টাঙ্গাইলের গোপালপুর ও কালিহাতী 

গুলিতে নিহত হৃদয় ও নিখোঁজ শাহাদতের লাশ না পেয়ে হতাশায় পরিবার 

প্রকাশ | ২২ সেপ্টেম্বর ২০২৪, ১২:২১

জোবায়েদ মল্লিক বুলবুল, টাঙ্গাইল
শাহাদত ও হৃদয়

গণঅভ্যুত্থানে আওয়ামীলীগ সরকারের পতনের পর বিজয় মিছিলে গিয়ে গাজীপুরের কোনাবাড়ির কাশিমপুরে গুলিতে নিহত শিক্ষার্থী হৃদয় ও ৪ আগস্ট ঢাকার শাহবাগে আন্দোলনে গিয়ে নিখোঁজ ভেকু চালক শাহাদতের মরদেহও পায়নি পরিবার। মরদেহ বা সন্ধান না পেয়ে তাদের পরিবারে নেমে এসেছে ঘোরতর অন্ধকার। চূড়ান্ত হতাশায় ভুগছে পরিবার দুটি। গুলিতে নিহত শিক্ষার্থী হৃদয় টাঙ্গাইলের গোপালপুর ও আন্দোলনে গিয়ে নিখোঁজ শাহাদত জেলার কালিহাতী উপজেলার বাসিন্দা।

জানা গেছে, গোপালপুর উপজেলার আলমনগর ইউনিয়নের আলমনগর মধ্যপাড়া গ্রামের ভ্যানচালক লাল মিয়ার ছেলে হৃদয়(২০)। তিনি ওই উপজেলার হেমনগর ডিগ্রি কলেজের দ্বাদশ শ্রেণির শিক্ষার্থী। বাবা অসুস্থ হওয়ার পর থেকে নিজের লেখাপড়া এবং সংসারের খরচ চালাতে গাজীপুরের কোনাবাড়ি এলাকায় অটোরিকশা চালাতেন। 

গত ৫ অগাস্ট সরকার পতনের পর কোনাবাড়ির কাশিমপুর সড়কের মেট্রো থানার শরীফ মেডিকেলের সামনে থেকে আনন্দ মিছিল বের হয়। সেই মিছিলে শিক্ষার্থী হৃদয়ের সঙ্গে তার ভগ্নিপতি ইব্রাহিম ও বন্ধু রবিনও যোগ দেন। ভগ্নিপতি ইব্রাহিম ও বন্ধু রবিনের ভাষ্য- তারা বিজয় মিছিলে পুলিশ গুলি চালালে হৃদয় গুলিবিদ্ধ হয়। পুলিশের গুলিতে হৃদয়কে মাটিতে লুটিয়ে পড়তে এবং তার লাশ পুলিশকে নিয়ে যেতে দেখেছেন। কিন্তু পরে আর চেষ্টা করেও হাসপাতালের মর্গ বা অন্য কোথাও হৃদয়ের বা তার লাশের কোনো খোঁজ পাওয়া যায়নি। পরে ওই ঘটনার ভিডিও দেখেও স্বজনরা হৃদয়ের মৃত্যুর বিষয়টি তারা নিশ্চিত হয়েছেন বলে জানান ভগ্নিপতি ইব্রাহিম। 

তিনি জানান, ১১ দিন অপেক্ষার পর গত ২৬ অগাস্ট কোনাবাড়ি থানায় তিনি বাদী হয়ে ৫৭ জনের বিরুদ্ধে একটি হত্যা মামলা দায়ের করেছেন। কিন্তু হাজারো চেষ্টা কলেও হৃদয়ের লাশ তারা পায়নি।

সরেজমিনে আলমনগরে হৃদয়দের বাড়িতে গিয়ে দেখা যায়, বাড়িটি জরাজীর্ণ। একমাত্র ছেলেকে হারিয়ে পাগলপ্রায় মা রেহেনা বেগম। বাড়িতে রাখা ছেলের জামা-কাপড়, খেলাধুলায় পাওয়া বিভিন্ন পুরস্কার হাতে নিয়ে তিনি সারাক্ষণ কাঁদেন আর ছেলের পথ চেয়ে বসে থাকেন। বাবা লাল মিয়াও ছেলেকে হারিয়ে ভেঙে পড়েছেন। তিনি বুঝতে পারছেন না- আগামীদিনে তার সংসার কীভাবে চলবে।

