ফেনীতে বন্যায় প্রায় ৬৫ হাজার ঘরবাড়ির ক্ষয়ক্ষতি, তৎপরতা নেই পুনর্বাসনে

প্রকাশ | ০৯ অক্টোবর ২০২৪, ১২:০৪

আজাদ মালদার, ফেনী থেকে
ছবি: যায়যায়দিন

ফেনীতে এবারের বন্যায় প্রায় ৬৫ হাজার ঘরবাড়ির ৫৩৩ কোটি ৮৯ লাখ ৭০ হাজার টাকার ক্ষয়ক্ষতি হয়েছে বলে ফেনী  জেলা প্রশাসন সূত্রে এ তথ্য জানা গেছে। এরমধ্যে ৮ হাজার ৯৫টি কাঁচাঘর, ২৫০টি আধাপাকা ঘর সম্পূর্ণ ধ্বসে গেছে । এতে আনুমানিক ক্ষতি হয়েছে ১৬৩ কোটি ১১ লাখ ৭০ হাজার টাকা। ৫৩ হাজার ৪৩৩টি কাঁচাঘর এবং ২ হাজার ৬৩২টি আধাপাকা ঘরের আংশিক ক্ষতির আর্থিক পরিমাণ ৩৭০ কোটি ৭৮ লাখ টাকা। সবমিলিয়ে ৬৫  হাজার ৪১৫টি ঘরবাড়িতে মোট ক্ষয়ক্ষতি হয়েছে ৫৩৩ কোটি ৮৯ লাখ ৭০ হাজার টাকা।

খোঁজ নিয়ে জানা যায়, স্মরণকালের ভয়াবহ এ বন্যায় পানির তীব্র স্রোতের সঙ্গে ভেসে গেছে জেলার ফুলগাজী উপজেলার জগতপুর এলাকার আসমা আক্তারের বসতঘর। গত দেড় মাস ধরে পরিবার নিয়ে পার্শ্ববর্তী এলাকায় আত্মীয়ের বাড়িতে কোনোমতে খেয়ে না খেয়ে দিন কাটছে তার।

তিনি বলেন, অনেক বেশি সম্পদ না থাকলেও সন্তানদের নিয়ে ভালোভাবেই কাটছিলো সংসার। তবে আকস্মিক বন্যায় আমাদের আর কিছুই বাকি নেই। এতদিন ধরে অনেকে খাবার দিয়ে সহযোগিতা করেছে। অনেকে ঘরের জন্য নাম নিয়েছে। তবে এখনো ঘর পাইনি।

বন্যায় ঘর হারিয়েছেন ফেনীর পরশুরামের বক্সমাহমুদ এলাকার বয়োবৃদ্ধ রেজিয়া বেগম। তিনি বলেন, আজকে দেড় মাসে কতজন আসছে নাম নিতে। তবে,এখনো  আর ঘরটি পাইনি। আমাদের জন্য কত মানুষ টাকা দিছে শুনছি। সেগুলোতো ঢাকায়। ঘর কিভাবে পাব। এ অবস্থা শুধু আছমা কিংবা বয়োবৃদ্ধ রেজিয়ারই নয়, এমন অভিযোগ স্মরণকালের ভয়াবহ বন্যায় ঘর হারানো ফেনীর পুরো জনপদের শতশত পরিবারের।

সরেজমিন ঘুরে দেখা গেছে, বন্যা পরবর্তী বেসরকারিভাবে বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান ও স্বেচ্ছাসেবী সংগঠন পুনর্বাসনে কাজ করছেন। তবে গৃহ নির্মাণ বা পুনর্বাসনে এখনো আসেনি সরকারি কোনো বরাদ্দ।

