মঙ্গলবার, ২২ অক্টোবর ২০২৪, ৭ কার্তিক ১৪৩১

সোনাইমুড়ী উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্স  নিজেই রোগী!

সোনাইমুড়ী (নোয়াখালী) প্রতিনিধি
  ২২ অক্টোবর ২০২৪, ১০:০৯
ছবি: সংগৃহীত

সোনাইমুড়ী উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে ডাক্তার অনুপস্থিত, বহিরাগত লোকজন দিয়ে চিকিৎসা দেয়া,পরীক্ষা নিরীক্ষায় অতিরিক্ত টাকা গ্রহণসহ নানা অনিয়মের অভিযোগ উঠেছে। এ হাসপাতালটি এখন নিজেই রোগী। এতে চরম দুর্ভোগ পোহাতে হচ্ছে রোগীদের।টিকিট নিয়ে দেড়-দুই ঘণ্টা অপেক্ষা করেও চিকিৎসকের দেখা না পাওয়ায় রোগী ও তাদের স্বজনদের মধ্যে ক্ষোভের সৃষ্টি হয়েছে।

জানা যায়, সোনাইমুড়ী উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্স ডাক্তার নার্স যেন সোনার হরিণ হয়ে পড়েছে। একবার দেখা মিললেও, আবার কখন দেখা হবে জানেন না রোগীরা। এতে করে চরম ভোগান্তিতে পড়ছেন চিকিৎসা নিতে আসা রোগীরা।

৫০ শয্যাবিশিষ্ট এ স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সটি ঢাকা- নোয়াখালী মহাসড়কের পার্শ্বে হওয়ায় প্রতিদিন শতশত রোগী চিকিৎসা নিতে আসে। কিন্তু কর্তৃপক্ষের অবহেলায় দালালদের সিন্টিগেটের কারণে চরম বিপাকে পড়ছে চিকিৎসা নিতে আসা রোগীরা।স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে চিকিৎসা নিতে আসা রোগীদের অভিযোগ, বিভিন্ন ওষুধ কোম্পানীর বিক্রয় প্রতিনিধিদের সঙ্গে হাসপাতালের ডাক্তারদের সখ্যতা থাকায় কমিশনের বিনিময়ে তাদের ওষুধ প্রেসক্রিপশনে লিপিবদ্ধ করে থাকেন।এ হাসপাতালে প্রতিনিয়ত মেডিকেল অফিসার ও বিশেষজ্ঞ ডাক্তারগণ ঠিকমত আসেন না। গত এক বছর পূর্বে ম্যাটসের ছাত্র-ছাত্রীদের ইন্টানি করতে ৩ মাসের জন্য সোনাইমুড়ী উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে পাঠানো হতো। তাদের ইন্টানির মেয়াদ শেষ হলেও হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ নিয়ম বহিভূতভাবে তাদেরকে দিয়ে জরুরী বিভাগে ও ডাক্তারের রুমে বসিয়ে রোগীদের চিকিৎসা দিচ্ছে।হাসপাতালের জরুরী বিভাগে ও ১১৮ নং ডাক্তারের রুমে বহিরাগত মেয়াদ শেষ হওয়া ইন্টারনি ছাত্র ছাত্রী জিহাদ, রিফাত,নিশি, রাফি ও ইয়াসিন সহ ৭/৮ জন প্রতিনিয়ত নিয়ম বহিভূতভাবে সরকারি স্লিপিং ওষুধ লিখে চিকিৎসা দিচ্ছে। হাসপাতালের এএনসি কর্নার ( ডেলিভারি সেবা কেন্দ্র) বিভাগে অনিয়মের শেষ নেই। হাসপাতালের দাত্রী( মিড ওয়াইফ) ডেলিভারি করিয়ে প্রতি রোগী থেকে ২/৩ হাজার টাকা হাতিয়ে নিচ্ছে। রোগীর স্বজনরা এ নিয়ে হাসপাতাল কর্তৃপক্ষের কাছে একাধিকবার জানালেও কোন কর্ণপাত করেননি।

