দেড় মাসে পরিষদে এসেছেন তিনদিন, সেবা বঞ্চিত জনগণ  

প্রকাশ | ২১ সেপ্টেম্বর ২০২৪, ১৬:৫৪

হরিরামপুর (মানিকগঞ্জ) প্রতিনিধি
ছবি : যায়যায়দিন

মানিকগঞ্জের হরিরামপুরের দুর্গম চরাঞ্চলের আজিমনগর ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান আওয়ামী লীগ নেতা বিল্লাল হোসেনের বিরুদ্ধে এবার নিয়মিত অফিস না করার অভিযোগ উঠেছে। চেয়ারম্যান বিল্লাল হোসেন মাসে দুই থেকে তিন দিন অফিস করলেও সম্প্রতি প্রায় দেড় মাসে পরিষদে এসেছেন একদিন। এতে নাগরিক সনদ থেকে শুরু করে পরিষদের বিভিন্ন রকম নাগরিক সেবা থেকে এলাকার সাধারণ জনগণ বঞ্চিত বলে দাবী করেন এলাকাবাসী ও ইউপি সদস্যরা।

স্থানীয় সূত্রে জানা যায়, উপজেলার আজিমনগর ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান ও ইউনিয়ন আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক মো. বিল্লাল হোসেন ২০১৬ সালে আওয়ামী লীগ মনোনীত নৌকা প্রতীক নিয়ে চেয়ারম্যান নির্বাচিত হন। এরপর থেকেই তার ইউনিয়নে দলীয় প্রভাব বিস্তারে গড়ে তোলেন নিজস্ব বলয়। ভূমি দখল থেকে শুরু করে বিভিন্ন অনিয়ম ও দুর্নীতির অভিযোগে আলোচনায় উঠে আসে এই আওয়ামী লীগ নেতা বিল্লাল হোসেন। দলীয় প্রভাবে নিজের খেয়াল খুশি মতো দাপটের সাথে পরিচালনা করেন ইউনিয়ন পরিষদ। নিজস্ব লোকদের দিতেন যাবতীয় সুযোগ সুবিধা। দীর্ঘ প্রায় আট বছর যাবৎ  তার ভয়ে এলাকাবাসী যেন অনেকটাই জিম্মি হয়ে পড়েন।

এছাড়া নিয়মিত পরিষদে না আসায় ইউনিয়ন পরিষদের সেবা থেকে বঞ্চিত হন ইউনিয়নবাসী। ভয়ে কেউ এর প্রতিবাদ করার সাহস পায়নি। মাসের পর মাস ঢাকায় বসবাস ও ব্যবসা বানিজ্য পরিচালনা করায় পরিষদের মেম্বারদের নিয়ে বছরে একটা মিটিং না করারও অভিযোগ করেন অনেক মেম্বাররা। মাসে দুই একবার এলাকায় আসলেও কখনও পরিষদে বসেননি। বাজারে বসেই দাপ্তরিক কাজ শেষ করে আবার ঢাকায় চলে যেতেন বলেও স্থানীয় সূত্রের দাবি।

চেয়ারম্যানের ঘনিষ্ঠ মেম্বার ব্যতিত বাকি মেম্বারদেরও কোনো কাজ দেয়া হয়নি বলেও অভিযোগ করে অনেক মেম্বাররা।

গত ৫ আগস্ট বৈষম্য বিরোধী ছাত্র- জনতার আন্দোলনে আওয়ামী সরকারের পতনের পর ফুসে উঠে এলাকার জনগণ। সামনে আসে বিল্লাল চেয়ারম্যানের আট বছরের ক্ষমতা অপব্যবহারের ফিরিস্তি। আওয়ামী সরকার পতনের প্রায় দেড় মাস অতিবাহিত হলেও এখন পর্যন্ত পরিষদে আসেননি চেয়ারম্যান বিল্লাল হোসেন। ফলে পরিষদের বিভিন্ন সেবা থেকে বঞ্চিত হচ্ছেন  ইউনিয়নবাসী।

ইউনিয়নের ভাগডাঙ্গি গ্রামের ভুক্তভোগী শফিক মৃধা জানান, প্রায় পনের দিন আগে আমার ছেলের একটা সার্টিফিকেট দরকার ছিল। কিন্তু চেয়ারম্যান না থাকায় সে সার্টিফিকেট পাইনি। চেয়ারম্যানের ভাইয়ের কাছে গেলে সে বলছে স্বাক্ষর করা নাই। এখন দেয়া যাবে না। চেয়ারম্যান ঢাকায় ব্যবসা করার কারণে কখনও নিয়মিত পরিষদে আসে নাই। পরিষদ চালাইছে তার ভাই মোশাররফ হোসেন মুসা। এখন তো পরিষদের কাজ একেবারেই বন্ধ। সচিবও ঠিক মতো আসে না, চেয়ারম্যানও আসে না।

