বৃহস্পতিবার, ১৯ সেপ্টেম্বর ২০২৪, ৪ আশ্বিন ১৪৩১
সাবেক ডিএমপি কমিশনার গোলাম ফারুকের বিরুদ্ধে হত্যা মামলা 

আড়াই হাজার কোটি টাকা বিদেশে পাচার

যাযাদি রিপোর্ট/ স্টাফ রিপোর্টার, টাঙ্গাইল
  ১৮ সেপ্টেম্বর ২০২৪, ১৪:২২
ফাইল ছবি

ঢাকা মহানগর পুলিশের সাবেক কমিশনার ও সাবেক অতিরিক্ত আইজিপি খন্দকার গোলাম ফারুকের বিরুদ্ধে অবৈধপন্থায় ৩ হাজার কোটি টাকা উপার্জিত অর্থের আড়াই হাজার কোটি টাকা বিদেশে পাচারের অভিযোগ এখন দুর্নীতি দমন কমিশনে(দুদক)।

এছাড়া ঢাকার সিএমএম আদালতে তার নামে একটি হত্যা মামলা দায়ের করা হয়েছে। আদালত মামলাটি আমলে নিয়ে কোতওয়ালী থানাকে এফআইআর হিসেবে গ্রহণ করার নির্দেশ দিয়েছেন। তিনি টাঙ্গাইলের ভূঞাপুর পৌরসভার ঘাটান্দি এলাকার মৃত খন্দকার হায়দার আলীর ছেলে।

টাঙ্গাইল ও ঢাকার পাঁচ ব্যক্তির সমন্বয়ে রোববার (২৮ জুলাই) দুর্নীতি দমন কমিশনের প্রধান কার্যালয়ে চেয়ারম্যানের কাছে দেওয়া অভিযোগে প্রকাশ, খন্দকার গোলাম ফারুক চাকরি অবস্থায় ক্ষমতার প্রভাব খাটিয়ে অবৈধ ভাবে দেশের প্রত্যন্ত অঞ্চল থেকে প্রায় ৩ হাজার কোটি টাকা হাতিয়ে নেয়। তিনি প্রথমে বাংলাদেশি নাগরিক দ্বিতীয়ত আমেরিকার নাগরিক (গ্রীন কার্ডধারী)। সাবেক ডিএমপি কমিশনার খন্দকার গোলাম ফারুকের স্ত্রীর ভাই-বোনেরা আমেরিকার নাগরিক। তারা সেখানে স্থায়ীভাবে বসবাস করেন।

গোলাম ফারুক নিজে এবং তার আত্মীয়দের দিয়ে তার অবৈধভাবে হাতিয়ে নেওয়া দুই হাজার ৫০০ কোটি টাকা আমেরিকায় বসবাসরত স্ত্রীর ভাই-বোনদের কাছে পাচার করেছেন। দেশের বিভিন্ন স্থানে প্রায় ৫০০ কোটি টাকার স্থাবর, অস্থাবর সম্পদ ও নগদ টাকা রয়েছে। কৌশলগত কারণে এই সম্পদ ও নগদ টাকাগুলো নিকট আত্মীয়-স্বজনদের নামে এবং বিভিন্ন ব্যাংক একাউণ্টে রেখেছেন।

সরেজমিনে জানা যায়, সাবেক ডিএমপি কমিশনার খন্দকার গোলাম ফারুকরা চার ভাই। অন্য তিন ভাইয়েরা হচ্ছেন- খন্দকার হাবিবুর রহমান সেলিম, খন্দকার সুরুজ, খন্দকার ফিরোজ ওরফে কালু। ভূঞাপুর পৌরসভার ৯নং ওয়ার্ডের কাউন্সিলর ও প্যানেল মেয়র খন্দকার জাহিদ অতিরিক্ত আইজিপি(অব.) খন্দকার গোলাম ফারুকের চাচাত ভাই। মূলত: তার মাধ্যমেই স্থানীয় পর্যায়ে প্রভাব খাটিয়েছেন এবং বিভিন্ন স্থানে সম্পদের পাহাড় গড়ে তুলেছেন।

খন্দকার গোলাম ফারুকের দুর্নীতির টাকার অংশ বিশেষ দিয়ে তার বাবা খন্দকার হায়দার আলীর বাড়িতে তিনতলা বিশিষ্ট আধুনিক বাড়ি এবং কয়েক বিঘা জমির উপর ঘাটান্দি আলহাজ্ব খন্দকার হায়দার আলী মেমোরিয়াল উচ্চ বিদ্যালয় প্রতিষ্ঠা করেছেন।

