বুধবার, ১৬ অক্টোবর ২০২৪, ১ কার্তিক ১৪৩১

ছুটির দিনে পর্যটকে মুখর কক্সবাজার

জাবেদ আবেদীন শাহীন কক্সবাজার
  ১৩ অক্টোবর ২০২৪, ১১:৫৭
ছবি : যায়যায়দিন

সনাতন ধর্মাবলম্বীর সর্ববৃহৎ দুর্গাপূজা উৎসবকে কেন্দ্র করে টানা চার দিনের ছুটিতে লাখ লাখ পর্যটকের পদচারণে মুখরিত হয়ে উঠেছে দীর্ঘতম সমুদ্র সৈকত কক্সবাজার। ছুটির আমেজ কাটাতে স্বপ্নময় সৈকতে অনেকে শত শত মাইল পাড়ি দিয়ে গাড়ি নিয়ে এসেছে পর্যটক ফ্যামিলি ট্যুর পার্সেনাল ও ফ্রেন্ডস্ ট্যুরে। নীল সমুদ্রজলে লাখো জনস্রোতের উচ্ছ্বাস। সৈকতে দুই কিলোমিটার জুড়ে কোথাও তিলধারণের ঠাঁই নেই। পর্যটকদের আনন্দ সমুদ্রে ফেনিল ঊর্মিমালায় যেন মিশেছে নীলরাশিতে।

এ যেন মানুষের অপূর্ব এক মিলন মেলা। মৌসুমের শুরুতেই পর্যটন ব্যবসা-বাণিজ্যে চাঙ্গাভাব ফিরে আশায় টানা বন্ধে ৫০০ কোটি টাকার বেশি বাণিজ্যের আশা করছে ব্যবসায়ীরা। পর্যটকের সংখ্যা বাড়তে থাকায় দেশের সবচেয়ে বড় আঙ্গিকে রোববার প্রতিমা বিসর্জনের মধ্যে তিন লাখ পর্যটকেরও বেশি উপস্থিতি হবে বলে এমনটাই বলছে পর্যটন সংশ্লিষ্টরা।

এদিকে, পর্যটকদের আগমনে হোটেল-মোটেল জোনের আবাসিক হোটেল ও রেস্টুরেন্টগুলো এখন রঙিন আলোর ঝলকানি। খাবার হোটেলেও পর্যটকদের ভিড় দেখা যায়। সৈকতে পর্যটকের নিরাপত্তার কথা চিন্তা করে জেলা প্রশাসন ও ট্যুরিস্ট পুলিশের পক্ষ থেকে নেওয়া হয়েছে পর্যাপ্ত নিরাপত্তা ব্যবস্থা। তৈরি করা হয়েছে বিশেষ নিরাপত্তা বলয়। আগত পর্যটকের নিরাপত্তায় কাজ করছেন আইনশৃঙ্খলা বাহিনী, ট্যুরিস্ট পুলিশ, লাইফ গার্ড ও বিচকর্মীরা।

পর্যটন সংশ্লিষ্ট ব্যবসায়ীরা জানান, এবার দুর্গাপূজা উপলক্ষে কক্সবাজারের পর্যটন শিল্পে ব্যবসা-বাণিজ্য চাঙ্গা হয়ে উঠেছে। পূজা উপলক্ষে পাঁচশত কোটি টাকা বাণিজ্যের কথা বলছেন তারা। কক্সবাজারের ৫ শতাধিক হোটেল-রিসোর্টে অধিকাংশ কক্ষ আগামী ২০ অক্টোবর পর্যন্ত বুকিং করা হয়েছে। এর মধ্যে ১৩ অক্টোবর পর্যন্ত হোটেলে রুম বুকিং হয়েছে, বাকি ২০ অক্টোবর পর্যন্ত ৮৫ শতাংশ রুম বুকিং রয়েছে।

কক্সবাজারে এখন হোটেলগুলোতে দৈনিক ২ লাখেরও বেশি পর্যটকের থাকার ব্যবস্থা রয়েছে। শহরের তারকামানের হোটেলগুলোতে পর্যটকের চাপ বেশি রয়েছে।

শনিবার সকাল থেকে কক্সবাজার সমুদ্র সৈকতের বিভিন্ন পয়েন্টসহ নানা পর্যটন স্পট ঘিরে পর্যটকদের আনন্দ উচ্ছ্বাস করতে দেখা যায়। চিরসবুজের ছোঁয়া পেতে সবুজ পাহাড়ের আনাচে-কানাচে ঘুরে বেড়াচ্ছে পর্যটকরা। বিশেষ করে প্রকৃতির রূপে এখন নীল আকাশের তপ্ত রোদে সৈকতের বালিয়াড়িতে কেউ ঘুরাফেরা করছে, কেউ সৈকতে সাজানো বীচছাতায় বসে শীতল হওয়া উপভোগ করছে, অনেকে সাগরের লোনা জলে সাতার কাটছে। সৈকতে দেশি-বিদেশি লাখো পর্যটকের আগমনে কর্মব্যস্ততা বেড়েছে ফটোগ্রাফার, ঘোড়ার রাইডার, জেড স্কি ও বিচ বাইক চালকদের। একই সঙ্গে জমজমাট হয়ে উঠেছে সৈকতে বার্মিজ মার্কেটগুলোতেও। বিশেষ করে বার্মিজ আচার, বাদাম, শামুক-ঝিনুকের ঘর সাজানোর উপকরণ এবং শুটকিসহ নানা পণ্যের কেনাবেচায় সরগরম দোকান ও মার্কেটগুলো।

