প্রথমবারের মতো বাজেটে তরুণ উদ্যোক্তাদের জন্য বরাদ্দ থাকছে

প্রকাশ | ০৩ জুন ২০১৯, ০০:০০

ইমদাদ হোসাইন
নতুন উদ্যোক্তা তৈরিতে সরকারের আগ্রহ বরাবরই ইতিবাচক। কিন্তু উদ্যোক্তাদের স্বপ্ন অনেক ক্ষেত্রেই ঝরে পড়ে অর্থাভাবে। আসছে বাজেটে (২০১৯-২০) নতুন ক্ষুদ্র উদ্যোক্তাদের অর্থ বরাদ্দ থাকাসহ তাদের মাধ্যমে নতুন চাকরির বাজার তৈরির চিন্তা করছে সরকার। এমন ইঙ্গিত দিয়েছেন অর্থ মন্ত্রণালয়ের অতিরিক্ত সচিব এম হাবিবুর রহমান। তিনি বলেন, গত কয়েক বছরে দেশের অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি ইতিবাচক হারে বাড়ছে। তবে সেই সাথে বাড়ছে বেকারের সংখ্যাও। সে বিবেচনায় সরকার আসছে বাজেটে নতুন উদ্যোক্তাদের অর্থ বরাদ্দ রাখার চিন্তা করছে। অবশ্য তিনি এই বরাদ্দের পরিমাণ কত হবে তা নিয়ে কোনো তথ্য দেননি। তিনি বলেন, সরকার ইতোমধ্যে ঘরে ঘরে গিয়ে কর আদায়ের জন্য ১০ হাজার বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী নিয়োগের পরিকল্পনা করছে। তাদের ৩ থেকে ৬ মাসের জন্য নিয়োগ দেয়া হতে পারে। ফলে ১ কোটি নতুন করদাতা খুঁজে পাওয়া সহজ হবে। গত নভেম্বরে আন্তর্জাতিক শ্রম সংস্থার প্রকাশিত এক প্রতিবেদনে দেখা যায়, বাংলাদেশে তরুণদের মধ্যে বেকারত্বের হার বাড়ছেই। মাত্র সাত বছরে এই হার দ্বিগুণ হয়ে গেছে। সবচেয়ে বড় বিষয় হলো, উচ্চশিক্ষা এখন আর কাজ পাওয়ার নিশ্চয়তা দিতে পারছে না। তরুণেরা যত বেশি পড়ালেখা করছেন, তাদের তত বেশি বেকার থাকার ঝুঁকি তৈরি হচ্ছে। দেশে উচ্চশিক্ষিতদের মধ্যে বেকারত্বের হার সবচেয়ে বেশি। আন্তর্জাতিক শ্রম সংস্থার (আইএলও) আঞ্চলিক কর্মসংস্থান নিয়ে ওই প্রতিবেদনে বলা হয়, ২০০০ থেকে ২০১৭ সাল পর্যন্ত এই অঞ্চলের ২৮টি দেশের বেকারত্ব, তরুণদের কর্মসংস্থান, নিক্রিয় তরুণের হার, আনুষ্ঠানিক-অনানুষ্ঠানিক কর্মসংস্থান, কর্মসন্তুষ্টি ইত্যাদির তুলনামূলক চিত্র উঠে এসেছে। প্রতিবেদনে দেখা যায়, বাংলাদেশে তরুণদের মধ্যে বেকারত্ব ২০১০ সালের তুলনায় দ্বিগুণ হয়ে ২০১৭ সালে ১২ দশমিক ৮ শতাংশে দাঁড়িয়েছে। অন্যদিকে উচ্চশিক্ষিতদের মধ্যে বেকারত্ব ১০ দশমিক ৭ শতাংশ, যা এশিয়া ও প্রশান্ত মহাসাগরীয় ২৮টি দেশের মধ্যে দ্বিতীয় সর্বোচ্চ। বাংলাদেশের ওপরে আছে কেবল পাকিস্তান। বাংলাদেশের তরুণদের বড় অংশ আবার নিষ্‌িক্রয়। তারা কোনো ধরনের শিক্ষায় যুক্ত নন, প্রশিক্ষণ নিচ্ছেন না, আবার কাজও খুঁজছেন না। দেশে এমন তরুণের হার ২৭ দশমিক ৪ শতাংশ। মেয়েদের মধ্যে এই হার বেশি, ৪৫ শতাংশের কাছাকাছি। তথ্যমতে, প্রত্যেক