রোগীদের অভিযোগ, এ হাসপাতালের মেডিসিন বিশেষজ্ঞ ডাক্তার তানজিনা, গাইনি বিশেষজ্ঞ ডাক্তার সোহানা সিকদার, শিশু বিশেষজ্ঞ ডাক্তার সুপর্ণা,শিশু বিশেষজ্ঞ ডাক্তার আমিনুল ইসলাম, এনেসথেসিয়া ডাক্তার অভি প্রতিনিয়ত হাসপাতালে আসেন না। এসব বিশেষজ্ঞ ডাক্তারদের রোগীরা কখনোই এই হাসপাতালে দেখেননি। প্রতিমাসের দুই এক দিন এসে পুরো মাসের হাজিরা দিয়ে থাকেন। তাদের অনুপস্থিতিতে সহযোগিতা করেন হাসপাতালের উপজেলা স্বাস্থ্য ও পরিবার পরিকল্পনা কর্মকর্তা ডাক্তার ইসরাত জাহান। ডাক্তার গোলাম আযম হাসপাতালের মেডিকেল অফিসার। তবে তিনি রোগীদের এনেসথেসিয়া দিয়ে থাকেন বলে অভিযোগ দীর্ঘদিনের। আর জরুরী বিভাগে রোগী ভর্তি ১০ টাকা ফ্রির স্থলে কর্তব্যরত স্টাফরা রোগীদের কাছ থেকে নিয়ে থাকেন ৫০ টাকা। চিকিৎসা নিতে ৫ টাকা ফ্রির স্থলে নিয়ে থাকেন ২০ টাকা। বহিরাগত ইন্টার্নি ডাক্তাররা ও পিয়নরা জরুরী বিভাগে সার্জিক্যাল কাজ করে রোগীদের কাছ থেকে নিয়ে থাকেন টাকা।

জরুরি বিভাগে বিষ খাওয়া রোগী এলে ৩/৪ হাজার টাকা চুক্তিতে চিকিৎসা দিয়ে থাকেন বলে অভিযোগ রয়েছে হাসপাতালের প্যাথলজি বিভাগে চরম অনিয়ম দীর্ঘদিনের। খোদ হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ এ অনিয়মের সাথে জড়িত রয়েছে। বিভিন্ন পরীক্ষা নিরীক্ষায় সরকারি ফির চেয়ে ৪/৫ গুণ বেশি টাকা আদায় করা হচ্ছে। এইসব অনিয়মের বিষয়ে বিভিন্ন জাতীয় দৈনিক পত্রিকায় একাধিকবার সংবাদ প্রকাশিত হলে নোয়াখালী জেলা সিভিল সার্জন ডাক্তার মাসুম ইফতেখারের নজরে আসে। তিনি গত ৩ মাস পূর্বে সরেজমিনে এসে এসব অনিয়মের সত্যতা পেয়ে উপজেলা স্বাস্থ্য ও পরিবার পরিকল্পনা কর্মকর্তা ডাক্তার ইসরাত জাহানকে ব্যবস্থা নেয়ার নির্দেশ দেন। পরে তিনি বিভিন্ন পরীক্ষা-নিরীক্ষার ফি নিতে হাসপাতালে বুথ খোলেন। ওই বুথে হাসপাতালের সিনিয়র নার্স কানুন রশিদের মাধ্যমে পরীক্ষা-নিক্ষার ফ্রি নেন। কিন্তু বর্তমানে আবারো এই বিভাগে অনিয়ম চলছে। পরীক্ষা নিরীক্ষার টাকা রশিদের মাধ্যমে না নিয়ে সরাসরি বিতর্কিত প্যথোলজিস্ট লিয়াকত হোসেন নিয়ে থাকেন। সোনাইমুড়ী উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্স ৫০ শয্যা বিশিষ্ট হাসপাতালে ভর্তিকৃত রোগীদের নিম্নমানের খাবার সরবরাহের অভিযোগ উঠেছেন ঠিকাদারী প্রতিষ্ঠানের বিরুদ্ধে। স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সের এক শ্রেণির অসাধু কর্মকর্তাদের যোগসাজশে এ কাজ চলছে দীর্ঘদিন থেকে। নির্ধারিত পরিমাণের চাইতে কম এবং নিম্নমানের খাবার দেয়ার অভিযোগ করেছেন রোগী ও তাদের স্বজনরা।

