জীবনের তাগিদে লাশ টানেন শাহীদ মিয়া

প্রকাশ | ২২ জুন ২০২৪, ১২:১১

শফিউল আলম লাভলু, নকলা (শেরপুর) প্রতিনিধি
ছবি-যায়যায়দিন

ঝড়-বৃষ্টি-কাঁদা, রাত-দিন যাই হোক, ডাক পেলেই লাশ নিয়ে ছুটে চলতে হয় বন-জঙ্গলে, থানায়, মর্গে বা নিহতের বাড়িতে। সাধারণত অস্বাভাবিক মৃত্যু, হত্যা, দুর্ঘটনা হলেই ডাক পড়ে শাহীদ ফরাজি। সৎ ভাবে অর্থ উপার্জন করলে সমাজে কোন পেশাই ছোট নয়। জীবনে বেঁচে থাকার জন্য চাই অন্ন, বস্ত্র, বাসস্থান। চাই শিক্ষা, চিকিৎসার অধিকার। আর এর জন্যই মানুষের আজীবনের সংগ্রাম করে থাকে। এই জীবন সংগ্রামের চক্রে নিরন্তর ঘুরপাক খাওয়া শাহীদ ফরাজি বেছে নিয়েছেন লাশ টানার এক বিচিত্র পেশা। আয়ের একমাত্র অবলম্বন ভ্যান নিয়ে ছুটে যান ঘটনাস্থলে। তারপর লাশ নিয়ে পৌঁছান শেরপুর সদর হাসপাতাল মর্গে। ডোমের কাটাছেঁডা লাশ নিয়ে আবার পাড়ি জমান নিহতের আত্মীয়-স্বজনের কাছে। এ ভাবেই শতশত লাশ নিয়ে এপার-ওপার করেছেন তিনি।

শাহীদ ফরাজির বাড়ি শেরপুরের নকলা উপজেলার গড়েরগাও এলাকায়। দীর্ঘ প্রায় ১০ বছরের পেশাগত জীবনে লাশ টেনেছে প্রায় ২৫শ থেকে ৩ হাজার। এলাকায় কোন দুর্ঘটনা বা অপমৃত্যু কিংবা খুন হলেই তার ডাক পড়ে। রাত-দিন তার কাছে সবই সমান। ঘটনাস্থল থেকে লাশ নিয়ে থানায় আসে। তারপর জেলা সদরের মর্গে। ময়নাতদন্ত শেষে সেই কাটাছেঁড়া লাশ নিয়ে আবার ফিরে আসে।

লাশ বাহক শাহীদ ফরাজি জানান, দীর্ঘ ১০ বছর লাশ টানার কাজ করা নিয়ে তার হয়েছে বিচিত্র অভিজ্ঞতা আর অনুভূতি। লাশ যতো গলিতই হোক না কেন তার কাছে তা আমানত। প্রথম প্রথম লাশ টানতে ভয় লাগতো। একটু নির্জন স্থানে কিংবা আঁধার নামলে গা ছমছম করতো। এখন আর এমনটি হয় না। লাশের প্রতি শাহীদ ফরাজির খুব মমতা। শিশুদের লাশ টানতে গিয়ে তার চোখে জল এসে যায়। কোন কোন সময় লাশের পাশে বসেই তাকে রাত কাটাতে হয়। ক্ষুধা লাগলে সেখানেই বসে খেতে হয়।

তিনি আরো জানান, ভ্যানটি থাকাবস্থায় লাশ টানা ভ্যান বলে সেই ভ্যানে কোন মানুষ উঠতো না। ফলে লাশ টানার কাজ না থাকলে তাকে বসেই থাকতে হতো। প্রতিমাসে গড়ে ৪/৫টি লাশ টানতে হয় তাকে। লাশ টেনে যে টাকা পায় তা দিয়েই কোনমতে চলে তার সংসার। ২ ছেলে মানিক (২০) ও স্বপন (১৩) এবং দুই মেয়ে তানিয়া আক্তার (২৪) ও মিম আক্তার (১৪)। স্ত্রী বানেছা বেগম তার সুখ-দুঃখের সাথী। অভাবের কারণে ছেলে মানিককে লেখাপড়া করাতে পারেননি। তাই মানিক শাহীদের সাথে লাশ টানতে সহযোগিতা করেন। না দিয়ে গ্যারেজে কাজ শেখাচ্ছেন।