সবখানে ক্রেতাদের উপচেপড়া ভিড়ে পণ্যের কেনাবেচায় সরগরম দোকানগুলো। কক্সবাজারের সাড়ে ৫ শতাধিক হোটেল-মোটেল ও রিসোর্টগুলো পর্যটকে কানায় কানায় পূর্ণ। কক্সবাজারে পর্যটকে মুখরিত হওয়ায় ব্যবসায়ীরা দারুণ খুশি। অতীতে লোকসান কাটিয়ে পর্যটন শিল্প যেন চাঙ্গা হয়ে উঠছে পর্যটন সংশ্লিষ্ট অর্থনীতি।

ঢাকার পর্যটক অনুপমা সেন ও বিভাষ সেন বলেন, এবার পুজোর ৪ দিনের ছুটিতে এক সঙ্গে কক্সবাজারে বেড়াতে এসেছি। আমাদের বিয়ে হয়েছে এক মাস। শুনেছি কক্সবাজারে সবচেয়ে বড় আঙ্গিকে দেবী দুর্গা বির্সজন হয়, তাই দেখতে আসলাম। সৈকতে এত মানুষ দেখে খুবই ভালো লাগছে। বাড়ির লোকদের জন্য অনেক কেনাকাটা করেছি। থাকব আরও দুই-তিন। চাঁদপুরের বাসিন্দা কামরুল হাসান বলেন, সপরিবারে সন্তানদের নিয়ে ছুটিতে বেড়াতে এসেছি। আগে থেকে হোটেল বুক করেছিলাম; তাই কোনো ধরনের ঝামেলা হয় নাই। কক্সবাজারে যতবার এসেছি অপূর্ণতা নিয়ে চলে যাই। তাই সময় সুযোগ পেলে ছুটে আসি। আসতে চাই বারবার। আমি বেড়াতে পছন্দ করি।

পর্যটকরা শুধু সমুদ্র সৈকতই নয়, কক্সবাজারে দর্শনীয় স্থানগুলো পদচারণায় মুখরিত; বার্মিজ মার্কেট, পাহাড় ঝর্না হিমছড়ি, পাথুরে সৈকত ইনানী, রামু বৌদ্ধ বিহার, রাবার বাগান, ডুলাহাজরা সাফারি পার্ক, লং মেরিন ড্রাইভ, রেডিয়েন্ট ফিশ অ্যাকুয়ারিয়াম, দরিয়ানগর, সেন্টমার্টিন, পাহাড়ি দ্বীপ মহেশখালী, কক্সবাজার বৌদ্ধ মন্দির, কানারাজার গুহা, এসব পর্যটন কেন্দ্রগুলোতে পর্যটকরা ভ্রমণে যাচ্ছেন। শহরে কেনাকাটার জন্য বিশেষ করে বার্মিজ মার্কেট, রাখাইন রমণীদের দ্বারা পরিচালিত বিভিন্ন রকম হস্তশিল্প ও মনোহারি পণ্যের দোকানে ভিড় বেড়েছে। এছাড়া পর্যটকরা কেনাকাটায় মেতে উঠেছে ঝিনুক মার্কেট, ঝিনুক শিল্পের রকমারি জিনিসপত্রের প্রধান বিক্রয় ও বিপণন কেন্দ্রে। রাত একটারও বেশি সময় ধরে চলে বেচাবিক্রি।

কক্সবাজারে ভ্রাম্যমাণ দোকানগুলোতে সামুদ্রিক মাছের বারবিকিউ এখন ভোজনবিলাসী পর্যটকদের কাছে মজাদার খাবার হয়ে উঠেছে। মাছের মেন্যুর চিংড়ি, রূপচাঁদা, লাইট্যা, লবস্টার, স্যামন, অক্টোপাস ও কাঁকড়া, কোরাল, টুনা ফিস, ছুরি মাছসহ মজাদার হরেক রকম শুটকি মাছের ভর্তা ভোজনপ্রিয়দের কাছে আকর্ষণ বেশি। বেচাবিক্রি ভালো বলে জানিয়েছে দোকান ব্যবসায়ী ফারুখ আহম্মদ। সৈকতের সুগন্ধা বিচের পাশেই আছে তাজা সামুদ্রিক মাছের ভ্রাম্যমাণ দোকানগুলো। বিকালে থেকে দোকানে পছন্দমতো সামুদ্রিক মাছের বারবিকিউয়ের জন্য দীর্ঘ লাইন।

