বিসিএস ক্যাডার হয়ে বাবার স্বপ্ন পূরণ করলেন পিংকি রানী মজুমদার 

প্রকাশ | ২২ আগস্ট ২০২৩, ১১:৩২

মোহাম্মদ মাসুদ মজুমদার, বরুড়া প্রতিনিধি

বিভিন্ন চাকুরির প্রিলি পরীক্ষা দিয়েই যাচ্ছিলেন কিন্তু কোন প্রিলিই পাস করতে পারছিলেননা। একটি নয় দুইটিও নয় একের পর এক ৩৬টি বিভিন্ন চাকুরির পরীক্ষার প্রিলি পাস করতে পারেননি। কিন্তু হার মেনে নেননি, দমেও যাননি। তার কাছে NO মানে Next Opportunity. তার চেষ্টা অব্যাহত রেখেছিলেন এবং দৃঢ় প্রতিজ্ঞ ছিলেন যে অবশ্যই পারবেন, অবশ্যই সফল হবেন। অবশেষে ৩৭ নম্বর চাকুরির পরীক্ষায় প্রথমবারের মত প্রিলি পাস করেন। এরপর থেকে মোটামুটি সকল প্রিলি পরীক্ষায় পাস করতে থাকেন। তারই ধারাবাহিকতায় ৩৮তম বিসিএস এর প্রিলিমিনারি পাস করেন। ধীরে ধীরে আত্মবিশ্বাস ফিরে আসে। ৩৮তম বিসিএস এ নন-ক্যাডার তালিকায় জায়গা পান। কিন্তু দু:খ তখনো রয়ে গিয়েছিলো কারন ক্যাডার হতে পারেনি। চেষ্টা অব্যহত থাকে, ৪১তম বিসিএস শেষ বিসিএস। অবশেষে ৪১তম বিসিএস বন ক্যাডারে সুপারিশ প্রাপ্ত হোন। হ্যাঁ, ৪১তম বিসিএস এ সুপারিশ প্রাপ্ত পিংকি রানী মজুমদারের গল্প বলছি। 

পিংকি রানী মজুমদার, ৪১তম বিসিএসে (বন) ক্যাডারে সুপারিশপ্রাপ্ত হয়েছেন। তার বাবা দুলাল চন্দ্র মজুমদার, যিনি দীর্ঘ দিন প্রবাসে ছিলেন। মা মমতা রানী মজুমদার একজন গৃহিনী। পিংকি রানী মজুমদার কুমিল্লা জেলার বরুড়া উপজেলার শাকপুর ইউনিয়নের জাগুরিয়া (ধলিরপাড়) গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন। তার ছোটবেলা থেকে বেড়ে উঠা বরুড়া পৌরসভার অফিসপাড়ায়। স্নাতক ও স্নাতোকত্তর পাস করেন রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের উদ্ভিদ বিজ্ঞান বিভাগ থেকে। 

পিংকি রানী মজুমদার শৈশব ছিলো দুরন্ত। পড়াশোনায় অমনোযোগী ছিলেন। দুষ্টামি আর খেলাধুলা নিয়ে কেটে যেতো সারা বেলা। দুষ্টামি কারনে মামার বাড়ি পাঠিয়ে দেয় পড়াশোনার জন্য। সেখানে আন্টিদের শাসন বারনের মাঝেও ছিলো পড়াশোনা, দুষ্টামি, দুরন্ত শৈশব। 

নিজ উপজেলার গালিমপুর সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় থেকে পঞ্চম শ্রেণি শেষ করে বরুড়া সরকারি বালিকা উচ্চ বিদ্যালয়ে ষষ্ঠ শ্রেণিতে ভর্তি হোন। সেখান থেকে ২০০৬ সালে এসএসসি পাস করেন। অতপর বরুড়া শহীদ স্মৃতি সরকারি কলেজ থেকে ২০০৮ সালে এইচএসসি পাস করেন। এরপর রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের উদ্ভিদ বিজ্ঞান থেকে ২০১৫ সালে স্নাতকে প্রথম শ্রেণিতে তৃতীয় স্থান এবং ২০১৬ সালে স্নাতোকত্তরে প্রথম শ্রেণিতে দ্বিতীয় স্থান অর্জন করে পড়াশোনা শেষ করেন। 

