প্রায় দুই মাস ধরে বাজারে আলুর দাম চড়া। রাজধানীর বিভিন্ন বাজারে প্রতি কেজি আলুর দাম ৭০ থেকে ৭৫ কেজি দরে বিক্রি হচ্ছে। এর আগে কখনো এত বেশি সময় ধরে এত দামে আলু বিক্রি হয়নি।
আলুর দাম এত বাড়ার কারণ খুঁজছেন ক্রেতারা। বিক্রেতাদের যুক্তি, বেশি দামে কিনে এনে তো কম দামে বিক্রি করতে পারব না। পাইকারি বাজারে আলুর দাম বাড়লে খুচরা বাজারেও বাড়বে। না হয় আলু বিক্রিই বন্ধ করতে হবে। কিন্তু পাইকারি বাজারে কেন বেশি দাম হলো- এ কথা জানেন না খুচরা বিক্রেতা।
অনুসন্ধানে জানা গেছে, আলুচাষিদের ওপর দাদন প্রথার থাবা, বাজার কাঠামোতে কোল্ডস্টোরেজভিত্তিক মধ্যস্বত্বভোগীচক্রের প্রভাব আলুর বাজার নিয়ন্ত্রণে বাইরে চলে যাচ্ছে।
মিরপুরে-১৪ নম্বর নেভি গেট কাঁচাবাজারে আলুর কেজি ৭৫ টাকা দরে বিক্রি হচ্ছে বর্তমানে। এত দামের পরও গোমড়া মুখে কিনে নিয়ে যাচ্ছেন অনেকে। কারণ বাঙালির পাতে আলু চাই।
গত দুই মাস ধরে বাজারে বেড়েছে সব ধরনের সবজির দাম। বেড়েছে মাছ ও ডিমের দামও। এ সময় সবজি, ডিম কমিয়ে আলুর ওপর মানুষ নির্ভরতা বাড়ায়, জানালেন একাধিক ক্রেতা। ভর্তা, ভাজির চাহিদা বাড়ায় আলুরও দাম বেড়েছে।
বাজারে সবজির দাম বেড়ে যাওয়ায় আলুর ওপর নির্ভরতা বাড়িয়েছে কম আয়ের শ্রমজীবী মানুষ। নিম্নমধ্য ও মধ্যম আয়ের মানুষও বাজার করার ক্ষেত্রে হিসেবি হয়েছে।
মিরপুর-১৩ নম্বর কাঁচাবাজারে আসা আনেসা বেগম বলেন, সবজির দাম বাড়ায় আলু কিনছিলাম, যাতে বাজারের বাজেট আয়-সীমার মধ্যে থাকে। ভর্তা ও ভাজি ছাড়াও অন্য রান্নার সঙ্গে আলুর ব্যবহারে করে আসছিলাম। এখন আলুর দামও বেড়ে গেছে।
দাম বৃদ্ধির কী কারণ : সরেজমিনে খোঁজ নেওয়া হয় আলুর পাইকারি বাজার মিরপুর-১১ ও মিরপুর-১৪ এর কচুক্ষেতে। মিরপুরের পাইকারি বাজারে আলু বিক্রি হচ্ছে ৬৩ টাকায়। আলু বাড়তি দামেই বেশ কিছুদিন ধরে বিক্রি হচ্ছে জানালেন পাইকার ও আড়ৎদাররা।
পাইকারি আলু বিক্রেতা ইসমাইল বাণিজ্যালয়ের রাজিব আহমেদ জানান, মোকাম উত্তরাঞ্চল বা বিক্রমপুরের আলুর দাম বৃদ্ধির ফলে আমাদের এখানেও আলুর দাম বেড়েছে। আমরা কেজি প্রতি খুব কম লাভ করি। তিনি বলেন, বাজারে সবজির দাম বাড়ার সঙ্গে আলুর দাম বেড়েছে।