হৃদয়ের পরিবার জানায়, হৃদয় ছিলেন দুই বোনের এক ভাই। দুই বোনের অনেক আগেই বিয়ে হয়ে গেছে। বাবা লাল মিয়া এলাকায় রিকশাভ্যান চালিয়ে পরিবারের ব্যয় নির্বাহ করতেন। কিন্তু অসুস্থতার কারণে লাল মিয়া আর কাজ করতে পারতেন না। একমাত্র ছেলে হৃদয় হেমনগর ডিগ্রি কলেজের দ্বাদশ শ্রেণিতে পড়ালেখা করছিল। বাধ্য হয়ে সংসারের খরচ চালাতে গত মে মাসে লেখাপড়ার পাশাপাশি হৃদয় অটোরিকশা চালানো শুরু করেন। তখন বাবা-মা এক বোনের বাড়িতে থাকতেন।

হৃদয়ের বাবা লাল মিয়া জানান, বড় মেয়ের জামাইয়ের একটি ঘরে তিনি স্ত্রীকে নিয়ে থাকেন। ছেলে একটি ভাঙাচোরা ঘরে থাকে। ছেলেটা কোনাবাড়িতে অটোরিকশা চালাতো। ঘটনার দিন ছেলেকে বাড়িতে আসতে বলেছিলেন। কিন্তু হৃদয় বলেছিল, ভাইয়ের (বোন জামাই) সঙ্গে যাবে। এখন তিনি ছেলের মরদেহ ফেরত চান। 

হৃদয়ের মা রেহেনা বেগম জানান, তাদের খাবার ও পড়াশুনা করার জন্য কোনাবাড়িতে কাজ করতে গিয়েছিল হৃদয়। গাড়ি চালানো শিখতে ১০ হাজার টাকা কিস্তি তুলে ছেলেকে দিয়েছেন। ছেলে গাড়ি চালাবে। সেই কিস্তির টাকা এখন কে দেবে? তার বুকের মানিককে পুলিশ গুলি করে মেরে ফেলেছে। তিনি ছেলের মরদেহ দেখার অপেক্ষায় প্রহর গুণছেন। 

সেদিনের ঘটনার বর্ণনা দিয়ে হৃদয়ের বন্ধু রবিন জানান, ৫ অগাস্ট বিকালে কোনাবাড়ির কাশিমপুর সড়কের মেট্রো থানার শরীফ মেডিকেলের সামনে থেকে একটি আনন্দ মিছিল বের হয়। সেই মিছিলে হৃদয়, ইব্রাহিমসহ তারা যোগ দেন। তিনি জানান, মেট্রো থানার সামনেই তারা অবস্থান নিয়েছিলেন। এ সময় পুলিশ তাদের ছত্রভঙ্গ করার জন্য কাঁদানে গ্যাস ও গুলি ছুঁড়ে। অনেকেই গুলিবিদ্ধ হয়েছে। তারা একপাশে ছিলেন। আর হৃদয় ছিল অন্যপাশে। তখন হৃদয় ভয়ে একটি বাড়ির পাশে লুকিয়েছিল। সেখান থেকে পুলিশ তাকে ধরে সড়কে নিয়ে যায় এবং মারধর করে।

রবিন আরও জানান, তারা দূর থেকে এটা দেখছিলেন। ভেবেছিলেন- হয়তো মারধর করে ছেড়ে দিবে। কিন্তু তারা গুলি করে হত্যা করেছে। এ সময় পুলিশের পক্ষ থেকে চতুর্দিকে গুলি করা হয়। ভয়ে এগিয়ে যেতে পারেন নাই। শুধু চেয়ে চেয়ে হৃদয়ের মৃত্যু দেখেছেন। এ দৃশ্য তিনি কোনো দিনও ভুলতে পারবেন না। ভেবেছিলেন- পরিবেশ কিছুটা শান্ত হলে হৃদয়ের মরদেহ আনতে যাবেন। কিন্তু পুলিশ তার মরদেহ নিয়ে চলে যায়। ওইদিন রাত ১২টার পর যেখানে হৃদয়কে হত্যা করা হয়েছে সেখানে শুধু তার রক্তাক্ত লুঙ্গিটা পান। তবে পুলিশ মরদেহ নিয়ে কোথায় রেখেছে সেটা আর জানতে পারেন নাই। পরে আশপাশে খোঁজ-খবর নিতে গেলে কয়েকজনের কাছে সেদিনের  সেখানকার ঘটনার একটি ভিডিও পান। সেই ভিডিও দেখার কথা জানান হৃদয়ের ভগ্নিপতি ইব্রাহিমও। তারা দুজনেই জানান, ভিডিওটি আশপাশের বাসা থেকে ধারণ করা হয়েছিল। এরকম ছোট ছোট কয়েকটি ভিডিও দেখার কথা জানান তারা। 

