা।

সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা গেছে, নবীগঞ্জ উপজেলার দেবপাড়া, গজনাইপুর ও পানিউমদা ইউনিয়ন নিয়ে গঠিত দিনারপুর পরগনা। এটি জেলার পাহাড়ি অঞ্চল হিসেবে পরিচিত। ২০১৫ সালে হিউম্যান রাইটস অ্যান্ড পিস ফর বাংলাদেশ নামে একটি পরিবেশবাদী সংগঠন দিনারপুর এলাকার টিলা ও পাহাড় না কাটার জন্য হাইকোর্টে রিট দায়ের করে। এ ব্যাপারে হাইকোর্ট স্থিতাবস্থা দিয়ে রুল জারি করেন। রুল শুনানি শেষে চূড়ান্ত রায়ে নবীগঞ্জের দিনারপুরে পাহাড় ও টিলা কাটা রোধে প্রশাসনের নিষ্ক্রিয়তাকে অবৈধ ঘোষণা করেন হাইকোর্ট। এ ছাড়া তৎকালীন হবিগঞ্জের জেলা প্রশাসক, পুলিশ সুপারকে পাহাড় ও টিলা সংরক্ষণে যথাযথ ব্যবস্থা নিতে নির্দেশ দেওয়া হয়। কিন্তু উচ্চ আদালতের নির্দেশনা উপেক্ষা করে বছরের অধিকাংশ সময়জুড়ে দিনারপুর এলাকার বিভিন্ন স্থানে পাহাড় কেটে মাটির রমরমা ব্যবসা করছে একটি অসাধু চক্র।

চলতি বছরের (১২ সেপ্টেম্বর) রাত থেকে গজনাইপুর ইউনিয়নের কান্দিগাঁও গ্রামের একটি বৃহৎ পাহাড় কাটা ওই গ্রামের গেদু মিয়ার ছেলে রাজু মিয়ার তত্বাবধানে স্থানীয় সঙ্ঘবদ্ধ চক্র এই পাহাড় থেকে এক্সভেটর (ভেকু) মেশিন সাহায্যে মাটি কাটে। পরে ট্রাকভর্তি করে মাটি বিক্রি করে ভরাট করা হয় পাশ্ববর্তী সোনা মিয়া, আব্দুর নূর, আব্দুল গফুরের মালিকানাধীন জায়গা। এনিয়ে বিভিন্ন স্থানীয় ও জাতীয় পত্রিকায় সংবাদ প্রকাশিত হয়। সংবাদ প্রকাশের পর (১৮ সেপ্টেম্বর) হবিগঞ্জ পরিবেশ অধিদপ্তরের ইন্সপেক্টর শ্রী হরিপদ চন্দ্র দাস বাদী হয়ে পাহাড় কাটায় জড়িত গজনাইপুর ইউনিয়নের কান্দিগাঁও গ্রামের মৃত গেদু মিয়ার ছেলে রাজু মিয়া (৫০), বনগাঁও গ্রামের মৃত নওয়াব উল্লার ছেলে আব্দুর নূর (৫০), সোনা মিয়া (৬০), আব্দুল গফুর (৪৮)কে আসামী করে মামলা নং-১৫ দায়ের করা হয়। কিন্তু মামলা দায়েরের পর আরও বেপরোয়া হয়ে উঠেছে পাহাড় কাটায় জড়িত রাজু।

গত ১ নভেম্বর শুক্রবার থেকে গজনাইপুর ইউনিয়নের কান্দিগাঁও গ্রামের একইস্থান থেকে এক্সভেটর (ভেকু) মেশিন সাহায্যে পাহাড় কাটছেন মামলার প্রধান আসামী গেদু মিয়ার ছেলে রাজু মিয়া। রাত ১১টার থেকে শুরু হয় পাহাড় কাটা। আশপাশের মানুষ এক্সভেটর (ভেকু) মেশিনের ও মাটি বুঝাই ট্রাকের শব্দে আতঙ্কে রয়েছেন। পাহাড় কাটার ফলে আশপাশের বাড়ি-ঘর ঝুকিপূর্ণ অবস্থায় রয়েছে। মাটি বুঝাই ট্রাক চলাচলের কারণে রাস্তাঘাট বেহাল অবস্থায় পরিণত হয়েছে। সাবেক সংসদ সদস্য আবু জাহিরের ঘনিষ্ট ও উপজেলা আওয়ামী লীগের সাবেক এক প্রভাবশালী সভাপতির প্রভাবে রাজু মিয়া বেপরোয়া হয়ে উঠেছে বলে অভিযোগ স্থানীয়দের। রাজুর দাপটে কেউ ভয়ে কথা বলতে পারেননা। পাহাড় কেটে মাটি গজনাইপুর এলাকাসহ বিভিন্নস্থানে সরবারহ করছে এই চক্রটি।

নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক এক ব্যক্তি জানান- প্রতিদিন রাতে পাহাড় কাটার মেশিনের বিকট আকারে শব্দ হয়, ট্রাক চলাচলেও শব্দ হয় এতে আমরা ঘুমাতে পারিনা, প্রতিবাদ করলে নানা হুমকি-ধামকি দেয়া হয়, রাজু পুলিশ-প্রশাসনকে ম্যানেজ করেই পাহাড় কাটছে বলে এলাকায় বলে বেড়াচ্ছে।

স্থানীয় এক মুরুব্বি জানান- পাহাড় কাটার মেশিনের শব্দে রাত হলে ঘুম আসেনা, আমি হৃদরোগের রোগী, প্রতিনিয়ত মনে হয় মেশিনের শব্দে এই বুঝি বুকে সমস্যা হলো। তিনি বলেন- আমাদের এলাকার উপজেলা আওয়ামী লীগের সাবেক এক প্রভাবশালী সভাপতির প্রভাবেই রাজু  মামলা দায়েরের পরও পাহাড় কেটে যাচ্ছে ।

এ ব্যাপারে অভিযুক্ত রাজু মিয়ার সঙ্গে যোগাযোগ করা হলে তিনি পাহাড় কাটার কোনো সরকারি অনুমতি না নিয়েই পাহাড় কাটছেন বলে স্বীকার করেন।

বাংলাদেশ পরিবেশ আন্দোলনের (বাপা) হবিগঞ্জ শাখার সাধারণ সম্পাদক ও কেন্দ্রীয় নির্বাহী সদস্য তোফাজ্জল সোহেল বলেন, হবিগঞ্জের টিলা - পাহাড় অঞ্চল হিসেবে দিনারপুর এলাকার পরিচিত রয়েছে। কিন্তু এই এলাকায় পাহাড় টিলা কাটা হচ্ছে ক্রমাগত। একইস্থানে বার বার পাহাড় কাটা হচ্ছে বিষয়টি খুবই দুঃখজনক। বিভিন্নস্থানে পাহাড় কাটা হলে আমরা কথা বললে কিংবা গণমাধ্যমে সংবাদ প্রকাশিত হলে মাঝেমধ্যে পরিবেশ অধিদপ্তর এর পক্ষ থেকে মামলা করা হয়। পাহাড় - টিলা কেটে পরিবেশ প্রতিবেশ ধ্বংসকারী, জড়িতদের বিরুদ্ধে কঠোর আইন রয়েছে। কিন্তু দায়ীদের বিরুদ্ধে যথাযথ আইন প্রয়োগ, শাস্তি মূলক ব্যবস্থা গ্রহণ করা হয়না। ফলে জড়িতরা একই বার-বার পাহাড় টিলা কেটে চলেছে। পাহাড় খেকোদের বিরুদ্ধে মামলা দায়েরসহ দৃষ্টান্তমূলক শাস্তির ব্যবস্থা গ্রহণ করা হয়না বলেই অব্যাহতভাবে পাহাড় কেটে যাচ্ছে। জড়িতদের দ্রুত আইনের আওতায় এনে জেল জরিমানাসহ দৃষ্টান্তমূলক শাস্তির ব্যবস্থা গ্রহণ করা হলে পাহাড় কাটা কমে আসবে এবং রক্ষা পাবে আমাদের প্রাণ - প্রকৃতি ও পরিবেশ।

হবিগঞ্জ জেলা পরিবেশ অধিদপ্তরের পরিদর্শক মো. গোলাম সামদানী বলেন- কান্দিগাঁও গ্রামের পাহাড় কাটার ঘটনায় যে মামলা আমি তদন্ত করছি ওইস্থানেই পাহাড় কাটা হচ্ছে বিষয়টি অবগত হয়েছি, অফিসে কথা বলে দেখছি কি করা যায়।

পরিবেশ অধিদপ্তর সিলেট বিভাগীয় কার্যালয়ের পরিচালক মোঃ ফেরদৌস আনোয়ার বলেন- পাহাড় কাটার বিষয়গুলো আমরা গুরুত্বসহকারে দেখছি, পাহাড় কাটার ঘটনায় মামলা দায়েরের পরও যদি আসামীরা  পুনরায় পাহাড় কাটায় সম্পৃক্ত থাকে অবশ্যই আলাদাভাবে পুনরায় মামলা হবে এবং প্রয়োজনীয় আইনানুগ ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে।

 

যাযাদি/এসএস