খাবারের এমন অনিয়মের কারণে চিকিৎসা নিতে আসা সোনাইমুড়ীর মাহোতোলা এলাকা থেকে আসা সাহজাহান বললেন প্রতিপক্ষের হামলায় আহত হয়ে শাহজাহান দুই দিন থেকে ভর্তি আছি হাসপাতলে নিম্নমানের খাবার. তেল মসলা কিছুই দেয় না সিদ্ধ করে এনে দেন। এগুলি খানার কোন উপযোগী না আমি বাইরে থেকে কিনে আনি খাই। স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সটির পরিবেশ নোংরা ও দুর্গন্ধযুক্ত।

উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে ভর্তিকৃত কয়েকজন রোগী অভিযোগ করে জানান,নার্সদের দুর্ব্যবহার নিত্যদিনের ঘটনা। হাসপাতালে ইনজেকশন দিতে নার্সদের দিতে হয় ১০০ /২০০ টাকা। ভর্তি রোগীদের কোনরকম সেবা দিয়েই নার্স, সুইপার, আয়া রোগীদের কাছ থেকে টাকা দাবি করে থাকেন। টাকা না দিলে দুর্ব্যবহার করেন।

স্থানীয় বাসিন্দারা জানিয়েছেন, উপজেলা স্বাস্থ্য স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে ডাক্তারদের কক্ষে সকাল ১০টা থেকে বিকেল পর্যন্ত বৈদ্যুতিক সবগুলো বাতি জ্বলে, ফ্যানও ঘুরে। কিন্তু ডাক্তার থাকেন না। আবার কিছু কিছু ডাক্তারদের কক্ষে তালা ঝুলে।

এমন চিত্র নিত্যদিনের। সেবা নিতে আসা রোগীরা দীর্ঘ লাইনে দাঁড়িয়ে থাকলে সকাল ১১ টার দিকে বহিরাগত ইন্টানি ছাত্র-ছাত্রীরা এসে চিকিৎসা দেন। হাসপাতালটিতে যেন অনিয়মের শেষ নেই। টিকা কেন্দ্রে মনুসাহা নামে এক কর্মচারী গর্ভবতী মহিলা রোগীদের কাছ থেকে ২০০ /৩০০ টাকা করে নেন।

এ প্রসঙ্গে কথা হয় সোনাইমুড়ী উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সের আর এম ও ডাক্তার রিয়াজ উদ্দিন এর সাথে। তিনি বলেন, হাসপাতালের কিছু অনিয়ম রয়েছে এটা সত্য। বিষয়টি আমরা সংশোধনের চেষ্টা চালাচ্ছি।

সোনাইমুড়ী উপজেলা স্বাস্থ্য ও পরিবার পরিকল্পনা কর্মকর্তা ডাক্তার ইসরাত জাহান বলেন, তিনি এই হাসপাতালে যোগদান করার পর সেবায় উন্নতি হয়েছে। তবে কোন অনিয়ম থাকলে তিনি ব্যবস্থা নিবেন।

নোয়াখালী জেলা সিভিল সার্জন ডাক্তার ইফতেখার মাসুম বলেন, হাসপাতালের কয়েকটি অভিযোগ তিনি নির্ণয় করে ব্যবস্থা নিয়েছেন। এরপরও তিনি সরেজমিনে গিয়ে ব্যবস্থা নিবেন।

যাযাদি/এআর

  • সর্বশেষ
  • জনপ্রিয়

উপরে