কয়েকটি ভিডিওর একটিতে দেখা যায়, ১০-১২ জন পুলিশ এক যুবককে ধরে সড়কের উপর নিয়ে লাঠিপেটা করছে। এরপর তাকে চারদিকে ঘিরে রেখে মারধর করছে। চারদিকে গুলির শব্দ শোনা যাচ্ছে। এরমধ্যে হঠাৎ করেই গুলিতে মাটিতে লুটিয়ে পড়েন যুবক হৃদয়। পরে পুলিশ সদস্যরা সেখান থেকে চলে যায়। এরপর আবার চারজন পুলিশ সদস্য সেখানে আসেন। তাদের মধ্যে দুইজন হাত দুইজন পা ধরে তাকে চাংদোলা করে নিয়ে যাচ্ছে।

আরেকটি ভিডিওতে দেখা গেছে, তিনজন মিলে যুবকের লাশ টেনে গলির ভেতর নিয়ে যাচ্ছে। তখনও আশপাশে প্রচÐ গুলির শব্দ শোনা যাচ্ছে। এরপর ওই তিনজন তার মরদেহ ফেলে চলে যায়। তার একটু পর আবার দুইজন এসে মরদেহটি গলির আরও ভেতর নিয়ে যাচ্ছে।

ঘটনার অপর প্রত্যক্ষদর্শী মো. হামিদ আলমনগরের বাসিন্দা। কোনাবাড়িতে তার একটি দোকান আছে। মিছিলের আগে হৃদয় সেই দোকানের সামনেই ছিলেন। সঙ্গে তার ভগ্নিপতিকেও দেখেছিলেন হামিদ। তিনি জানান, তিনি হৃদয়কে মিছিলে যেতে বারণ করেছিলেন। তারপরও তারা আনন্দ মিছিলে যোগদান করেছে। বোনের জামাই ইব্রাহিম দূর থেকে দেখেছেন কিভাবে পুলিশ হৃদয়কে গুলি করে মেরেছে। কিন্তু ভয়ে কেউ সামনে যাওয়ার সাহস পায়নি। যারা হত্যা করেছে তাদের বিচারের আওতায় এনে শাস্তির দাবি জানিয়ে দোকানদার হামিদ জানান, হৃদয়ের মরদেহ যেন তার পরিবার ফিরে পায়- সে ব্যবস্থা করা দরকার। 

হৃদয়ের বোন জিয়াসমিন আক্তার জানান, ঘটনার দিন বিকালেই মোবাইলে ভাইয়ের সঙ্গে তার সবশেষ কথা হয়। তখন তিনি ভাইকে বাসায় চলে যেতে বলেছিলেন। তখন হৃদয়ের কাছে তার স্বামী ইব্রাহিমের খোঁজ-খবরও নেন। এর আধা ঘণ্টা পর ইব্রাহিম স্ত্রী জিয়াসমিনকে মোবাইল করে হৃদয়ের মারা যাওয়ার কথা জানান। তখন জিয়াসমিন আবার হৃদয়ের মোবাইলে ফোন দেন। তখন একজন ফোন ধরে বলেন, মোবাইলটি রাস্তায় কুড়িয়ে পেয়েছেন।

জিয়াসমিন আক্তার জানান, তার ভাইয়ের আশা ছিল- লেখাপড়া করে চাকরি করবে। বাবা-মায়ের মুখে খাবার তুলে দিবে। কিন্তু সেই স্বপ্ন পুলিশ ধুলিস্যাত করে দিয়েছে। যারা তার ভাইকে হত্যা করেছে তাদের বিচার চান তিনি। দেশ স্বাধীনে যেন শহীদের খাতায় ভাইয়ের নাম থাকে এ দাবিও করেন তিনি। 

অপরদিকে, টাঙ্গাইলের কালিহাতী উপজেলার গোহালিয়াবাড়ী ইউনিয়নের আলীপুর গ্রামের আব্দুল হালিম ও আসমা খাতুন দম্পতির একমাত্র ছেলে শাহাদত হোসেন। তিনি পেশায় একজন ভেকু(খনন যন্ত্র) চালক ছিলেন। গত ৩ আগস্ট বিকালে বাড়ি থেকে বেড়িয়ে শাহাদত হোসেন ৪ আগস্ট ঢাকার শাহবাগ এলাকায় বৈষম্য বিরোধী ছাত্র আন্দোলনে যোগ দেওয়ার পর থেকে নিখোঁজ রয়েছেন। ছেলেকে পেতে সম্ভাব্য সব জায়গায় খোঁজাখুঁজি করেও তার কোনো সন্ধান পায়নি পরিবার। হাসপাতালগুলোর মর্গে মর্গে ঘুরেও মরদেহ পায়নি। 

