শেরপুর গারো আদিবাসী কোচ সম্প্রদায়ের দুর্দিন

প্রকাশ | ২৯ জুন ২০২১, ১৪:২০

শেরপুর প্রতিনিধি

 

জেলার অন্যান্য নৃ-তাত্ত্বিক জনগোষ্ঠীর মতো গারো আদিবাসী, কোচ জনগোষ্ঠী ও  ঐতিহ্যে মন্ডিত। এ জেলার  সিমান্ত ঘেষা ৩টি উপজেলার কান্দাপাড়া, বালিঝুড়ি, চুকচুকি; শালচূড়া, নকশী, রাংটিয়া, বাঁকাকূড়া, হালচাটি, গজনী ,দাওধরা, খলচাঁন্দা, বুরুঙ্গা, সমশ্চূড়াসহ গারো পাহাড়ের বিভিন্ন এলাকায় ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্ঠী কোচদের বসবাস। এসব এলাকায় প্রায় সাড়ে চার হাজার কোচ জনগোষ্ঠী বসবাস করে থাকে।

 

১৪১২ সালে এক কোচ সর্দার শেরপুরের ওইসব পাহাড়ি এলাকায় স্বাধীন রাজা ছিলেন। বর্তমানে শেরপুরের গড়জরিপা নামের গ্রামটিতে ওই কোচ রাজার রাজধানী ছিল এবং সে সময় কোচরাই এই অঞ্চল শাসন করতেন। পরে দ্বিতীয় ফিরোজ শাহ বাংলা অধিকার করলে সেনাপতি মজলিস কর্তৃক দলিপ নিহত হন।

 

পঞ্চদশ শতাব্দীর মধ্যভাগে কোচ রাজত্বের বিলুপ্তি ঘটে। অতীতে কোচদের প্রভাব-প্রতিপত্তি, শৌর্যবীর্য প্রবল থাকলেও আজ এই সম্প্রদায় বিলুপ্তির পথে। অন্যান্য আদিবাসীদের মতো রাজনৈতিক, সামাজিক, ধর্মীয় ও সাংস্কৃতিক আগ্রাসনে বারবার আক্রান্ত হওয়ায় তাদের পরিধি সংকুচিত হয়েছে। কোচরা সনাতন ধর্মে বিশ্বাসী। হিন্দু সমাজের বিভিন্ন ধর্মক্রিয়াদি সম্পন্ন করে থাকে তারা। এছাড়া তাদের নিজস্ব কতগুলি আদিকালের দেব-দেবী পূজার প্রচলন দেখা যায়। শিক্ষার ও স্বাস্থ্যের দিক দিয়ে কোচরা গারোদের চেয়ে অনেক পিছিয়ে আছে।

 

শেরপুরের গারো পাহাড়ের আদিবাসী নৃ-গোষ্ঠীদের মধ্যে গারোদের বেশির ভাগ মানুষ তাদের সনাতনী ধর্ম ছেড়ে দিয়ে খ্রিস্টধর্মে দীক্ষিত হয়ে অনেকটা ভালো অবস্থানে রয়েছে। আর কোচরা সবচেয়ে পিছিয়ে ও অবহেলিত হয়ে এখনও অনেকে পাহাড়েই পড়ে আছে তাদের সনাতন ধর্মকে আগলে রেখে। তবে জেলায় সবচেয়ে অবহেলিত ও পিছিয়ে রয়েছে নালিতাবাড়ী উপজেলার ভারত সীমান্তঘেঁষা নিভৃত একটি পল্লী ‘খলচান্দা’। কোচ সম্প্রদায় এ অঞ্চলেই প্রথম বসতি স্থাপন করে। পাহাড়ের উঁচু-নিচু টিলা ও ঢালুতে প্রায় ৪৫টি কোচ পরিবার নিজস্ব সংস্কৃতি নিয়ে দারিদ্র্যের সাথে লড়াই করে বেঁচে আছে। কোচরা এখানে দীর্ঘ দিন থেকে দলবদ্ধভাবে বসবাস করায় অঞ্চলটি কোচপাড়া হিসেবে পরিচিতি লাভ করেছে।

 

শেরপুর জেলা সদর থেকে প্রায় ৩৫ কিলোমিটার এবং নালিতাবাড়ী উপজেলা সদর থেকে ১৭ কিলোমিটার দূরে ওই গ্রামটি। বারোমারী মিশন থেকে ৩ কিলোমিটার দুর্গম সরু আঁকাবাঁকা পাহাড়ি পথ দিয়ে যেতে হয় সেখানে। কিছুদুর যেতেই চোখে পড়ে ভারতের মেঘালয় রাজ্য থেকে বয়ে আসা খড়স্রোতা নদী ‘চেল্লাখালী’।

