শুক্রবার, ০১ নভেম্বর ২০২৪, ১৬ কার্তিক ১৪৩১

মুন্সীগঞ্জে সাবেক দুই সংসদ সদস্যসহ ১৪২ জনের নামে হত্যাচেষ্টা মামলা

মুন্সীগঞ্জ প্রতিনিধি
  ০১ নভেম্বর ২০২৪, ২০:১৯
ছবি : যায়যায়দিন

মুন্সীগঞ্জে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র-জনতার আন্দোলনে গুলিবিদ্ধ হয়ে মো.মঞ্জিল মোল্লা নামে এক বিএনপি কর্মী আহত হওয়ার ঘটনায় মুন্সীগঞ্জ-১ ও মুন্সীগঞ্জ-৩ আসনের সাবেক দুই সংসদ সদস্যসহ ১৪২ জনের বিরুদ্ধে হত্যাচেষ্টার অভিযোগে একটি মামলা হয়েছে।

মামলায় অজ্ঞাতপরিচয় আসামি করা হয়েছে আওয়ামী লীগ ও এর অঙ্গ সংগঠনের আরও ১০০-১৫০ জন নেতা-কর্মীকে।

বৃহস্পতিবার (৩১ অক্টোবর) রাত ১২ টার পরে আহত মঞ্জিল বাদি হয়ে অভিযোগ দাখিল করলে, আজ শুক্রবার (১ নভেম্বর) সকাল আটটার দিকে মুন্সীগঞ্জ সদর থানায় অভিযোগটি মামলা হিসেবে অন্তর্ভুক্ত করা হয়।

মামলার বিষয়টি নিশ্চিত করেছেন মুন্সীগঞ্জ সদর থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) মো. খলিলুর রহমান।

তিনি জানান, গুলিবিদ্ধ আহত মঞ্জিল মোল্লা মুন্সীগঞ্জ-১ আসনের সাবেক সংসদ সদস্য মো.মহিউদ্দিন আহমেদ, মুন্সীগঞ্জ -৩ আসনের সংসদ সদস্য মোহাম্মদ ফয়সালসহ ১৪২ জনের নাম উল্লেখ করে অভিযোগ দাখিল করেছিলেন। শুক্রবার সকালে সেই অভিযোগটি মামলা হিসেবে অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে।

আহত মঞ্জিল মোল্লা (৫৩) মুন্সীগঞ্জ শহরের উত্তর ইসলামপুর এলাকার ইব্রাহীম মোল্লার ছেলে। তিনি পেশায় একজন দিন মজুর এবং বিএনপির রাজনীতির সঙ্গে সম্পৃক্ত।

আন্দোলনে গিয়ে ঝাঝড়া খাদ্যনালী, বন্ধ হয়ে গেছে স্বাভাবিক পায়খানার রাস্তা। ৪ আগস্ট মুন্সীগঞ্জের সুপারমার্কেটে পিঠ, হাত ও পেটে গুলিবিদ্ধ হন মঞ্জিল মোল্লা। বর্তমানে তার দিন কাটছে নিদারুণ কষ্টে।

একদিকে ১০ সদস্যের পরিবার নিয়ে হিমশিম, অন্যদিকে পরবর্তী চিকিৎসা ব্যায় নিয়ে রয়েছেন দুশ্চিন্তায়। দুই দফা অপারেশনে প্রাণ বাঁচলেও অর্থ সংকটে বন্ধ পরবর্তী চিকিৎসা। পূর্ণাঙ্গ ব্যায় বহন ও পুনর্বাসনের দাবি জানিয়েছেন স্বজন ও স্থানীয়রা।