উৎপাদন কম হওয়া বা উৎপাদন ব্যয় বৃদ্ধির কারণে বেড়েছে এমনটিও না। বরং কোল্ডস্টোরেজ পর্যায়ে আলুর সিন্ডিকেটের কব্জার কারণে আলুর দাম বেড়েছে।
আলুর দাম অস্বাভাবিক বৃদ্ধির পেছনে বাজার ব্যবস্থাপনা ত্রম্নটি কাজ করছে বলে মনে করেন কনজুমারস অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশের (ক্যাব) সহ-সভাপতি এসএম নাজির হোসেন। তিনি ক্যাবের পর্যালোচনার উলেস্নখ করে এ কথা বলেন।
তিনি বলেন, আলু সংরক্ষণে কোল্ডস্টোরেজের একচ্ছত্র আধিপত্য ও নিয়ন্ত্রণের কারণে দাম বৃদ্ধি পায়। কৃষক থেকে ভোক্তা পর্যায়ে সাত থেকে আটটি স্তর থাকার কারণে ধাপে ধাপে আলুর দাম বৃদ্ধি পায়।
ক্যাবের অনুসন্ধান তুলে ধরে নাজির হোসেন বলেন, কোল্ডস্টোরেজের মালিকরা উৎপাদন পর্যায়ে তাদের নিজস্ব ব্যাপারীদের মাধ্যমে কৃষক পর্যায়ে দাদন দিয়ে থাকে। দাদন বণ্টন ও নিয়ন্ত্রণের কাজটি করে থাকে আলু উৎপাদন এলাকার এজেন্ট। ক্ষেত থেকে আলু ওঠার সঙ্গে সঙ্গে এজেন্টরা পূর্ব নির্ধারিত দামে মাঠ থেকে সংগ্রহ করে ব্যাপারীদের মাধ্যমে কোল্ডস্টোরেজে নেয়। যত দিন কৃষকের কাছে আলু থাকে তত দিন আলুর বাজার নিয়ন্ত্রণে থাকে। আর তারপরই আলুর দাম নিয়ন্ত্রণে নিয়ে নেয় কোল্ডস্টোরেজ-ব্যবসায়ী সিন্ডিকেট।
এখন যে আলু কারওয়ানবাজারে আসছে তা ট্রাক থেকে নামার পর দু'টি স্তর পেরিয়ে খুঁচরা পর্যায়ে ক্রেতাদের কাছে যায়। মূলত রাজধানীর বিভিন্ন পাইকারি বাজারগুলো কারওয়ানবাজারসহ দু'টি বাজার থেকেই নিয়ন্ত্রণ হয়, যা থাকে কোল্ডস্টোরেজের নিয়ন্ত্রণে, তিনি উলেস্নখ করেন।
মূল্যবৃদ্ধি রোধে ভর্তুকি মূল্যে বিক্রি :আলুর দাম নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে যাওয়ার প্রেক্ষাপটে টিসিবির খোলা ট্রাকে চাল, ডাল, ভোজ্যতেল ও পেঁয়াজের পাশাপাশি ৩০ টাকা দরে আলু বিক্রি শুরু করেছে। রাজধানীর ৫০টি স্পটে আলু বিক্রি হচ্ছে। ৩১ ডিসেম্বর পর্যন্ত টিসিবির ট্রাকে এ সব পণ্য বিক্রি হবে।
বুধবার রাজধানীর কারওয়ানবাজারে আলু বিক্রির এ কার্যক্রম উদ্বোধন করেন বাণিজ্য উপদেষ্টা সেখ বসির উদ্দিন। আলুর বাড়তি দামের মূল্যের সিন্ডিকেট রয়েছে স্বীকার করেন তিনি। বলেন, সরবরাহ ও পর্যবেক্ষণ ব্যবস্থা জোরদারের মাধ্যমে আমরা সিন্ডিকেট অকার্যকর করব।
তিনি ভোক্তা অধিকার অধিদপ্তরের পর্যবেক্ষণের মাধ্যমে কোল্ডস্টোরেজসহ বাজার ব্যবস্থার পর্যবেক্ষণ ও উন্নয়নের তাগিদ দেন।