ফুলগাজীর দক্ষিণ জগতপুর গ্রামের বাসিন্দা সিএনজি অটোরিকশা চালক খোকন মিয়া। ২০ আগস্ট ভয়াবহ বন্যায় পানির তীব্র স্রোতের সঙ্গে ভেসে গেছে বসতভিটা। সেদিন পানি থেকে বাঁচতে ঘর থেকে কোনোমতে প্রাণ নিয়ে বের হতে পারলেও সঙ্গে কিছুই আনতে পারেনি তারা। নিরুপায় হয়ে পানি উন্নয়ন বোর্ডের সেচ স্কিমের ছোট একটি ঘরে স্ত্রী-সন্তান নিয়ে কোনোমতে দিনযাপন করছেন খোকন।

তিনি বলেন, বন্যা সবকিছু শেষ করে দিয়ে গেছে। আয়ের একমাত্র অবলম্বন সিএনজি অটোরিকশাটিও ভাঙন এলাকায় আটকে গেছে। এক মাস পার হয়ে গেলেও কোনো কাজ নেই। এ অবস্থায় সরকারি সহায়তা ছাড়া নতুন করে আমার পক্ষে ঘর তোলা সম্ভব নহে। 

মফিজ  উদ্দিন নামে স্থানীয় আরেক বাসিন্দা বলেন, বেড়িবাঁধের পাশে একটি মুদি দোকান করে পরিবার নিয়ে কোনোমতে জীবনযাপন করতাম। বন্যার পানির স্রোতে সবকিছু এলোমেলো করে দিয়েছে। আশ্রয়কেন্দ্র ছেড়ে বাড়িতে আসলেও এখনো ঘরে ঢুকতে পারিনি। পরিবার নিয়ে এক চাচাতো ভাইয়ের বাড়ির ছাদে বসবাস করছি।

জেলা স্বেচ্ছাসেবক পরিবার প্ল্যাটফর্মের ওসমান গনি রাসেল বলেন, বন্যায় ক্ষতিগ্রস্তদের পুনর্বাসনে এখন পর্যন্ত ব্যক্তিগত উদ্যোগ, বিভিন্ন এনজিও এবং স্বেচ্ছাসেবী সংগঠনই একমাত্র ভরসা। সরকারের ত্রাণ তহবিল বা টিএসসির গণত্রাণের অর্থ দেড় মাস পেরিয়ে গেলেও ফেনী আসেনি। সংশ্লিষ্টরা যদি এ ব্যাপারে উদ্যোগ নেন মানুষগুলো অন্তত মাথা গোঁজার ঠাঁই পাবে।

এ ব্যাপারে ফেনী জেলা প্রশাসক মুছাম্মৎ শাহীনা আক্তার বলেন, ক্ষতিগ্রস্ত পরিবারগুলোকে সহায়তায় সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয়ে ২০ হাজার বান্ডেল টিন ও নগদ ৬ কোটি টাকা বরাদ্দ চাওয়া হয়েছে। এছাড়া বেসরকারিভাবে যেসব প্রতিষ্ঠান এবং সংগঠন পুনর্বাসনে সহায়তায় এগিয়ে এসেছে তাদের কাজগুলো প্রশাসনের পক্ষ থেকে সমন্বয় করা হচ্ছে।

এদিকে স্থানীয় জেলা প্রশাসন সূত্রে প্রাপ্ত তথ্যে ফেনীতে ভয়াবহ এ বন্যায় প্রাণ হারিয়েছেন ২৯ জন। নিহতদের মধ্যে ১৭ জন পুরুষ, ৮ জন নারী ও ৪ জন শিশু রয়েছে। তাদের মধ্যে ২০ জনের পরিচয় মিলেছে। বাকি ৯ জনের পরিচয় পাওয়া যায়নি। ।
ফেনী জেলা গোয়েন্দা পুলিশের বরাত দিয়ে জেলা প্রশাসন জানান, নিহত ২৯ জনের মধ্যে ফেনী সদরের ৮ জন, দাগনভূঞায় ৩ জন, ফুলগাজীতে ৭ জন, সোনাগাজীতে ৬ জন, ছাগলনাইয়ায় ৩ জন এবং পরশুরামের ২ জন রয়েছেন।