জানা গেছে, গত ৪ আগস্ট মুন্সীগঞ্জ শহরের সুপারমার্কেটে এক দফা দাবিতে বিক্ষোভ কর্মসূচির ডাক দেয় বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন। খবর পেয়ে প্রতিহতের ঘোষণা দেয় মুন্সীগঞ্জ ৩ আসনের সাবেক সংসদ সদস্য ফয়সাল বিপ্লব ও তার অনুসারী আওয়ামী লীগ- ছাত্রলীগের নেতাকর্মীরা। পুলিশও কঠোর অবস্থান নেয় আন্দোলনকারীদের বিরুদ্ধে।

সকালের দিকে শিক্ষার্থীরা শহরের সুপারমার্কেট সংলগ্ন পাতাল মার্কেটের সামনে এলে তাদের উপর চড়াও হন ফয়সাল বিপ্লব অনুসারীরা। এসময় লাঠিপেটা ও ককটেল নিক্ষেপের ঘটনা ঘটে। এ খবর ছড়িয়ে পড়লে শহরের কৃষি ব্যাংক এলাকা ও উত্তর ইসলামপুর থেকে শত শত আন্দোলনকারী বেড়িয়ে পড়েন। তারা আওয়ামী লীগ-ছাত্রলীগ নেতাকর্মীদের লক্ষ্য করে ইটপাটকেল নিক্ষেপ করতে করতে শহরের মূল কেন্দ্র অঙ্কুরিত যুদ্ধ ১৯৭১ ভাস্কর্যের সামনে পর্যন্ত এলে চরকেওয়ার, আধারা, মোল্লাকান্দি, শিলই থেকে আসা শত শত আওয়ামী লীগ-ছাত্রলীগ নেতাকর্মীরা পিস্তল-রাইফেল, শর্টগান, হাতে বানানো অস্ত্র নিয়ে এলোপাথাড়ি গুলি ছুড়তে থাকে।

সেসময় আহত মঞ্জিলের ডান হাতে গুলি লাগলে তার হাতে থাকা ইটের সুড়কি পড়ে গিয়ে হাড় ফেটে বের হয়ে যায় সেটি। দ্বিতীয় গুলি লাগে পিঠে। এরপর তৃতীয় দফায় পেটে গুলিবিদ্ধ হয়ে অবস্থা গুরুতর হলে মাটিতে লুটে পড়ে যান তিনি।

ওইদিন গুলিতে মারা যান মুন্সিগঞ্জ পৌরসভার উত্তর ইসলামপুরের সজল মোল্লা (৩১), রিয়াজুল ফরাজী (৩৮) ও নুর মোহাম্মদ ওরফে ডিপজল (২২)।

আন্দোলনকারীদের মধ্যে কয়েকজন মঞ্জিলকে মুন্সীগঞ্জ জেনারেল হাসপাতালে নিয়ে গেলে সেখান থেকে নেয়া হয় ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে। পিঠের গুলি সহসা বের হলেও খাদ্যনালীতে আটকে যাওয়া গুলি নিয়ে বেগ পেতে হয় চিকিৎসকদের। পরবর্তীতে বিডিআর হাসপাতালে খাদ্যনালীর ৪টি নাড় কেটে গুলি বের করলেও জায়গাটি শুকানোর জন্য স্বাভাবিক রাস্তা দিয়ে পায়খানা বন্ধ রেখে পেটের সাইড দিয়ে কেটে ব্যাগ বসিয়ে দিয়েছেন চিকিৎসকরা। দেড় মাস চিকিৎসার পর বাড়ি ফিরেছেন উত্তর ইসলামপুরের মঞ্জিল মোল্লা। পরবর্তী অপারেশন হলে তার স্বাভাবিক অবস্থায় ফিরে যাওয়ার কথা।

তবে, অর্থ সংকটে পূর্ণাঙ্গ চিকিৎসা নিয়ে দুশ্চিন্তায় আছেন স্বজনরা। অন্যদিকে, ১০ সদস্যের সংসারের একমাত্র উপার্জনক্ষম ব্যক্তিটি অসুস্থ থাকায় উভয় সংকটে রয়েছে পরিবারটি।