 

বিগত পাহাড়ি ঢলে ভেঙে গেছে নদী তীরের বেড়িবাঁধ। সৃষ্টি হযেছে খাল। তার ওপর ঝুকিপূর্ণ বাঁশের সাঁকো। মারাত্মক ঝুঁকি নিয়ে পার হতে হয়। এরপর থেকেই কোচপাড়া। কোচ পরিবারের ঘরগুলো মাটির। নতুন কোনো মানুষ দেখলেই ছুটে আসে শিশুরা। যে বয়সে বই-খাতা নিয়ে তাদের স্কুলে থাকার কথা সেই বয়সে তারা মা-বাবার কাজে সহযোগিতা করছে। পাহাড়ের উচুঁ-নিচু টিলায় ঘুরে বেড়াচ্ছে আর লাকড়ি সংগ্রহ করছে। নোংরা পরিবেশ থাকার কারণে রোগে আক্রান্ত হচ্ছে শিশুরা। ডায়রিয়া, আমাশায়, পেটের পীড়াসহ বিভিন্ন অসুখ-বিসুখ তাদের নিত্যসঙ্গী হয়েছে।

 

কোচ সম্প্রদায়ের নারী-পুরুষ সবাই অন্যের জমিতে বিভিন্ন ফসলের মওসুমে কৃষি শ্রমিকের কাজ করে। বছরের বাকি সময় কোনো কাজ না থাকায় তারা পাহাড় থেকে লাকড়ি সংগ্রহ করে। বাঁশ দিয়ে ‘ডুল’ তৈরি করে বাজারে বিক্রি করে যা পায় তা দিয়েই খেয়ে না খেয়ে দিন অতিবাহিত করে। ফলে শরীরের চাহিদামতো খাদ্য গ্রহণ করতে পারে না তারা। এতে তাদের সবার দেহ দুর্বল ও রুগ্ন হয়ে হয়ে থাকে বছরজুড়ে। অসুখের যন্ত্রণায় ছটফট করলেও চিকিৎসাসেবা পাচ্ছে না কোচ পরিবারগুলো। কারণ তাদের যোগাযোগের রাস্তাটি চলাচলের একেবারেই অনুপযোগী।

 

৪ কিলোমিটার দুর্গম পাহাড় অতিক্রম করে বারোমারী মিশন হাসপাতালে এসে চিকিৎসা পাওয়া খুব কঠিন ব্যাপার। অন্যদিকে অর্থাভাবে উন্নত চিকিৎসা পাওয়া তাদের কাছে স্বপ্ন ছাড়া আর কিছুই না। ফলে কঠিন অসুখ হলেও তারা শরণাপন্ন হয় গ্রাম্য কবিরাজের কাছে। কবিরাজের ঝাড়ফুঁক, তেলপড়া, পানি পড়াকেই তারা ওষুধ হিসেবে গ্রহণ করে। এমনকি সরকারের কোনো স্বাস্থ্যকর্মীও ওই পাড়ায় যায় না কখনো। কোচপাড়া অত্যন্ত অবহেলিত। কোচ পরিবারের প্রায় সবাই অশিক্ষিত ও অজ্ঞ। দিন আনে দিন খায়। খাবার জোগাড় করতেই তারা ক্লান্ত।

 

এছাড়া কোনো স্বাস্থ্যকর্মী না যাওয়ার কারণে গর্ভবতী মায়েরাও কঠিন অসুবিধার সন্মুখীন হচ্ছে। এখানে প্রসব যন্ত্রণায় ভগবান ছাড়া আর কেউ পাশে থাকে না তাদের। পরিবার পরিকল্পনা বিভাগ বলতে কিছু আছে তাদের অনেকই তা জানেন না। ভাগ্যের নির্মম পরিহাসে শেরপুরের গারো পাহাড়ের কোচরা আজ বিলুপ্ত হতে চলেছে। এখন অবস্থা এমন যে, কোচদের ভবিষ্যতে হয়তো কেবলই ইতিহাসের পাতায় পাওয়া যাবে! জানা যাবে, একসময় শেরপুরের ওইসব অঞ্চলে কোচদের রাজত্ব ছিল, রাজা ছিল, ছিল আরো ঐতিহ্য।

 

যাযাদি/এসএইচ