জালালদি গ্রামের আল আমিন সরদার জানান, আগস্টের ৫ তারিখের পর থেকে পরিষদের কার্যক্রম সম্পূর্ণ বন্ধ। চেয়ারম্যান বা সচিব কেউই আসে না। একটা সার্টিফিকেটের দরকার হলে আমরা পাই না।  এর আগে একটা সার্টিফিকেটের জন্য ৫০০-১০০০ টাকা নিয়েও মাসের পর মাস ঘুরতে হয়েছে। চেয়ারম্যান কখনোই নিয়মিত পরিষদে আসতেন না। এজন্য জনগণের অনেক ভোগান্তি পোহাতে হচ্ছে।

একই গ্রামের বাবলু জানান, শেখ হাসিনার পতনের পর থেকে সে আজ পর্যম্ত অফিসে আসে নাই। এর আগেও মাসে এক/ দুই দিন অফিস করছে। আমরা তার নির্বাচন করি নাই বলে একটা সার্টিফিকেট আনতে গেলেও আমাদের দেয় না। চেয়ারম্যানের সব কাজ করে তার ভাই মোশারফ হোসেন মুসা।

৮নং ওয়ার্ড মেম্বার রাছেল মৃধা জানান, চেয়ারম্যান তো নিয়মিত ঢাকায় থাকেন। অফিস কি জিনিস তা তিনি বোঝেনই না। আমি দুই টার্ম ধরে মেম্বার। দুই টার্মে দুই দিন মিটিং করেছি। আমাদের কোনো মিটিং এ ডাকে না। আর সচিব হলো চেয়ারম্যানের অনুগত। চেয়ারম্যান যখন বাড়ি আসে তখন সচিব আসে। চেয়ারম্যানের অনেক স্বাক্ষর সচিবই করে দেয়।

৩নং ওয়ার্ডের মেম্বার মো. জাহাঙ্গীর শিকদার জানান, আট বছরে চেয়ারম্যান মাসে ১/২ বার আসছে। কোনো মাসে আসেও নাই। আর ৫ আগস্টের পরে একদিন এলাকায় আসছিল শুনছি । তারপর থেকে এখন পর্যন্ত আর পরিষদে আসেন নাই। অফিসও করে নাই। মূলত চেয়ারম্যানী করে তার ভাই মুসা। সাথে থাকে তার অনুসারী ২/৩ জন মেম্বার। আমরা অধিকাংশই তার কার্যকলাপে পরিষদে যাই না। চলতি টার্মের প্রায় তিন বছরে মাত্র ২টা মিটিং এ আমরা ছিলাম। আর কোনো মিটিং হয় নাই। মিটিং হলেও আমাদের জানায় না। এর আগে বছরে তো একটা মিটিংও করতো না।

৬নং ওয়ার্ডের মেম্বার হায়দার আলী তালুকদার জানান, চেয়ারম্যানের ঢাকায় ব্যবসা আছে। উনি প্রতিমাসে মাসিক মিটিং এ আসতেন। এছাড়াও তিনি মাসে ৩-৪ বার এলাকায় আসতেন। বাকি দায়িত্ব প্যানেল চেয়ারম্যান পালন করতেন।

১নং ওয়ার্ডের মেম্বার মো. আলমগীর জানান, আমি তো সব সময় চেয়ারম্যানের সাথে থাকতে পারি না। তবে সে প্রতিমাসে ২-৩ বারের বেশি আসে। কোনো কোনো মাসে একবারও আসে। বিচার শালিশ বেশি থাকলে বেশি আসা পড়ে।

৪,৫,৬ নং ওয়ার্ডের সংরক্ষিত নারী সদস্য আমেনা বেগম জানান, চেয়ারম্যান মাসে একবার করে পরিষদে আসতেন। কোনো মাসে দুই তিনবার আসতেন। তবে চেয়ারম্যানের অনুপস্থিতিতে সব কাজ করতেন তার ভাই মোশারফ হোসেন মুসা। তবে শেখ হাসিনা পতনের পর দেড় মাসে তিনি তিনবার পরিষদে এসেছেন।

এব্যাপারে জানতে, ইউপি সচিব মোহাম্মদ আলীর মুঠোফোনে একাধিকবার কল দিয়েও যোগাযোগ করা সম্ভব হয়নি।

মুঠোফোনে আজিমনগর ইউপি চেয়ারম্যান মো. বিল্লাল হোসেন জানান, আমার মায়ের অসুস্থতার কারণে তাকে নিয়ে ঢাকায় এসেছি। অন্যথায় আমি নিয়মিত'ই অফিসে বসি। আমার বিরুদ্ধে আনিত অভিযোগ মিথ্যা।

এবিষয়ে মুঠোফোনে উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা মো. শাহরিয়ার রহমান বলেন, এবিষয়ে আমাদের কাছে কেউ অভিযোগ দেয়নি। আপনার মাধ্যমেই বিষয়টি জানতে পারলাম। খোঁজ নিয়ে, অভিযোগের সত্যতা পেলে। উর্ধতন কর্তৃপক্ষ কে জানিয়ে তার বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া হবে।

যাযাদি/ এম