রোববার, ২৭ অক্টোবর ২০২৪, ১২ কার্তিক ১৪৩১

পাথরঘাটায় ৩০ বছরে ১৮৮ জেলে নিখোঁজ, ফিরে পেতে স্বজনদের আহাজারি

পাথরঘাটা (বরগুনা) প্রতিনিধি
  ২৭ অক্টোবর ২০২৪, ১৫:১৯
আপডেট  : ২৭ অক্টোবর ২০২৪, ১৫:২৪
ছবি : যায়যায়দিন

বঙ্গোপসাগরের কোল ঘেঁষা উপকূলীয় অঞ্চল বরগুনার পাথরঘাটার অধিকাংশ মানুষ মৎস্য পেশার সঙ্গে জড়িত। মাছ শিকার করে তারা জীবিকা নির্বাহ করে থাকেন। বেঁচে থাকার তাগিদে জীবিকা নির্বাহের জন্য বৈরী আবহাওয়া উপেক্ষা করে প্রতিনিয়ত সমুদ্রে পাড়ি জমাতে হয়। এ সকল জেলেরা মাছ শিকার করতে গিয়ে সমুদ্রের প্রতিনিয়তই সম্মুখীন হচ্ছে সাইক্লোন, বন্যা, সুনামি ও জলোচ্ছ্বাসের।

মাছ শিকারে গিয়ে এই সকল প্রাকৃতিক দুর্যোগের সম্মুখীন হয়ে ১৯৯৩ সাল থেকে এখন পর্যন্ত এই ৩০ বছরে শুধু পাথরঘাটাই নিখোঁজ হয়েছে ১৮৮ জন জেলে। নিখোঁজ জেলেদের ফিরে পেতে এখনো জেলে পল্লিতে বিরাজ করছে স্বজনদের আহাজারি। ১৯৯৩ সালের বন্যা, ২০০৭ সালে সিডর, ২০০৮ সালে নার্গিস, ২০০৯ সালের আইলা, ২০১৩ সালে মহাসেন, ২০১৫ সালের কোমেন, ২০১৬ সালের রোয়ানু, ২০১৭ সালের রোমা, ২০২৩ সালের মিধিলিসহ এই সকল বন্যায় জেলে পরিবার হারিয়েছে তাদের প্রিয়জনকে।

পাথরঘাটা উপজেলা প্রশাসনের তথ্য অনুসারে, ১৯৯৩ সাল থেকে ২০২৪ সালের মধ্যে বেশি সংখ্যক জেলে ২০০৭ সালের সিডরে নিখোঁজ হয়েছে। ১৯৯৩ সালে ৫ জন, ১৯৯৪ সালে ২ জন, ২০০১ সালে ৫ জন, ২০০৬ সালে ১৪ জন, ২০০৭ সালে ৯১ জন, ২০১৪ সালে ৭ জন, ২০১৮ সালে ১৩ জন সর্বশেষ ২০২৩ সালে ১৫ জন জেলেসহ এখনো পর্যন্ত মোট নিখোঁজ রয়েছে ১৮৮ জেলে। এসব নিখোঁজ জেলেদের তালিকা প্রকাশ করে সম্প্রতি পাথরঘাটা উপজেলা পরিষদের সামনে স্মৃতি ফলক উন্মোচন করেছে পাথরঘাটা উপজেলা প্রশাসন। স্থানীয় জেলে সংগঠন, গনমাধ্যম কর্মী, ইউনিয়ন পরিষদ, মৎস্য দপ্তর ও পৌরসভার মাধ্যমে তথ্য সংগ্রহ করে একাধিকবার যাচাই-বাছাই এর মাধ্যমে এ চূড়ান্ত ডাটাবেইজ প্রস্তুত করা হয়।

জেলে পরিবারের সাথে কথা বলে জানা যায়, তাদের স্বজন হারিয়ে বিভিন্ন রকম সমস্যার সম্মুখীন হতে হচ্ছে তাদের। নিখোঁজদের কোন মৃত্যু সনদ না থাকার কারণে পরিবারের জমি জমা বিক্রি সহ বিভিন্ন ধরনের জটিলতায় পড়ছে পরিবারগুলো। নিখোঁজ জেলেদের স্ত্রীরা পাচ্ছেনা সরকারি সহায়তা অথবা বিধবা ভাতা।