আহত মঞ্জিল মোল্লা বলেন,‘আন্দোলনে একাত্মতা ঘোষণা করে আমিও অংশ নিয়েছিলাম। কিন্তু সেখানে যাওয়ার কিছুক্ষণ পরই আমার শরীরে ৩টি গুলি লাগে। এরপর আমি জ্ঞান হারিয়ে ফেলি। লোকজন আমাকে উদ্ধার করে হাসপাতালে নিয়ে যায়। কোনমতে আমার প্রাণটা বেঁচে গেছে। যে আওয়ামী লীগ-ছাত্রলীগ নেতাকর্মীরা প্রকাশ্যে আমার উপর গুলি ছুড়েছে আমি তাদের বিচার চাই।’

আহত মঞ্জিল মোল্লার বড় মেয়ে রুপা আক্তার বলেন,‘আমার বাবার পরবর্তী অপারেশনের জন্য ২-৩ লাখ টাকা প্রয়োজন। এই ব্যায় মিটানো আমাদের পক্ষে সম্ভব না। সরকারিভাবে বহন করা হবে কি না তারও কোন নিশ্চয়তা পাচ্ছি না। আমার এক ভাই বিবাহিত, সেও বেকার। আমাদের দাদা-দাদীসহ ১০ সদস্যের পরিবার। বাবাই একমাত্র উপার্জন করেন। তার আয়ে সংসার চলে। এভাবে কতদিন চলতে পারবো জানিনা। সরকারের প্রতি আহবান আমাদের পরিবারটির দিকে তারা যেন নজর দেয়।’

প্রতিবেশী রবিউল মাষ্টার বলেন, ‘উনার একটা ছেলে আছে, অনেক কষ্ট করে বাড়ির পেছনের জমি বিক্রি করে তাকে এইচএসসি পর্যন্ত লেখাপড়া করিয়েছেন। কিন্তু ওই ছেলের কাজ নেই, বেকার। সরকারের কাছে আমাদের আশা- তারা যদি ছেলেটাকে একটা কাজ দেয় তাহলে সংসারটা বেঁচে যাবে। নাহলে কয়দিন পরে তাদের পথে বসতে হবে।’

স্থানীয় ফয়সাল হোসেন বলেন, ‘উনার দুইটা সহযোগিতা দরকার। এমন একটা ব্যবস্থা হোক যাতে উনার পরিবারটা চলতে পারে আরেকটা বিষয় হচ্ছে সরকার এমন দায়িত্ব নিক যেন যে পর্যন্ত উনি পুরোপুরি সুস্থ না হয় সে পর্যন্ত সকল ব্যায়ভার বহন করে।’ জেলা সিভিল সার্জন ডা. মো. মঞ্জুরুল আলম বলেন, ‘আহত মঞ্জিলের বিষয়ে আমরা খোঁজখবর নিয়েছি। সরকারের পক্ষ থেকে আহতদের তালিকা করতে আমাদের উপর নির্দেশনা রয়েছে। সেখানে মঞ্জিলকেও তালিকাভুক্ত করা হয়েছে। আশা করছি- তিনি সরকারের প্রতিশ্রুত সহায়তা পাবেন। এছাড়া তিনি ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল বা সিএমএইচে যোগাযোগ করলে পরবর্তী চিকিৎসাটি বিনামুল্যে সম্পন্ন করতে পারবেন বলে আশা করছি।’

এ নিয়ে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন ঘিরে হতাহতের ঘটনায় মুন্সীগঞ্জ সদর থানায় ৩টি হত্যা ও দুটি হত্যা চেষ্টাসহ ৫ টি মামলা করা হয়েছে।