বছর দেশের শ্রমশক্তিতে প্রায় ১৮ লাখ কর্মপ্রত্যাশী তরুণ-তরুণী যুক্ত হচ্ছেন, অথচ দেশের অভ্যন্তরীণ অর্থনীতি আট লাখের বেশি কর্মসংস্থান সৃষ্টি করতে পারছে না। বৈধ পথে বিদেশে অভিবাসী শ্রমিক-পেশাজীবী হিসেবে যেতে পারছেন প্রতি বছর পাঁচ থেকে ছয় লাখ। এখনো একজন বাংলাদেশি অভিবাসী বিদেশে যেতে বিশ্বের অন্যান্য দেশের অভিবাসীদের তুলনায় চার-পাঁচ গুণ বেশি অর্থ খরচ করছেন আদম বেপারিদের দৌরাত্ম্যে। ২০ মে দৈনিক প্রথম আলোয় কোন দেশে যেতে কত টাকা লাগছে, তার গবেষণালব্ধ বিবরণ প্রকাশিত হয়েছে। ওই বিবরণ মোতাবেক জনশক্তি রফতানিকারক এজেন্সির দালাল ধরে বিদেশে যেতে বাংলাদেশিদের গড়ে ৩ লাখ টাকার বেশি খরচ করতে হচ্ছে। মালয়েশিয়া যেতে খরচ পড়ছে ৩ লাখ ৬৫ হাজার টাকা, সৌদি আরবে যেতে সাড়ে ৪ লাখ টাকা। অথচ শ্রীলংকার একজন অভিবাসীকে কুয়েতে যেতে খরচ করতে হচ্ছে মাত্র সাড়ে ২৭ হাজার টাকার সমপরিমাণ অর্থ। মধ্যপ্রাচ্যে যেতে ভারত, ফিলিপাইন ও ইন্দোনেশিয়ার তরুণদের খরচ নাকি পড়ছে বাংলাদেশি লাখ টাকার নিচে। অন্যদিকে সম্প্রতি দেশের একটি জাতীয় পত্রিকার আয়োজনে তারুণ্যে বাজেট শীর্ষক এক সেমিনারে বক্তারা জানান, ওভেন গার্মেন্টের প্রয়োজনীয় কাপড়ের ৩০ থেকে ৩৫ শতাংশ দেশে উৎপাদিত হয়। এ খাতে বিনিয়োগের অনেক সুযোগ আছে। কিন্তু নানা প্রতিবন্ধকতায় এ খাতে বিনিয়োগ বাড়ছে না। এতদিন গ্যাস ও জমির সমস্যা ছিল। সরকার তার সমাধান করলেও এখন সমস্যা ব্যাংক ঋণের সুদহার। সুদহার কম হলে এ খাতে বিনিয়োগ বাড়বে। ওই অনুষ্ঠানে প্রধানমন্ত্রীর বিশেষ সহকারী ব্যারিস্টার শাহ আলী ফরহাদ বলেন, বর্তমান সরকার মনে করে, তারুণ্যের শক্তিই বাংলাদেশের সমৃদ্ধি। তবে কর্মসংস্থানের অভাব তরুণদের জন্য বড় সমস্যা। সরকার চলতি মেয়াদে দেড় কোটি কর্মসংস্থান সৃষ্টির পরিকল্পনা নিয়েছে। শিল্প স্থাপনে ইকোনমিক জোন করা হচ্ছে। তরুণ উদ্যোক্তাদের জন্য আলাদা নীতিমালা করা হচ্ছে। তরুণদের দক্ষতা বাড়াতে সরকার দুটি বিশেষ প্রকল্প হাতে নিয়েছে। বিজিএমইএ পরিচালক ও ঢাকা চেম্বারের সাবেক সভাপতি আসিফ ইব্রাহিম বলেন, দেশের সামনে ২০২১ সালের লক্ষ্য অর্জন, এসডিজি অর্জন এবং উন্নত দেশে উন্নীত হওয়ার মতো অনেক চ্যালেঞ্জ রয়েছে। চ্যালেঞ্জ মোকাবেলায় তরুণরাই সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ। কিন্তু তরুণদের কর্মসংস্থান ও বিনিয়োগের সহজ ব্যবস্থা করে দিতে হবে। কর অব্যাহতি, সহজে ব্যবসা করা, সুদহার কমানো, ভেনচার ক্যাপিটাল গঠন ও করপোরেট কর কমানোর ব্যবস্থা