উৎপাদন করার সঙ্গে সঙ্গে বিক্রি করে দিতে হয় : আলু উৎপাদন করেও কৃষক কোল্ডস্টোরে রাখতে পারেন না। আলু মাঠে থেকে ওঠানোর সঙ্গে সঙ্গে আগে টাকা নেওয়ায় মহাজনের কাছে বিক্রি করে দিতে হয়।
এ বিষয়ে বগুড়ার কৃষক মো. আব্দুল হাফিজ বলেন, আলু ওঠানোর পর কোল্ডস্টোরে রাখার মতো সামর্থ্য আমাদের নেই। ধার-দেনা করে বা হাতের কিছু বাড়তি টাকা খরচ করে আলু চাষ করি। আলু ওঠানোর সঙ্গে সঙ্গে বিক্রি করে দেই।
আলুর উৎপাদন ও বিপণন নিয়ে অন্ধকার : আলুর দাম প্রতিবারই নভেম্বর মাসের দিকে সর্বোচ্চ আকার ধারণ করে। অজুহাত তোলা হয় আলুর মজুদ কমে আসা। এ সময় আলু আমদানিও করা হয়, এবারও করা হচ্ছে। অথচ দেশে চাহিদার তুলনায় কমপক্ষে ২০ লাখ বেশি আলুর উৎপাদন হয়।
কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের হিসাবে দেশে আলুর বার্ষিক চাহিদা সর্বোচ্চ ৮০ লাখ টন। অথচ ২০২৩-২৪ অর্থবছরে উৎপাদন হয়েছে ১ কোটি টনের ওপরে। ৩০ লাখ টন বেশি বেশি উৎপাদন হয়েছে। তারপরও ঘাটতির অজুহাত তুলে আলুর দাম বাড়ানো হয়।
উৎপাদন খরচ ও বিক্রয় দাম : আলু উৎপাদন, উৎপাদন খরচের সঙ্গে যুক্ত থাকে সরকারের কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তর। কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের হিসেবে মতে, গত বছরে প্রতি কেজি আলু উৎপাদনের খরচ ছিল ১০ টাকা ৫১ পয়সা। এসব আলু অধিকাংশ মাঠ থেকে কৃষকরা ২০ থেকে ২১ টাকা কেজি দরে মহাজনদের কাছে বিক্রি করে দেন। অথচ সেই আলু রাজধানীর বাজারে বিক্রি হয় ৭০ টাকা কেজি দরে। এটা কোনোভাবেই গ্রহণযোগ্য নয়।
কৃষককের জন্য ঋণের ব্যবস্থা জরুরি : বিক্রমপুর ও রাজশাহীদের কৃষকরা জানান, আলুর অস্বাভাবিক দাম রোধে দাদন প্রথা বাতিল করে কৃষক যাতে সরাসরি কোল্ডস্টোরেজে রাখতে পারে সেই ব্যবস্থা করতে হবে। কৃষককে সরাসরি কৃষি ঋণের ব্যবস্থা করতে হবে। কৃষি সম্প্রসারণে আলুর উৎপাদনে খরচ নির্ধারণ করে থাকে। এক্ষেত্রে কীটনাশক আলুর বীজ ও আলু বিক্রির দামও বেঁধে দিতে হবে। যাতে কৃষকরা ক্ষতিগ্রস্ত না হয়, কোনো মধ্যস্বত্বভোগী সিন্ডিকেট করে আলু দাম বাড়িয়ে বাজার অস্থির করতে না পারে। এটা করতে পারলে বাজারে আলুর দাম স্বাভাবিক রাখা সম্ভব হবে।