শুটকি দোকান ব্যবসায়ী কামাল হোসেন বলেন, টানা বন্ধের ছুটি পর্যটক আসায় আমরা ভালোই শুটকি বিক্রি করতে পারছি। পর্যটকদের কাছে এখানকার শুটকি খুবই পছন্দে। অনেক পর্যটক আমদের থেকে শুটকি কিনে পেমেন্ট করার পর আমরা কুরিয়ারের মাধ্যমে ঠিকানা অনুযায়ী পাঠিয়ে দিই। তাই পর্যটকরা আমাদের ওপর খুবই খুশী। কারণ বহনের বড় ঝামেলা থেকে রক্ষা হলেন বলে। ক্ষুদ্র সৈকতে ঝালমুড়ি ব্যবসায়ী আলী হোসেন বলেন, দীর্ঘদিন পর সৈকতে পর্যটক আশায় লাভের মুখ দেখেছি। আমরা এই সময়ের জন্য দীর্ঘদিন অপেক্ষায় ছিলাম। এবার পরিবেশ পরিস্থিতি বেশ ভালো। বিচের ঝিনুক ব্যবসায়ী আমির হামজা বলেন, টানা বন্ধের ছুটি বিপুল সংখ্যক পর্যটক কক্সবাজারে বেড়াতে এসেছে। এতে করে আমাদের ব্যবসা সচল হয়েছে। পর্যটকরা ঝিনুকের মালা, ঝিনুকের তৈরি বিভিন্ন সামগ্রী চাহিদা অনুযায়ী কিনছে। এভাবে পর্যটক আসলে আমাদের সবার ব্যবসা আলোর মুখ দেখবে। কক্সবাজার আইকনিক রেলস্টেশনের স্টেশন কর্মকর্তা মো. গোলাম রব্বানী জানান, টানা ছুটি উপলক্ষে যাত্রীদের সুবিধার্থে কক্সবাজার রুটে সাতটি বিশেষ ট্রেন চলাচল করছে। প্রতিদিন নিয়মিত দুই জোড়া ট্রেনের পাশাপাশি এই বিশেষ ট্রেন সার্ভিস চালু করা হচ্ছে বলে জানিয়েছেন তিনি।

কক্সবাজার হোটেল-গেস্ট হাউজ মালিক সমিতির সভাপতি আবুল কাসেম সিকদার জানান, কক্সবাজারে তারকামানের হোটেলগুলোর শতভাগ রুমই অগ্রিম বুকিং হয়ে গেছে। ১৪ অক্টোবর পর্যন্ত কোনো ধরনের রুম খালি নেই। হঠাৎ করে পর্যটক বেড়ে যাওয়ায় সব হোটেলগুলোতে চাপ পড়েছে। প্রতিবছর এ সময়টাতে বেশি পর্যটকের সমাগম হয়। তার কারণ টানা ছুটিতে প্রতিমা বিসর্জনে কয়েক লাখ পর্যটকের সমাগম ঘটে। এ বছরও তার ব্যতিক্রম হয়নি। কয়েকদিন পর চাপ একটু কমলে খালি হবে রুম।

কক্সবাজার ট্যুরিস্ট পুলিশের এসপি মাহফুজুল ইসলাম বলেন, বন্ধ থাকায় প্রচুর সংখ্যক পর্যটক কক্সবাজারে আসছে। তাই সৈকতে পোশাকধারী পর্যাপ্ত পুলিশ মোতায়েনের পাশাপাশি গুরুত্বপূর্ণ পয়েন্টগুলোতে টহল ও সাদা পোশাকের পুলিশ রয়েছে। তাছাড়া পর্যবেক্ষণ টাওয়ারে অবস্থান ও কন্ট্রোল রুমের মাধ্যমে সৈকতে সার্বক্ষণিক নজরদারি রাখা রয়েছে। কক্সবাজারের জেলা প্রশাসক মোহাম্মদ সালাহউদ্দিন বলেন, কক্সবাজারে আসা পর্যটকদের নিরাপত্তায় জেলা প্রশাসনের নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেটদের একাধিক টিম মাঠে কাজ করছেন। কোথাও অভিযোগ পেলে ব্যবস্থা গ্রহণের নির্দেশ দেওয়া আছে। তাছাড়া আগত পর্যটক হয়রানি রোধে হোটেল-মোটেল ও রেস্তোরাঁয় মূল্য তালিকা টাঙানো রয়েছে কি না তা নিয়েও কাজ করছে টিম।

যাযাদি/ এস

  • সর্বশেষ
  • জনপ্রিয়

উপরে