শাহাদত হোসেনের অনুপস্থিতিতে তার পাঁচ মাসের কন্যা শিশু সানজিদার ভরণপোষণ ও ভবিষ্যত নিয়ে দুশ্চিন্তায় পড়েছেন স্ত্রী জিয়াসমিন। শাহাদতের সন্ধান, পরিবারটির পাশে বিত্তশালী ও সরকারকের দাঁড়ানোর আহŸান এলাকাবাসীর। 

এরই মধ্যে বাবার আদর থেকে বঞ্চিত দেড় মাসেরও বেশি সময় ধরে। আর কোন দিন বাবার আদর পাবে কিনা তা নিয়েও রয়েছে আশঙ্কা। বাবা না থাকায় এই শিশুকে নিয়ে মানবেতর জীবনযাপন করছেন মা জিয়াসমিন।

গত ৩ আগস্ট ঢাকার শাহবাগে আন্দোলনে যোগ দিতে বন্ধুদের সাথে বাড়ি ছাড়েন শাহাদত। ৪ আগস্ট দুপুরে সবশেষ অন্যের নম্বর থেকে মাকে ফোন করে জানান শাহবাগ থানা এলাকায় আন্দোলনে আছেন তিনি। সেখানে অনেক গোলাগুলি হচ্ছে। এরপর থেকে আর সন্ধান পাওয়া যায়নি শাহাদতের। যে নম্বর দিয়ে ফোন করেছেন সেটিও বন্ধ রয়েছে। সম্ভাব্য সব জায়গায় খোঁজাখুঁজি করেও তাকে পাওয়া যায়নি। ঢাকা মেডিকেল কলেজসহ বিভিন্ন হাসপাতালের মর্গেও তার মরদেহেরও সন্ধান মেলেনি।

শাহাদতের স্ত্রী জিয়াসমিন জানান, শাহাদত পেশায় ভেকু(খনন যন্ত্র) চালক ছিলেন। ভেকু গাড়িতে যাওয়ার কথা বলে বাড়ি থেকে বের হয়ে আন্দোলনে যোগ দিতে ঢাকায় যাচ্ছে শুনে শাহাদতকে ফিরে আসতে বলেন স্ত্রী জিয়াসমিন। তবে শাহাদত ফিরে না এসে আন্দোলনে যোগ দেন। এরপর থেকে তিনি নিখোঁজ রয়েছেন। স্বামীকে জীবিত অথবা তার মরদেহ একনজরে দেখতে চান তিনি।

শাহাদতের মা আসমা খাতুন জানান, ৩ আগস্ট সন্ধায় বাড়ি থেকে বের হয়ে যায় শাহাদত। পরের দিন ৪ আগস্ট দুপুরে অন্যের নম্বর থেকে ফোন করে জানান আন্দোলনে আছে সে। সেখানে অনেক গোলাগুলি হচ্ছে। এরপর থেকে ওই নম্বরটিও বন্ধ রয়েছে। এসব বলেই কান্নায় ভেঙে পড়েন আসমা খাতুন।

শাহাদতের বাবা আব্দুল হালিম জানান, শাহাতদের নানা বাড়ির লোকজন বিএনপি সমর্থিত হওয়ায় সেও বিএনপির লোকজনের সাথে চলাচল করতো। ৩ আগস্ট বিএনপির লোকজনের সাথেই ঢাকায় আন্দোলনে যোগ দিতে রওনা হয়। ৪ আগস্ট থেকে ছেলের সন্ধান না পেয়ে কালিহাতী থানায় জিডি করতে গেলে পুলিশ জিডি না নিয়ে কোন মেয়েলি ঘটনায় জড়িয়ে থাকতে পারে বলে জানান। পরে সেখান থেকে চলে এসে ঢাকা মেডিকেলসহ বিভিন্ন জায়গায় খোঁজাখুঁজি করেও তার কোন সন্ধান পাননি।

এলাকাবাসী জানায়, শাহাদত এলাকায় খুব মিশুক প্রকৃতির হিসেবে বেশ পরিচিত। তিন ভাই বোনের মধ্যে শাহাদত সবার বড়। ছোট দুই বোন রয়েছে। তার পাঁচ মাস বয়সী একটি মেয়ে রয়েছে। 

কালিহাতী উপজেলা নির্বাহী অফিসার (ইউএনও) শাহাদাত হুসেইন জানান, খবর পেয়ে ওই পরিবারকে ডেকে আর্থিক সহায়তা দেওয়া হয়েছে। এছাড়া ইতোমধ্যে তথ্য সংগ্রহ শুরু করা হয়েছে। নিখোঁজ শাহাদতকে খুঁজে পেতে তারা প্রশাসনিকভাবে জোর প্রচেষ্টা চালাচ্ছেন।

যাযাদি/ এসএম