করতে হবে। ঢাকা চেম্বারের সাবেক সভাপতি আবুল কাশেম খান বলেন, বর্তমানে বাংলাদেশের সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ কর্মসংস্থান সৃষ্টি। উদ্যোক্তারা বিনিয়োগ করতে পারলেই কর্মসংস্থান হয়। কিন্তু জিডিপির অনুপাতে বেসরকারি বিনিয়োগ অনেকদিন ধরেই এক জায়গায় আটকে আছে। বিনিয়োগ বাড়াতে সহজে ব্যবসা করার ব্যবস্থা করতে হবে। তিনি বলেন, সরকার ভর্তুকি দিয়ে রাষ্ট্র মালিকানাধীন বাণিজ্যিক প্রতিষ্ঠান পরিচালনা করছে, যা বেসরকারি খাতের প্রতিযোগিতা বাড়িয়ে দিচ্ছে। তিনি বিদেশে বাংলাদেশি উদ্যোক্তাদের বিনিয়োগ করার সুযোগ উন্মুক্ত করার দাবি জানান। আইডিএলসির ব্যবস্থাপনা পরিচালক আরিফ খান বলেন, তরুণরাই ভবিষ্যৎ। তরুণরা চাকরি চাইলে চাকরি দিতে হবে। ব্যবসা করতে চাইলে অর্থায়ন করতে হবে। তরুণ উদ্যোক্তাদের জন্য জামানতবিহীন ঋণের পরিমাণ ৫০ লাখ টাকা হওয়া উচিত উলেস্নখ করে তিনি বলেন, তাদের মূলধন সহায়তা দিতে ভেনচার ক্যাপিটাল গঠন করা দরকার। তিনি বলেন, দেশে করদাতার সংখ্যা বাড়াতে হবে। অনলাইনে কর পরিশোধ ব্যবস্থা আরও সহজ করতে হবে। যারা ব্যবসা শুরু করছে তাদের জন্য পাঁচ বছরের কর অব্যাহতি সুবিধা দিতে হবে। সিপিডির সিনিয়র রিসার্চ ফেলো তৌফিকুল ইসলাম খান অনুষ্ঠানে ধারণাপত্র উপস্থাপন করেন। তিনি বলেন, সার্বিক বাজেট কাঠামোর বাইরে গিয়ে তরুণদের জন্য কিছু করা সম্ভব নয়। আর বর্তমান বাজেট কাঠামোতে চ্যালেঞ্জ হচ্ছে রাজস্ব আহরণ। বাংলাদেশের তরুণ সমাজের বিভিন্ন ভাগ রয়েছে। উদ্যোক্তাদের পাশাপাশি কৃষক ও শ্রমজীবী তরুণ রয়েছেন। সকলের জন্যই সুযোগ সৃষ্টি করতে হবে। দক্ষতা বাড়াতে হবে তরুণদের। শিক্ষা ও স্বাস্থ্যগত সেবা দিতে হবে। তিনি বলেন, এসএমই খাতে নতুন শিল্প হচ্ছে না, যদিও বড় শিল্প সম্প্রসারিত হচ্ছে। কর্মসংস্থানের জন্য এসএমই খাতে শিল্প স্থাপনে প্রণোদনা দিতে হবে। বেসিস সভাপতি সৈয়দ আলমাস কবির বলেন, তরুণরা আইসিটিতে আগ্রহী। এটা মেধার ব্যবসা। এর জন্য বড় অফিস বা কলকারখানা দরকার হয় না। দরকার সুলভ মূল্যে মানসম্পন্ন ইন্টারনেট। তিনি বলেন, বর্তমানে আইসিটি উত্তরণ পর্যায়ে রয়েছে। সমস্যা দক্ষ লোকের অভাব। সরকারের পরিকল্পনায় এখানে নজর দিতে হবে। ইস্টার্ন ব্যাংকের অতিরিক্ত ব্যবস্থাপনা পরিচালক হাসান ও. রশিদ বলেন, সরকার বাজেট ঘাটতি মেটাতে বেশি সুদ দিয়ে সঞ্চয়পত্র থেকে ঋণ নিচ্ছে। এতে ব্যাংকগুলো কম সুদে আমানত পাচ্ছে না। ফলে ব্যাংকের ঋণ দেয়ার সক্ষমতা কমছে। ফলে নতুন উদ্যোক্তাদের পাশে দাঁড়ানোর সুযোগও কমছে।