স্ত্রী বানেছা বেগম জানান, বিয়ের পর লাশ টানার কারণে ভয়ে বাড়ি ছেড়ে কয়েক বার পালিয়ে বাবার বাড়ি চলে গিয়েছিলাম। আবারও তিনি নিয়ে এসেছেন। এরপর ধীরে ধীরে সব ঠিক হয়ে গেছে। 

শাহীদ ফরাজি দুঃখ করে বলেন, অনেক লাশ টেনে টাকা পাইনি। অনেকে কম দেয়। আবার বেওয়ারিশ লাশ ফ্রি টানতে হয় শাহীদের। তবুও লাশের খবর পেলে সবকিছু ভুলে যায়।

বঙ্গবন্ধু শিক্ষা ও গবেষণা পরিষদের সভাপতি মাহবুবুল আলম বিদ্যুৎ জানান, লাশ বাহক শাহীদের আর্থিক অবস্থা ভাল না। তাই তার ছোট মেয়ে মিম আক্তারের পড়লেখা খরচ আমি চালিয়ে যাচ্ছি। আমি চাই মিম সুশিক্ষায় শিক্ষিত হোক। তাই শাহীদের পাশে দাড়িয়েছি। সাংবাদিক মিন্টু খন্দকার বলেন, লাশ টানেন বলে তাকে কেই ঘৃণা করেন না। প্রতিবেশীদের নানা উপকারে তিনি কাজ করে। লাশ টানতে গিয়ে কারো মনে কখনো কস্ট দিতে দেখিনি শাহীদকে। তিনি অত্যন্ত ভাল মনের মানুষ। ঝড়, বৃস্টি ও রোধের মধ্যেও তাকে লাশ টানতে দেখা যায়। লাশ টানা শাহীদেন পেশা হলেও এলাকার মানুষ তাকে অন্যান্যেদের মতোই দেখে।

নকলা থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) মো. আব্দুল কাদের মিয়া জানান, লাশ টানার এ পেশায় কেউ আসতে চায় না। পঁচা, দুগর্ন্ধ এমনকি বিকৃত নানা ধরনের লাশ মর্গে নিয়ে যাওয়া-আসা করতে হয়। সরকারি ভাবে এর কোন বেতন-ভাতা দেয়া হয় না। লাশের খবর পেলেই শাহীদ ফরাজি হয়ে উঠে দায়িত্বশীল। জীবনের তাগিদে লাশের প্রতি এ রকম মমতা নিয়ে লাশ বহন করে চলেছে।পঁচা, দুগর্ন্ধযুক্ত লাশ থানার বাইরে নিয়ে সারারাত বসে থাকতে হয়। একটি লাশ বহন করে গড়ে ২ থেকে ৩ হাজার টাকা পর্যন্ত তিনি পেয়েছেন। লাশ টানার পাশাপাশি থানার ফুট ফরমায়েশও খেটে থাকে। বিভিন্ন মামলার আলামত সংগ্রহ, সংরক্ষণ করে বলে থানার বাবুরা কিছু বকশিষ তার হাতে ধরিয়ে দেয়। এ ভাবেই চলে তার জীবন সংগ্রাম। ভয় তাকে স্পর্স করতে পারেনি ঠিকই কিন্তু বিচিত্র পেশার এ মানুষটি। লাশ টানা তার বাপ-দাদার পেশা না হলেও শাহীদ ফরাজি বেছে নিয়েছেন লাশ টানার এই বিচিত্র পেশা।

মৃতদেহ নিয়ে নানান কুসংস্কার আর অজানা ভয় তাকে স্পর্শ করতে পারেনি। তবে দারিদ্ররের নিষ্ঠুর দলন-পেষন মাঝে মধ্যে তাকে স্ত্রী-সন্তান সংসার নিয়ে ভীত করে তোলে। সৎ মা বাবার কাছ থেকে সব জমি লিখে নিয়ে সৎ ভাইদের দিয়েছে। অবশিস্ট আমার জন্য কিছুই রাখেনি। এখন শাহীদ তার ছোট ভাই রাকিবের জায়গাতে ছোট একটি ঘর করে কোন মত ছেলে-মেয়ে নিয়ে থাকতে হচ্ছে। এ অবস্থায় সরকারের কাছে জমিসহ ঘর দাবি করেন তিনি। যদি একটু জায়গা জমি পেতেন সমাজের জন্য অত্যন্ত জরুরি এ পেশার মানুষটি কিছুটা স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলতে পারতেন।

যাযাদি/ এসএম