আল আরাফাহ ব্যাংকে এস আলম ও কেডিএস গ্রম্নপের নজীরবিহীন লুটপাট

প্রকাশ | ২৫ ফেব্রুয়ারি ২০২৫, ০০:০০

অর্থ-বাণিজ্য রিপোর্ট
বিগত ফ্যাসিস্ট সরকারের আমলে একরকম ডাকাতি করে আল আরাফা ইসলামী ব্যাংক দখলে নেয় এস আলম গ্রম্নপ ও কেডিএস গ্রম্নপ। নিজেদের নিয়ন্ত্রণে রেখে ইচ্ছামতো দুর্নীতি ও লুটপাট চালায় এই দুই গ্রম্নপ। যদিও সমাজের সুবিধাবঞ্চিত শিক্ষিত জনগোষ্ঠীকে ক্ষুদ্র বিনিয়োগের মাধ্যমে তাদের উৎপাদনমুখী করে বৃহৎ কর্মসংস্থান সৃষ্টি করা ও স্বাবলম্বী করে তোলাই ছিল ব্যাংকটি প্রতিষ্ঠার মূল উদ্দেশ্য। কিন্তুএই দুই গ্রম্নপ তাদের সুবিধা অনুযায়ী ব্যাংকের বিভিন্ন নিয়মকানুনকে তাদের নিজেদের স্বার্থে ব্যবহারের জন্য কাটছাঁট করেছে। সম্প্রতি বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নর বরাবর দেওয়া এক চিঠিতে এসব তথ্য উঠে এসেছে। প্রতিষ্ঠার পর থেকে ব্যাংকটি তাদের ব্যবসা সুষ্ঠুভাবেই পরিচালনা করে আসছিল। কিন্তু এস আলম গ্রম্নপের ভাইস চেয়ারম্যান ও এস আলমের ভাই আব্দুস সালাম লাবু এবং কেডিএস গ্রম্নপের চেয়ারম্যান খলিলুর রহমান ব্যাংকটিতে আধিপত্য বিস্তারের মাধ্যমে নজিরবিহীন লুটপাট চালায়। ব্যাংকের বোর্ডে তাদের ঘনিষ্ঠজনদের নিয়োগ দিয়ে একক আধিপত্য গড়ে তোলেন। প্রথমে তারা প্রতিষ্ঠাতা এজেডএম শামসুল আলমকে ব্যাংক থেকে বের করে দিয়ে দুই গ্রপের পারস্পরিক সম্পর্কিত লোকজনকে নিয়োগ দেন। আব্দুস সালাম লাবু ব্যাংকটির ২৩ দশমিক ৭৫ শতাংশ শেয়ার এবং কেডিএস গ্রম্নপের চেয়ারম্যানের ছেলে সেলিম রহমান ব্যাংকের ১৩ দশমিক ৫০ শতাংশ শেয়ার হাতিয়ে নেন। এরপর একই বছরের শেষের দিকে খলিলুর রহমানের ছোট ভাইয়ের স্ত্রীর ভাই বদিউর রহমানকে বসানো হয় চেয়ারম্যান পদে। এরপর থেকেই তাদের লুটপাটের আয়োজন শুরু করে। এরপর পর্যায়ক্রমে ব্যাংকটির পরিচালক পদ থেকে ৭ জনকে বের করে দেওয়া হয়। খলিলুর যেভাবে ব্যাংকে ক্ষমতা দেখান: গভর্নরকে দেওয়া চিঠিতে বলা হয়, আল আরাফাহ ব্যাংকের দুজন প্রতিষ্ঠাতা পরিচালক ছিলেন আব্দুল হাদী ও মো. এজহার মিয়া। কেডিএসের খলিলুর রহমান তাদের দুটি শেয়ার তার নিজের দখলে নেওয়ার জন্য মরিয়া হয়ে ওঠেন। তারা রাজি না হলে আওয়ামী লীগ সরকারের উঁচু মহলের মাধ্যমে ব্যাংকের পর্ষদের ওপর আধিপত্য বিস্তার করে এই দুই পরিচালকের স্বাক্ষর ছাড়াই টিপসই দিয়ে শেয়ার দুটি নিজের ছেলে সেলিম রহমান এবং ছোট ভাই আহমেদুল হকের নামে করে নেন। বিনিয়োগের নামে লুটপাট: এস আলম গ্রম্নপ ও কেডিএস গ্রম্নপ বেনামে বিপুল পরিমাণ অর্থ বিনিয়োগ দেখিয়ে তা লুটপাট করে। পারস্পরিক সমঝোতায় অন্য ব্যাংকের পরিচালকদের মনোনীত ব্যক্তির নামে বিনিয়োগ দিয়ে আল আরাফাহ ব্যাংক থেকে সেই বিনিয়োগের অর্থ লোপাট করা হয়েছে। এর মধ্যে অনিয়মতান্ত্রিকভাবে বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের বিনিয়োগ নথি, গ্রাহকের উপযুক্ততা, সহায়ক জামানতের বিষয়ে নিরীক্ষা কার্যক্রম পরিচালনা করলে তা বেরিয়ে আসবে বলে গভর্নরকে দেওয়া চিঠিতে