পিংকির বাবা দীর্ঘদিন প্রবাসে থাকার পর দেশে যখন একেবারে চলে আসেন এরপর থেকে অর্থ সংকট দেখা দেয়। তখন বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হোন। অনেক কষ্টকরে তার বাবা পড়াশোনার খরচ চালিয়ে ছিলেন। বিশ্ববিদ্যালয়ের পড়ালেখা শেষ করে যখন চাকুরির প্রস্তুতি নেন তখন অর্থ সংকট প্রকট আকার ধারন করে। কোচিং করা, চাকুরির বই কিনা, চাকুরিতে আবেদন করা, ঢাকা গিয়ে চাকুরির পরীক্ষা দেয়া পিংকি জন্য অনেক কষ্টকর ছিলো। পিংকি বাবা কোন না কোন ভাবে টাকা ম্যানেজ করে নিতেন। তাই দৃঢ় প্রতিজ্ঞ করেছিলেন ভালো একটি চাকুরী পেতেই হবে। বাবার কষ্ট দূর করতেই হবে। লক্ষ্যের প্রতি অবিচল ছিলেন। প্রিলিমিনারির জন্য বাজারের একটি বইয়ের সিরিজ অনুসরণ করেন সেই সাথে কোচিং করেন এবং নিয়মিত নোট করে পড়াশোনা করেন। প্রতিটি বিষয়ের জন্য সুনিদির্ষ্ট পরিকল্পনা করে সামনে এগিয়েছি। সব সময় রুটিনমাফিক পড়াশোনা করার চেষ্টা করেছেন।  

২০১৬ সালে জুলাই মাসে মাস্টার্স শেষ করেন। যেহেতু ডিপার্টমেন্টে পজিশন ছিলেন তাই ভেবেছিলেন বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক হবো। সেজন্য চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়, জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয় ও বরিশাল বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষক পদে ভাইভা দিয়েছিলেন কিন্তু চাকুরি হয়নি। বুঝতে পেরেছেন বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক হওয়ার জন্য আরো কিছু যোগ্যতা লাগে। কিছুটা হতাশ হলেন। তখন বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক হবার চিন্তা বাদ দিয়ে সিদ্ধান্ত নিলেন বিসিএস ক্যাডার হবেন। ৩৮তম বিসিএস এ লক্ষ্য স্থির করে পড়াশোনা শুরু করেন। বিশ্ববিদ্যালয়ের চাকুরীর প্রত্যাশা থাকার কারণে চাকুরির প্রস্তুতি কিছুই ছিলো না। কিভাবে শুরু করবেন কিছুই বুঝতে পারছেন না। কাছের এক বড় ভাইয়ের কাছ থেকে পরামর্শ নিয়ে ধীরে ধীরে প্রস্তুতি নেয়া শুরু করেন। 

 প্রথমে জব সল্যুশন পড়া শুরু করলেন। ফলে বিসিএস প্রশ্ন সম্পর্কে সুস্পষ্ট ধারণা পান। প্রস্তুতি নিতে গিয়ে বুঝতে পারলেন গণিত এবং ইংরেজীতে অনেক দুর্বলতা। দুর্বলতা কাটিয়ে উঠার জন্য এই দুই বিষয়ে আরও দ্বিগুণ সময় দিয়েছেন। 

এরপর লিখিত পরীক্ষার প্রস্তুতি নিতে শুরু করেন। প্রস্তুতি নেয়ার সময় সাইফুল ইসলাম সুফল ভাই (৩৬তম বিসিএস-প্রশাসন ক্যাডার) এবং মোস্তফা স্যারের কাছ থেকে লিখিতের গুরুত্বপূর্ণ পরামর্শ নেন। প্রথমেই বিগত সালের প্রশ্নগুলো সমাধান করে নেন। লিখিত প্রস্তুতির জন্য আমি প্রতিদিন ১৫ মিনিট করে যেকোন একটি টপিকের উপর বাংলা এবং ইংরেজীতে ফ্রি-হ্যান্ড রাইটিং প্র্যাকটিস করেছেন। পত্রিকার সম্পাদকীয় কলাম ও আন্তর্জাতিক অংশগুলো নিয়মিত পড়েছেন। বিভিন্ন উক্তিগুলো বারবার পড়েছি যাতে করে ভুলে না যাই। ডেইলি স্টার পত্রিকা থেকে অনুবাদ চর্চা করেছি নিয়মিত। গণিতের জন্য নবম ও দশম শ্রেণির সাধারণ গণিত, উচ্চতর গণিত ও বাজারের একটি বই ফলো করতাম। যেহেতু আমি গণিতে দুর্বল ছিলেন তাই গণিতের জন্য কোচিং করেন। বিজ্ঞান বিষয় বিভিন্ন বই থেকে নোট করে পড়েছেন এবং চিত্রগুলো বার বার চর্চা করেছেন। বিভিন্ন ডাটা মনে রাখার জন্য বার ডায়াগ্রাম ও পাই চার্ট ব্যবহার করেছেন। বাংলাদেশ ও আন্তর্জাতিক বিষয়াবলির টপিক অনুযায়ী গুরুত্বপূর্ণ পয়েন্ট দিয়ে ছোট করে নোট সাজিয়ে ছিলেন যেন রিভিশন করতে সহজ হয়। ভাইভা প্রস্তুতি নেয়ার জন্য নিয়মিত ইংলিশ স্পোকেন প্র্যাকটিস করেছি। প্রতিদিন নিয়ম করে একটি ইংরেজী ও বাংলা পত্রিকা পাঠ্য তালিকায় রেখেছি। মুক্তিযুদ্ধ ভিত্তিক বিভিন্ন লেখকের বই, জেলার মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস বিস্তারিত পড়ার চেষ্টা করেছি। চয়েস লিস্টের প্রথম দিকের ক্যাডারগুলো সম্পর্কে খুটিনাটি বিষয়গুলো বিস্তারিত স্টাডি করেছি। সেই সাথে নিজ জেলা, বর্তমান চাকুরি এবং স্নাতক ও স্নাতকোত্তরে পঠিত বিষয় সম্পর্কে বিস্তারিতভাবে জানার চেষ্টা করেছি। 