১৯৯৩ সালে নিখোঁজ কালমেঘার জেলে হারুন সরদারের মা জবেদা বলেন, আমার ছেলে একটি ট্রলারে গভীর সমুদ্রে মাছ শিকারে যায় । ঝড়ের কবলে পড়ে ট্রলারটি সমুদ্রে ডুবে যায় আমার ছেলে বেঁচে আছে না মরে গেছে তাও জানিনা। আমার ছেলে নিখোঁজের পর তার স্ত্রী দুই সন্তানকে রেখে দুমাস পর বাবার বাড়ি চলে যায়। অন্যের বাড়ি কাজ করে আমি এই দুই সন্তানকে খাবারের ব্যবস্থা করি। এখন তারা কর্মের উদ্দেশ্যে চট্টগ্রাম রয়েছে। ৩০ বছর নিখোঁজ থাকার পরেও পাইনি সরকারি কোন অনুদান।

২০১৪ সালে স্বামীসহ দুই সন্তানকে হারিয়েছে চরদুয়ানীর রানী বেগম। তিনি বলেন, আমার স্বামী ইসমাইল ফরাজীকে হারিয়েছি সাথে দুই ছেলে সাইকুল ও শহিদুলকে হারিয়েছি। এখন পর্যন্ত নিখোঁজ রয়েছে তারা। জানিনা তারা কোথায় আছে, বেঁচে আছে না মরে গেছে। দীর্ঘ অপেক্ষার পর দুইপত্রবধূ চলে যায় বাবার বাড়ি, পরে তারাও অন্যত্র বিয়ে করে সংসার করছে। আমি অন্যের বাড়িতে কাজ করে মানুষের কাছ থেকে চেয়ে মেয়ে রহিমাকে এসএসসি পাশ করিয়ে বিয়ে দিয়েছি। এযাবৎকাল সরকারি সহায়তা ২০০০ টাকা আর ৫ কেজি চাল পেয়েছে।

বরগুনা জেলা মৎস্যজীবী ট্রলার মালিক সমিতির সভাপতি গোলাম মোস্তফা চৌধুরী জানান, জীবিকার তাগিদে প্রতিদিনই ট্রলারে ঝুঁকি নিয়ে মাছ শিকারের জন্য নদী, মোহনা, সাগর ও গভীর সাগরে গমন করে। বড় তিনটি নদী ও সমুদ্র উপকূলবর্তী উপজেলা হওয়ায় যে কোন বন্যা, ঘূর্ণিঝড়, জলোচ্ছ্বাস এই পাথরঘাটায় প্রথম আঘাত হানে। এর ফলে প্রতি বছরই জেলে ও মাছ ধরার ট্রলারসমূহ নদী, মোহনা, সমুদ্র ও গভীর সমুদ্রে নিখোঁজ হয়। পাথরঘাটা উপজেলা নির্বাহী অফিসার মোহাম্মদ রোকনুজ্জামান খান নিখোঁজ জেলেদের ডাটাবেইজ করে একটি স্মৃতি ফলক স্থাপন করায় আমরা তার প্রতি কৃতজ্ঞতা জানাই।

পাথরঘাটা উপজেলা সিনিয়র মৎস্য কর্মকর্তার কার্যালয় সূত্রে জানা যায়, এই অঞ্চলের বেশির ভাগ মানুষই মৎস্য পেশার সঙ্গে জড়িত। নিখোঁজ জেলেদের তথ্য সংগ্রহ করা হয়েছে। যে জেলে নিখোঁজের ছয় মাস শেষ হয়ে গেছে ওই সব জেলে পরিবারকে আমরা ৫০ হাজার টাকা করে সহায়তা দেয়া হয়েছে। তাছাড়া উর্ধ্বতন কর্মকর্তাদের সঙ্গে কথা বলে আর কিছু একটা করার চেষ্টা চলছে।।

পাথরঘাটা উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা রোকনুজ্জামান খান বলেন, নিখোঁজ জেলেদের নামসহ উপজেলা পরিষদের মধ্যে একটি ম্যুরাল তৈরি করা হয়েছে। যাতে করে দেখলেই বোঝা যায় যে এই উপজেলার কতজন জেলে নিখোঁজ। নিখোঁজ জেলেদের তালিকা প্রস্তুত করে রেশন ও আর্থিক সহায়তাসহ তাদের জমিজমা বিক্রির জন্য একটি সনদ দেয়ার প্রস্তাব দেওয়া হয়েছে জেলা প্রশাসক, মৎস্য ও প্রাণী সম্পদ মন্ত্রণালয়ের বরাবর।

যাযাদি/এআর

  • সর্বশেষ
  • জনপ্রিয়

উপরে