দাবি জানানো হয়। ১৫ বছর ধরে দুই গ্রম্নপের নিয়ন্ত্রণে ব্যাংকের পর্ষদ: অভিযোগ সূত্রে জানা গেছে, ২০১০ সাল থেকে এ পর্যন্ত ব্যাংকটিতে মোট তিনজন এমডি নিয়োগ দেওয়া হয়। তাদের প্রত্যেকেই দুই গ্রম্নপের একান্ত বাধ্যগত। এ ছাড়া ২০০৯ সাল থেকে এই দুই গ্রম্নপের পরিচালনা পর্ষদ, নির্বাহী কমিটি, সাবসিডিয়ারি কোম্পানিগুলোর চেয়ারম্যান, ভাইস চেয়ারম্যানসহ সব গুরুত্বপূর্ণ পদে এস আলম ও কেডিএস গ্রম্নপের বাইরে কাউকে জায়গা দেওয়া হয়নি। বর্তমান এমডি লুটপাটের দোসর: চিঠিতে বলা হয়, ব্যাংকের বর্তমান এমডি ফরমান আর চৌধুরী এস আলম এবং কেডিএস গ্রম্নপ মনোনীত এবং তাদের অবৈধ কর্মকান্ড ও লুটপাটের দোসর। তিনি তার নিয়োগপত্রের শর্ত লঙ্ঘন করে অতিরিক্ত আর্থিক সুবিধা গ্রহণ করেছেন। এস আলম গ্রম্নপের নিয়ন্ত্রণাধীন ধ্বংসপ্রাপ্ত ব্যাংকসমূহে ইন্টার ব্যাংক মানি মার্কেটের মাধ্যমে বিপুল পরিমাণ টাকার জোগান দিয়েছেন। শ্রেণি বিন্যাসিত বিনিয়োগে প্রকৃত পরিমাণ ধামাচাপা দিয়ে রেখেছেন। তিনি অনৈতিকভাবে বিপুল পরিমাণ বিনিয়োগ পুনঃতপশিল করেছেন। পুঁজিবাজার কেলেঙ্কারিতে নাম এলেও বহাল তবিয়তে: জানা যায়, এআইবিএল ক্যাপিটাল মার্কেট সার্ভিসেস লিমিটেডের শীর্ষ কর্মকর্তা রেজাউর রহমানসহ অন্তত ১০ জন কর্মকর্তা পারস্পরিক যোগসাজশে প্রতিষ্ঠানটি বিপুল পরিমাণ আর্থিক ক্ষতি করেছেন। দুর্নীতির মাধ্যমে তারাসহ বদিউর রহমান ও খলিলুর রহমান (কেডিএস গ্রম্নপের কর্ণধার) প্রতিষ্ঠানের বিপুল পরিমাণ অর্থ লুটে নিয়েছেন। কর্মকর্তারা বেনামে এবং কেউ কেউ নিজের স্ত্রী, বাবা, ভাই, বোন ও নিকটাত্মীয়ের নামে বিও হিসাব খুলে চেক ডিজঅনার পদ্ধতিসহ বিভিন্ন অনিয়মের মাধ্যমে দুর্নীতি ও অবৈধ আয় করেছেন। ২০১০-১১ সালে শেয়ার বাজার কেলেঙ্কারির অন্যতম নায়ক (জুয়ারি) হলেন রেজাউর রহমান। বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক ডেপুটি গভর্নর ইব্রাহিম খালেদের তদন্ত প্রতিবেদনে পুঁজিবাজার কেলেঙ্কারিতে রেজাউর রহমানের সম্পৃক্ততার বিষয়টি উলেস্নখ করা হয়েছে। এর পরিপ্রেক্ষিতে সিকিউরিটজ অ্যান্ড এক্সচেঞ্জ কমিশন (সিএসই) তাকে এআইবিএল ক্যাপিটাল থেকে বহিষ্কারসহ তার বিরুদ্ধে আইনানুগ ব্যবস্থা গ্রহণের নির্দেশ দেয়। বদিউর রহমান কমিশনের ওই নির্দেশনা উপেক্ষা করে রেজাউর রহমানকে চাকরি থেকে বহিষ্কার করার পরিবর্তে সুরক্ষা দেন এবং তাকে এআইবিএল ক্যাপিটাল থেকে ২০১৫ সালের ১ জানুয়ারি বদলি করে ডিএমডি হিসেবে ফের ব্যাংকে পদায়ন করেন। কাগজে-কলমে তাকে ব্যাংকে পদায়ন দেখানো হলেও মূলত তিনি তখনও পূর্ববর্তী পদেরই দায়িত্ব পালন করেছেন। সেখানে লোক দেখানো নিম্ন পদবির একজনকে সিইও হিসেবে দেখানো হয়। রেজাউর রহমানকে ব্যাংকে পদায়নের ফলে তিনি হয়ে যান ব্যাংকের জ্যেষ্ঠতম ডিএমডি। অথচ ব্যাংকিং বিষয়ে তার খুব বেশি অভিজ্ঞতা ছিল না। অন্যদিকে, ওই সাবসিডিয়ারি প্রতিষ্ঠানেও অফিশিয়ালি তার কোনো পদপদবি ছিল না। অথচ তার পেছনে ব্যাংকের মাসিক ব্যয় হয়েছে ১০ লাখ টাকার বেশি।