পিংকি রানী মজুমদার বলেন, সৃষ্টিকর্তার অশেষ কৃপায় আমি ৪১তম বিসিএস বন ক্যাডারে সুপারিশপ্রাপ্ত হয়েছি তার অনুভূতি ভাষায় প্রকাশ করা যাবে না। তবে আমার এই সাফল্যে আমার বাবা মা অনেক খুসি হয়েছে এতেই আমি অনেক আনন্দিত। বাবা মার সুখই আমার সুখ। তাদের মুখে হাসি ফুটাতে পারাই আমার সফলতা। 

তিনি আরও বলেন, প্রথমে বলতে চাই বিসিএস একটি ধৈর্য্যের পরীক্ষা। প্রতি বিসিএসে ক্যাডার হয় প্রায় দুই হাজারের মতো বাকীরা ক্যাডার হয় না। তাই শুধু বিসিএসকে লক্ষ্য করে এগিয়ে যাওয়াটা বুদ্ধিমানের কাজ হবে না। বিকল্প পথ রাখতে হবে। 

যেমন- আমি চাকুরির প্রস্তুতির পাশাপাশি বিকল্প হিসেবে কুমিল্লা ল’ কলেজ থেকে এল এল বি সম্পন্ন করি। যাতে করে চাকুরি না হলেও আমি এডভোকেটশিপ নিতে পারি। সেই সাথে সৃষ্টিকর্তার উপর বিশ্বাস রেখে এগিয়ে যেতে হবে। নিয়মিত পড়াশোনা করতে হবে। দুই দিন পড়ে দুই দিন পড়বে না এমনটা করা যাবে না। পড়াশোনার ধারাবাহিকতা বজায় রাখতে হবে। 

আমি মনে করি দিন শেষে বিসিএস একটি চাকুরি মাত্র, জীবনের ছোট্ট একটি অংশ, এটা সম্পূ্র্ণ জীবন না। তাই যতটা বিনয়ী, কৃতজ্ঞতাবোধ এবং Down to Earth থাকবো ততোই শান্তি পাবো বলে বিশ্বাস করি। 

সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমকে ইতিবাচক হিসাবে দেখেন। তার বিসিএস জার্নিতে সবচেয়ে বড় ভূমিকা পালন করেছিলো সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম। অনলাইনে লাইভ ক্লাস, বিসিএস ভিত্তিক বিভিন্ন গ্রুপে জয়েন থাকা, পত্রিকার বিভিন্ন কলাম পড়া, অনলাইনে এক্সাম দেয়া, নোটপত্র শেয়ার করা ইত্যাদি কাজে একমাত্র ভরসা ছিলো সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম। সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম নিয়ন্ত্রিতভাবে ব্যবহার করতাম। তাই আমার জন্য আর্শীবাদ ছিলো। 

যেহেতু বন ক্যাডারে সুপারিশপ্রাপ্ত হয়েছি তাই দেশের বনজ সম্পদ রক্ষা ও উন্নয়ন এবং বৈশ্বিক উষ্ণায়ন রোধে অবদান রাখতে চান পিংকি রানী মজুমদার।

যাযাদি/ এসএম