সেখানে আলহাজ্ব খন্দকার হায়দার আলী স্মৃতি কল্যাণ সংস্থাও রয়েছে। তার চাচা খন্দকার আশরাফকে ২০ লাখ টাকা দিয়ে একটি যাত্রীবাহী বাস কিনে দেন এবং ‘খন্দকার বাড়ি’ নামে ১ কোটি টাকায় একটি বাড়ি তৈরি করে দেন। তার অনিয়ম-দুর্নীতির টাকা ব্যবহারের অন্যতম হাতিয়ার ভূঞাপুর পৌরসভার প্যানেল মেয়র খন্দকার জাহিদকে পাঁচতলা বাড়ি, ৪টি ট্রাক গাড়ি, ১টি প্রাইভেটকার, ১টি ইটভাটা ছাড়াও ভূঞাপুরে প্রায় ৫ কোটি টাকার জমি কিনে দেন।

স্থানীয় সূত্রে জানা যায়, অবসরপ্রাপ্ত অতিরিক্ত আইজিপি’র ভাই খন্দকার হাবিবুর রহমান সেলিম এবং তার স্ত্রীর নামে প্রায় ৩০ কোটি টাকা মূল্যের জমি কিনেছেন। এছাড়া তার নামে বিভিন্ন ব্যাংক একাউণ্টে নগদ ৫০ লাখ টাকা জমা রেখেছেন। ভূঞাপুর বাসষ্ট্যান্ডে তার অপর ভাই খন্দকার সুরুজকে প্রায় ৩ কোটি টাকা দিয়ে মোটর গাড়ির পার্টসের দোকান করে দিয়েছেন। সুরুজ এবং তার স্ত্রীর নামে ২৫ কোটি টাকার জমি কিনে দিয়েছেন এবং তাদের বিভিন্ন ব্যাংক একাউন্টে ১ কোটি টাকা জমা রেখেছেন। তার সহোদর খন্দকার ফিরোজ ওরফে কালুর নামে ভূঞাপুর উপজেলায় ২ কোটি টাকা মূল্যের জমি কিনেছেন।

এছাড়া তার(কালুর) একাধিক একাউন্টে প্রায় ৪০ লাখ টাকা জমা রেখেছেন। সাবেক ডিএমপি কমিশনার খন্দকার গোলাম ফারুকের ছোট বোনের স্বামী ও মধুপুর শাহীদ স্মৃতি উচ্চ বিদ্যালয়ের সাবেক অধ্যক্ষ মো. বজলুর রশিদ খান চুন্নুর নামে ময়মনসিংহ শহরে একটি বাড়ি, মধুপুরে একটি বাড়ি এবং টাঙ্গাইল শহরে একটি বাড়ি কিনেছেন। এছাড়া তার নামীয় বিভিন্ন একাউণ্টে ২ কোটি টাকা জমা রেখেছেন। এছাড়াও সুচতুর সাবেক অতিরিক্ত আইজিপি খন্দকার গোলাম ফারুক আরও অনেক আত্মীয়দের নামে জমি কিনেছেন এবং তাদের নামে বিভিন্ন একাউণ্টে মোটা অংকের টাকা জমা রেখেছেন।

দুদকে দেওয়া অভিযোগপত্রে উল্লেখ করা হয়েছে, তিনি ডিএমপি কমিশনার থাকাকালে চাকুরির শেষ সময়ে ঢাকায় তার এবং স্ত্রীর নামে বাসা ও ফ্ল্যাট বাড়ি এবং জমি কেনার অভিযোগ রয়েছে। তার আত্মীয়দের দিয়ে অনেক কোম্পানীর শেয়ার কিনেছেন। এছাড়া অজ্ঞাত ব্যক্তি ও আত্মীয়দের নামে জমি ক্রয় এবং বিভিন্ন ব্যাংক একাউণ্টে নগদ টাকা রেখেছেন।

সূত্রমতে, তার আত্মীয় পুলিশ কর্মকর্তা খন্দকার মো. ইসমাইলের নামে ঢাকার খিলক্ষেতে একটি ফ্ল্যাট(মূল্য ১ কোটি ২০ লাখ টাকা) রয়েছে। নিজ এলাকায় প্রায় ৩ কোটি টাকার জমি ক্রয়সহ বাসা-বাড়ি তৈরি করেছেন। ভাতিজি খন্দকার মিশুর নামে ভূঞাপুরে তিনতলা বিশিষ্ট একটি আধুনিক মডেল বাড়ি (মূল্য জমিসহ ৪ কোটি টাকা) রয়েছে। ঢাকায় ১ কোটি ২৫ লাখ টাকা মূল্যের একটি ফ্ল্যাট কিনেছেন।

