সুদ পরিশোধের প্রভাব পড়ছে বৈদেশিক ঋণ প্রবাহে

চলতি অর্থবছরের প্রথম তিন মাসে বাংলাদেশের বৈদেশিক ঋণ পরিশোধের পরিমাণ নতুন ঋণগ্রহণের চেয়ে বেশি হয়েছে। জুলাই-সেপ্টেম্বরে ৮৪৬ মিলিয়ন ডলার নতুন ঋণ নিলেও সুদাসলে পরিশোধ করতে হয়েছে ১.১৩ বিলিয়ন ডলার

প্রকাশ | ২৭ অক্টোবর ২০২৪, ০০:০০

অর্থ-বাণিজ্য রিপোর্ট
বাংলাদেশের বৈদেশিক ঋণের সুদ পরিশোধের পরিমাণ গত তিন বছরে প্রায় তিনগুণ বেড়ে আকাশচুম্বী হয়েছে। পাশাপাশি দেশে বৈদেশিক ঋণপ্রবাহ কমে গিয়েছে। একই সময় ঋণের আসল পরিশোধের পরিমাণও বেড়েছে, যদিও এ বৃদ্ধি ৩২ শতাংশে সীমিত ছিল। এ ঋণ-চাপের বড় কারণ হিসেবে দেশের ঋণ গ্রহণের নীতিতে পরিবর্তনকে চিহ্নিত করা হচ্ছে। আগের মতো সহজলভ্য না থাকায় স্বল্প সুদের রেয়াতি ঋণ থেকে সরে এসে বাংলাদেশ এখন বাজারভিত্তিক ঋণের ওপর বেশি নির্ভর করতে বাধ্য হচ্ছে। রেয়াতি ঋণের সুদের হার সাধারণত ২ শতাংশ বা তার কম থাকে। বিশেষ করে, সিকিউরড ওভারনাইট ফাইন্যান্সিং রেট (সোফর)-ভিত্তিক ঋণের সুদ আড়াই বছর আগে ১ শতাংশের নিচে থাকলেও বর্তমানে তা সাড়ে ৫ শতাংশ পর্যন্ত পৌঁছেছে। ফলে দেশের বৈদেশিক ঋণ পরিশোধের চাপ অনেকাংশে বৃদ্ধি পেয়েছে। অর্থনৈতিক সম্পর্ক বিভাগ (ইআরডি) সূত্রে জানা গেছে, চলতি অর্থবছরের প্রথম তিন মাসে বাংলাদেশের বৈদেশিক ঋণ পরিশোধের পরিমাণ নতুন ঋণগ্রহণের চেয়ে বেশি হয়েছে। জুলাই-সেপ্টেম্বর সময় দেশটি ৮৪৬ মিলিয়ন ডলার নতুন ঋণ নিলেও সুদাসলে পরিশোধ করতে হয়েছে ১.১৩ বিলিয়ন ডলার। ২০২১২২ অর্থবছরে দেশের সুদ পরিশোধের পরিমাণ ছিল ৪৯১ মিলিয়ন ডলার, যা ২০২৩-২৪ অর্থবছরে এসে দাঁড়ায় প্রায় ১.৩৫ বিলিয়ন ডলারে। একই সময় ঋণের আসল পরিশোধ ১.৫ বিলিয়ন ডলার থেকে বেড়ে ২ বিলিয়ন ডলারের কিছু বেশিতে পৌঁছে। ফলে দুবছর আগের ৮.১৫ বিলিয়ন ডলার নিট ঋণপ্রবাহ ২০২৩-২৪ অর্থবছরে নেমে দাঁড়িয়েছে ৬.৫ বিলিয়ন ডলারে। বাজারভিত্তিক ঋণের ওপর ক্রমবর্ধমান নির্ভরশীলতার কারণে ঋণ পরিষেবা খরচও উলেস্নখযোগ্যভাবে বেড়েছে। ২০২৩-২৪ অর্থবছরে বাজারভিত্তিক ঋণ দাঁড়ায় বাংলাদেশের মোট বৈদেশিক ঋণের ২৮.