জেলা প্রশাসক মুছাম্মৎ শাহীনা আক্তার বিষয়টি নিশ্চিত করে বলেন, নিহতদের পরিবারকে মানবিক সহায়তার জন্য দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা ও ত্রাণ মন্ত্রণালয়ে ২০ লাখ টাকা বরাদ্দ চাওয়া হয়েছে। বরাদ্দ পেলে সেসব পরিবারকে সহায়তা দেওয়া হবে।
অন্যদিকে বন্যার পর থেকে ফেনীতে ছুটে আসেন সরকারের একাধিক উপদেষ্টা ও সরকারের বিভিন্ন বিভাগের শীর্ষ পর্যায়ের কর্মকর্তারা।এর মধ্যে গত ২৪ আগস্ট  আসেন দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা ও ত্রাণ মন্ত্রণালয়ের উপদেষ্টা বীর মুক্তিযোদ্ধা ফারুক-ই-আজম।

তিনি বলেন, বর্তমানে আগের মতো কোন ভাই বা কোন দল নেই, যেখানে তার সড়ক অথবা বাড়ি আগে কাজ করে দিতে হবে। এজন্য সংশ্লিষ্ট দপ্তরের কর্মকর্তাদের প্রয়োজন বিবেচনায় অগ্রাধিকার ভিত্তিতে দুর্গতদের জন্য কাজ করতে হবে।
এছাড়া গত ২৭ আগস্ট বন্যাদুর্গত এলাকা পরিদর্শন করেন ধর্ম উপদেষ্টা ড. আ ফ ম খালিদ হোসেন। ২১ সেপ্টেম্বর বন্যার ক্ষতিগ্রস্ত এলাকায় পরিদর্শনে ফেনী আসেন ডাক টেলিযোগাযোগ ও তথ্যপ্রযুক্তি মন্ত্রণালয় এবং তথ্য ও সম্প্রচার মন্ত্রণালয়ের উপদেষ্টা মো. নাহিদ ইসলাম।

এ সময় উপদেষ্টা নাহিদ বলেন, এখানে যেহেতু প্রতিবছর বন্যা হয় সেজন্য স্থায়ী একটি সমাধান প্রয়োজন। ক্ষতির পরিমাণ কমিয়ে আনতে বাঁধগুলো কিভাবে সংস্কার করা যায়, সে বিষয়ে আলোচনা চলছে। এখন আমরা পুনর্বাসন কার্যক্রমে জোর দিচ্ছি।

এর পরেরদিনই বন্যায় ক্ষতিগ্রস্ত ফেনীর একাধিক এলাকা পরিদর্শনে আসেন পরিবেশ, বন ও জলবায়ু পরিবর্তন এবং পানিসম্পদ মন্ত্রণালয়ের উপদেষ্টা সৈয়দা রিজওয়ানা হাসান।

জেলার পরশুরাম উপজেলার বল্লামুখা বাঁধ পরিদর্শন শেষে তিনি বলেন, ক্ষতিগ্রস্ত জনগণের কাছে জানতে এসেছি তারা কী সমাধান চান। স্থানীয় জনসাধারণ বলেছে প্রতিবেশী দেশ বাঁধ কেটে দেওয়ায় তারা বন্যায় চরমভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছেন। এজন্য আমাদের মানুষের কথা, দুর্ভোগ ও প্রত্যাশা বুঝতে, সেই অনুযায়ী উজানের দেশের সঙ্গে কথা বলতেই এখানে এসেছি। তিনি সোনাগাজী  ও দাগনভুইয়া  নদী ভাঙ্গন এলাকায়  সহ মুছাপুর রেগুলেটরটি পরিদর্শন করেন এবং  দ্রুত  ব্যবস্থা নেয়ার আশ্বাস দেন। 

যাযাদি/ এসএম