নতুন এই মামলার অন্য আসামিদের মধ্যে আছেন, মুন্সীগঞ্জ-১ আসনের সাবেক সংসদ সদস্য মহিউদ্দিন আহমেদের ছেলে কেন্দ্রীয় যুবলীগের সদস্য আনিসুর রহমান ওরফে রিয়াদ, মুন্সীগঞ্জ জেলা আ.লীগের সাধারন সম্পাদক শেখ লুৎফর রহমান, মুন্সীগঞ্জ শহর আ.লীগের সভাপতি ও রাষ্ট্র পক্ষের আইনজীবী (পিপি) আবদুল মতিন, সাধারন সম্পাদক সাইদুর রহমান ভূইয়া, সদর উপজেলার সাবেক ভাইস চেয়ারম্যান নাজমুল হাসান সোহেল, জেলা ছাত্রলীগের সাবেক সভাপতি ফয়সাল মৃধা, সদর উপজেলা ছাত্রলীগের সভাপতি মো.সুরুজ, শহর ছাত্রলীগের সভাপতি নসিবুল ইসলাম, সাধারন সম্পাদক সাজ্জাত হোসেন সাগর প্রমুখ।

মামলার এজহার ও স্থানীয় সুত্রে জানাযায়, গত ৪ আগস্ট রোববার সকাল থেকে সরকার পতনের একদফা আন্দোলনে শিক্ষার্থীদের সঙ্গে শহরের বিএনপি অধ্যুষিত এলাকা উত্তর ইসলামপুরের শতশত লোকজন অংশ নেন।

ওই দিন সকাল পৌনে ১০টার দিকে ছাত্র-জনতা শহরের সুপারমার্কেট এলাকায় গেলে পুলিশের উপস্থিতিতে আওয়ামী লীগ ও ছাত্রলীগের নেতা-কর্মীরা শিক্ষার্থীদের পেটাতে শুরু করেন। আন্দোলনকারীরা শহরের হাটলক্ষ্মীগঞ্জ এলাকার সড়ক দিয়ে সুপারমার্কেট এলাকায় আসতে চাইলে জেলা ছাত্রলীগের সাবেক সভাপতি ফয়সাল মৃধা, শহর ছাত্রলীগের সভাপতি নসিবুল ইসলাম, সাধারণ সম্পাদক সাজ্জাদ সাগর, শহর আওয়ামী লীগের সভাপতি, সাধারণ সম্পাদক, সদর উপজেলার মোল্লাকান্দি, শিলই ও আধারা ইউনিয়নের চেয়ারম্যানদের নেতৃত্বে আওয়ামী লীগের নেতা-কর্মীরা বন্দুক, ছুরি, ককটেল নিয়ে আন্দোলনকারীদের ওপর হামলা চালান।

অন্যদিকে আন্দোলনকারীদের ছত্রভঙ্গ করতে কাঁদানে গ্যাসের শেল ও ছররা গুলি ছোড়ে পুলিশ।

সেদিন আ.লীগ ও তাদের অঙ্গসংঠনের সস্ত্র সন্ত্রাসীদের গুলিতে উত্তর ইসলামপুরের রিয়াজুল ফরাজী, সজল মোল্লা, ডিপজলসহ তিনজন দিনমজুর মারাযান। এতে দেড় শতাধিক আন্দোলনকারী গুলিবিদ্ধ হন। এদিন গুলিতে মঞ্জিল মোল্লার পেটে, পিঠে ও হাতে তিনটি গুলি লাগে।এতে মঞ্জিলের ডান হাতের কবজির হাড় গুড়ো গুড়ো হয়ে যায়। পেটের গুলিতে ৫ টি নারি ছিদ্র হয়। ঘটনার পর থেকে আড়াই মাস হাসপাতালে চিকিৎসাধীন ছিলেন মঞ্জিল। সেখানে তার হাত ও পেটে তিনটি সার্জারি হয়। মঞ্জিল এখনো তার চিকিৎসা চালিয়ে যাচ্ছেন।

যাযাদি/ এসএম

  • সর্বশেষ
  • জনপ্রিয়

উপরে