সোমবার, ২৩ সেপ্টেম্বর ২০২৪, ৮ আশ্বিন ১৪৩১
নিহত মিরাজের মা

আমি মা জীবন দিব, তবুও সন্তানের লাশ তুলতে দিমু না

জে আই সমাপ্ত, লালমনিরহাট প্রতিনিধি
  ২৩ সেপ্টেম্বর ২০২৪, ১৫:৪২
ছবি: যায়যায়দিন

আমার সন্তানের খুনিদের বিচার চাই। তাই বলে কবর থেকে তার লাশ তুলে বিচার পেতে হবে এমনটা চাই না। প্রয়োজনে আমি মা জীবন দিব, তবুও সন্তানের লাশ তুলতে দিমু না। অশ্রুেসিক্ত চোখে গণমাধ্যমের কাছে এমন আকুতি জানান বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনে পুলিশের গুলিতে নিহত মিরাজুল ইসলাম মিরাজের মা মোহসেনা বেগম।

নিহত মিরাজুল ইসলাম মিরাজ লালমনিরহাটের আদিতমারী উপজেলার মহিষখোচা ইউনিয়নের বারঘড়িয়া আনছার খাঁর পুকুরপাড় এলাকার আব্দুস ছালামের ছেলে। নিজ গ্রামে পারিবারিক করবস্থানে তাকে গত ৮ আগস্ট দাফন করা হয়। ইতোমধ্যে ঢাকা সিএমএম আদালত লালমনিরহাট জেলা ম্যাজিস্ট্রেটকে নিহত মিরাজের মরদেহ উত্তোলন করে মর্গে পাঠাতে ব্যবস্থা নিতে আদেশ দিয়েছেন।

জানা যায়, স্থানীয় মহিষখোচা বহুমুখী উচ্চ বিদ্যালয় থেকে ২০২১ সালে এসএসসি পাশ করে বাবার সঙ্গে ঢাকার যাত্রাবাড়ি এলাকায় পাড়ি জমায় মিরাজুল ইসলাম মিরাজ। সেখানে ভাড়া বাসায় থাকতেন তারা। ঢাকা দনিয়া মডেল স্কুল অ্যান্ড কলেজে উচ্চ মাধ্যমিক শ্রেণিতে ভর্তি হয় সে। পড়ালেখার পাশাপাশি একটি মোবাইল ব্যাংকিংয়ের দোকানের কর্মচারী ছিলেন মিরাজ। অসুস্থ বাবার চিকিৎসা ছোট দুই ভাইয়ের লেখাপড়াসহ পুরো সংসার চলতো মিরাজের আয়ে। বাবার চিকিৎসার জন্য বিভিন্ন জনের কাছে ৩/৪ লাখ টাকা ঋণও করেছে মিরাজ। সেই ঋণ পরিশোধে আর সংসারের হাল ধরতে লেখাপড়ার পাশাপাশি দোকানে কাজ করতেন সে।

কিন্তু গত ৫ আগস্ট শেখ হাসিনা পদত্যাগের এক দফা আন্দোলনে অন্যদের মতো যাত্রাবাড়ি থানার সামনে মাছের আড়ৎ এলাকায় আন্দোলনে যোগ দেয় মিরাজ ও তার খালাত ভাই কারখানা শ্রমিক মাজেদুল ইসলাম। সেখানে পুলিশের গুলিতে দুই ভাই মিরাজ ও মাজেদুল গুলিবিদ্ধ হয়। এ সময় স্থানীয়রা তাদের উদ্ধার করে ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে ভর্তি করে।

পরদিন সেখান থেকে রংপুর মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে নেওয়া হয় মিরাজকে। অস্ত্রোপচার করে মিরাজের শরীর থেকে গুলি বের করা হলেও এর দুই দিন পর ৮ আগস্ট মারা যান মিরাজুল ইসলাম মিরাজ। আর তার সঙ্গে থাকা গুলিবিদ্ধ খালাত ভাই মাজেদুল ইসলাম চিকিৎসা নিয়ে বর্তমানে আশঙ্কা মুক্তা রয়েছেন। পরে এ ঘটনায় ২৪ আগস্ট যাত্রাবাড়ি থানায় নিহত মিরাজের বাবা আব্দুস ছালাম বাদী হয়ে লালমনিরহাট জেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি মোতাহার হোসেন এমপিকে প্রধান করে সাবেক সমাজকল্যাণ মন্ত্রী নুরুজ্জামান আহমেদসহ ৩৬ জনের নাম উল্লেখ করে অজ্ঞাত ২/৩শ জনের নামে একটি হত্যা মামলা (নং-১৭(৮) ২৪) দায়ের করেন। মামলাটির তদন্তের স্বার্থে মৃত মিরাজের ভিসেরা (ময়নাতদন্ত) প্রতিবেদনের জন্য কবর থেকে মরদেহ উত্তোলনের অনুমতি চেয়ে ঢাকা মেট্রোপলিটন ম্যাজিস্ট্রেট আদালতে আবেদন করেন তদন্ত কর্মকর্তা। যার পরিপ্রেক্ষিতে ঢাকা সিএমএম আদালতে বিচারক ম্যাজিস্ট্রেট তাহমিনা হক মরদেহ উত্তোলনে একজন নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট নিয়োগসহ প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নিতে লালমনিরহাট জেলা ম্যাজিস্ট্রেটকে আদেশ দেন।

তবে এদিকে কোনোভাবেই মরদেহ উত্তোলন করতে দিতে রাজি নন মিরাজের মা মোহসেনা বেগম। সার্বক্ষণিক পাহারা দিচ্ছেন মেধাবী সন্তানের করব। কারও আসার কথা শুনলেই দৌড়ে যান ছেলের কবরের পাশে। যাতে কেউ লাশ তুলতে না পারে সেজন্য প্রায় নির্ঘুম রাতও কাটছে তার।

নিহত মিরাজের মা মোহসেনা বেগম জানান, আমার জীবন থাকতে আমার কলিজার কলিজা কাটতে দিমু না। আমার কলিজার টুকরা সন্তানকে তারা গুলি করে হত্যা করেছে। আদর ভালোবাসা দিয়ে আদরের সন্তানকে কবরে শেষ বিদায় দিয়েছি। তার লাশ আর তুলতে দিব না। প্রয়োজনে আমি মা জীবন দিব, তবুও সন্তানের লাশ তুলতে দিমু না। আমার সন্তানের খুনিদের আমি বিচার চাই।

নিহত মিরাজের বাবা মামলার বাদী আব্দুস ছালাম বলেন, শুনেছি মামলার তদন্তের স্বার্থে ছেলের মরদেহ কবর থেকে উত্তোলন করা হবে। তবুও আইনজীবীদের সঙ্গে বসে যদি মরদেহ উত্তোলন ছাড়াও বিচারের পথ থাকে তবে মরদেহ উত্তোলন না করার আবেদন করা হবে। বিষয়টি নিয়ে লালমনিরহাট জেলা প্রশাসকের সঙ্গে মৌখিক আলোচনাও করেছি।

আদিতমারী থানা ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) মাহমুদ উন নবী জানান, এখনো পর্যন্ত নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট নিয়োগ করে মরদেহ উত্তোলনের দিনক্ষণ নির্ধারণ করে জেলা ম্যাজিস্ট্রেটের চিঠি আসেনি। এলে নির্দেশনা মোতাবেক ব্যবস্থা নেওয়া হবে। তবে ঢাকা সিএমএম আদালতের আদেশের অনুলিপি পেয়েছি।

যাযাদি/ এসএম

  • সর্বশেষ
  • জনপ্রিয়

উপরে