১ শতাংশ, যা ২০১৯-২০ অর্থবছরে ছিল মাত্র ১৫.৮ শতাংশ। বাংলাদেশের উন্নয়ন অংশীদারদের কাছ থেকে মূলত দু ধরনের ঋণ নেয়: নির্ধারিত সুদহারযুক্ত ঋণ এবং বাজারভিত্তিক ফ্লোটিং রেট [পরিবর্তনশীল] ঋণ। এর মধ্যে দ্বিতীয়টি সোফর এবং ইউরোবরের (ইউরো ইন্টারব্যাংক অফারড রেট) সঙ্গে ওঠানামা করে। তিন বছর আগে সোফর ছিল ১ শতাংশের নিচে, তাই বাজারভিত্তিক ঋণের প্রভাব সীমিত ছিল। কিন্তু ইউক্রেন-রাশিয়া যুদ্ধের পর এ হার বেড়ে সাড়ে ৫ শতাংশে পৌঁছায়। যদিও সম্প্রতি এটি ৪ দশমিক ৮ শতাংশে নেমেছে। বাংলাদেশকে এখন সোফর-ভিত্তিক ঋণের জন্য ৬ থেকে ৭ শতাংশ সুদ দিতে হচ্ছে। ইউরোবর-ও গত তিন বছরে উলেস্নখযোগ্যভাবে বেড়েছে। ২০২১ সালের গোড়ার দিকে এটি ঋণাত্মক শূন্য দশমিক ৫৫ শতাংশ থেকে ২০২৪ সালের মাঝামাঝিতে ৩ শতাংশের বেশি হয়েছে। ইআরডির তথ্য অনুযায়ী বৈদেশিক ঋণের মূল পরিশোধ বার্ষিক ১৫ শতাংশ হারে বাড়লেও ২০২৩-২৪ অর্থবছরে সুদ পরিশোধ বেড়েছে ৪৫ দশমিক ৫৯ শতাংশ, যা আগের অর্থবছরে ছিল আরও বেশি ৮৮ দশমিক ৭১ শতাংশ। ইআরডি কর্মকর্তারা জানান, উন্নয়ন সহযোগীদের কাছ থেকে রেয়াতি ঋণ কমে আসার ফলে ঋণ পরিষেবার ব্যয় বাড়ছে। বাংলাদেশ উন্নয়ন গবেষণা প্রতিষ্ঠানের (বিআইডিএস) গবেষণা পরিচালক মনজুর হোসেন বলেন, 'শুধু ঋণপ্রবাহ বাড়ছে বা কমছে তা বিবেচ্য নয়, বরং ভবিষ্যতের ঋণ অর্থায়নে আরও সতর্কতা অবলম্বন করা প্রয়োজন। আমরা যে ধরনের ঋণ নিচ্ছি, তার সুদের হারগুলো যাচাই করা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। ঋণের অর্থ দুর্নীতি ও অপচয় রোধ করে সঠিক প্রকল্পে বিনিয়োগে ব্যবহার নিশ্চিত করতে হবে। এডিবির ঋণের অর্ধেক বাজারভিত্তিক অর্থনৈতিক সম্পর্ক বিভাগ (ইআরডি) সূত্রে জানা গেছে, বাজারভিত্তিক সুদহারের ভিত্তিতে বাংলাদেশ এশীয় উন্নয়ন ব্যাংক (এডিবি) থেকে সবচেয়ে বেশি ঋণ গ্রহণ করে। গত অর্থবছরে এডিবিকে সুদ বাবদ ৫১৮.৭৪ মিলিয়ন ডলার পরিশোধ করতে হয়েছে। ২০২৩২৪ অর্থবছরে এডিবির সঙ্গে মোট ঋণচুক্তির পরিমাণ ছিল ২.