এ বিষয়ে ঢাকা মহানগর পুলিশের সাবেক কমিশনার ও সাবেক অতিরিক্ত আইজিপি খন্দকার গোলাম ফারুক জানান, তার বিরুদ্ধে দুদকে দেওয়া অভিযোগ সম্পূর্ণ মিথ্যা ও বানোয়াট। তাকে অহেতুক হয়রাণির জন্য অভিযোগটি দেওয়া হয়েছে। আদালতে মামলার বিষয়ে তিনি জানান, মামলার আবেদন করা হয়েছে- মামলা হয়নি। প্রাথমিক অভিযোগ গ্রহণ করে আদালত থানাকে এফআইআর নেওয়ার নির্দেশ দিয়েছেন। বর্তমান পরিস্থিতিতে যে কারও নামে অভিযোগ হতে পারে- তাই বলে তিনি অপরাধী হবেন, এমনটা নয়।

সূত্রে প্রকাশ, ১৯৯৩ থেকে ১৯৯৫ সাল পর্যন্ত চট্রগ্রাম মেট্রোপলিটনে এসি হিসেবে যোগদান করে বিভিন্ন আভিযানের মাধ্যমে অপরাধ দমনের নামে প্রায় ২০০ কোটি টাকা হাতিয়ে নেন। এরপর ২০০৪-২০০৬ সাল পর্যন্ত ঠাকুরগায়ে পুলিশ সুপার হিসেবে দায়িত্ব পালন কালে ১৫০ কোটি টাকা অবৈধভাবে হাতিয়ে নেন।

২০০৯ সাল থেকে ২০১২ সাল পর্যন্ত ময়মনসিংহে পুলিশ সুপার থাকাকালে ক্ষমতার প্রভাব খাটিয়ে প্রায় ৩০০ কোটি টাকা অবৈধভাবে হাতিয়ে নেন। রংপুর রেঞ্জ ডিআইজি’র দায়িত্ব পালনকালে ৫০০কোটি টাকা হাতিয়ে নেন।

ডিএমপি কমিশনার হিসেবে দায়িত্ব নেওয়ার পর তিনি বেপরোয়া হয়ে পড়েন। তিনি চাকুরির শেষ সময়ে বেপরোয়া হয়ে অবৈধ ক্ষমতা খাটিয়ে ১৪৫০ কোটি টাকা হাতিয়ে নেন। তিনি অবৈধ পন্থায় উপার্জিত টাকাগুলোর মধ্য থেকে দুই হাজার পাঁচশত কোটি টাকা আমেরিকায় পাচার করে দিয়েছেন। তিনি স্ত্রী শারমীন আক্তার খানের নামে জমি, বাসা কিনেছেন এবং তার একাধিক একাউন্টে নগদ টাকা জমা রেখেছেন। ময়মনসিংহেও তার স্ত্রী এবং নিজ নামে প্রচুর জমি কিনেছেন। চট্টগ্রাম রেঞ্জ ডিআইজির দায়িত্ব পালনের সময়ে চট্টগ্রামের বিভিন্ন জেলা ও থানায় তার নিজ নামে এবং স্ত্রীর নামে জমি এবং বাসা কেনার অভিযোগ রয়েছে।

উল্লেখ্য, অতিরিক্ত আইজিপি খন্দকার গোলাম ফারুক ২০২২ সালের ২৯ অক্টোবর ডিএমপির ৩৫তম কমিশনার হিসেবে যোগদান করে ২০২৩ সালের ৩০ সেপ্টেম্বর অবসরে যান। চাকুরিকালিন জীবনে তিনি ১৯৯৩ সালে সহকারী পুলিশ সুপার হিসেবে বগুড়ায় যোগদান করেন। পরে চট্টগ্রাম মহানগরের এসি(সহকারী কমিশনার), ঠাকুরগাঁয়ের পুলিশ সুপার, ময়মনসিংহের পুলিশ সুপার, রংপুর রেঞ্জের ডিআইজি, চট্টগ্রাম রেঞ্জের ডিআইজি এবং সর্বশেষ অতিরিক্ত পুলিশ মহাপরিদর্শক(অতিরিক্ত আইজিপি) ও ঢাকা মহানগর পুলিশ কমিশনার(ডিএমপি) হিসেবে দায়িত্ব পালন করে অবসর গ্রহণ করেন।

যাযাদি/ এস

  • সর্বশেষ
  • জনপ্রিয়

উপরে