৯৪ বিলিয়ন ডলার, যার প্রায় অর্ধেক ৪৯ দশমিক ৪৫ শতাংশ ছিল বাজারভিত্তিক সুদে। অন্যদিকে বিশ্বব্যাংকের কাছ থেকে গত অর্থবছরে পাওয়া ৯০ মিলিয়ন ডলার ঋণও বাজারভিত্তিক সুদহারে নেওয়া হয়েছিল। এশিয়ান ইনফ্রাস্ট্রাকচার ইনভেস্টমেন্ট ব্যাংক (এআইআইবি) থেকে বাংলাদেশের নেওয়া ঋণের সবই বাজারভিত্তিক সুদে হওয়ায় গত অর্থবছরে উচ্চ সুদহারের কারণে এআইআইবি থেকে কোনো প্রকল্প-ঋণ নেওয়া হয়নি। তবে রিজার্ভের সহায়ক হিসেবে বাজেট সহায়তা চুক্তির আওতায় এআইআইবি থেকে ৪০০ মিলিয়ন ডলার ঋণ নিয়েছে বাংলাদেশ। প্রথম প্রান্তিকে ঋণাত্মক নিট প্রবাহ ইআরডির তথ্য অনুযায়ী, চলতি অর্থবছরের প্রথম তিন মাসে বৈদেশিক ঋণ পরিশোধের পরিমাণ উন্নয়ন সহযোগীদের কাছ থেকে প্রাপ্ত ঋণকে ছাড়িয়ে গেছে। জুলাই সেপ্টেম্বরে সুদ ও মূল পরিশোধের পর বৈদেশিক সাহায্যের নিট প্রবাহ দাঁড়িয়েছে ঋণাত্মক ২৭৯ মিলিয়ন ডলারে। গত বছরের একই সময়ের তুলনায় চলতি বছরের জুলাই-সেপ্টেম্বরে বিদেশি ঋণ পরিশোধের পরিমাণ ২৯ শতাংশ বৃদ্ধি পেয়েছে। ইআরডির তথ্য অনুযায়ী, এ সময় মূল পরিশোধ বেড়ে ৬৮৫.৫ মিলিয়ন ডলার এবং সুদ পরিশোধ বেড়ে ৪৪১ মিলিয়ন ডলারে পৌঁছেছে, যা আগের বছর একই সময় ছিল যথাক্রমে ৪৯২ মিলিয়ন ও ৩৭৮.৪৬ মিলিয়ন ডলার। ইআরডি এবং সাধারণ অর্থনীতি বিভাগ (জিইডি)-এর পূর্বাভাস অনুযায়ী, ২০২০ সালে দেশের মোট বৈদেশিক ঋণের ২৬ শতাংশ বাজারভিত্তিক সুদে ছিল, যা ২০৪১ সালে ৮২ শতাংশের বেশি হবে। সরকারি দাতাদের কাছ থেকে পাওয়া রেয়াত সুবিধার ঋণ হ্রাস পাওয়ায় ঋণ পরিষেবা খরচও ক্রমশ বাড়াবে বলে ইআরডির প্রতিবেদনে বলা হয়েছে। সাম্প্রতিক বছরগুলোয় বাংলাদেশ বিশ্বব্যাংকের ইন্টারন্যাশনাল ডেভেলপমেন্ট অ্যাসোসিয়েশনের (আইডিএ) রেয়াতি ঋণ এবং এডিবির অর্ডিনারি ক্যাপিটাল রিসোর্সের (ওসিআর) ঋণ সমন্বয় করে ঋণ নিচ্ছে। প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, বিশ্বব্যাংক ও এডিবির পর অন্যান্য বহুপাক্ষিক উন্নয়ন সহযোগীরাও আগামী বছরগুলোয় বাংলাদেশে ছাড় দেওয়া ঋণের পরিমাণ ধীরে ধীরে কমিয়ে আনবে।