বিশ্বের বেশির ভাগ দেশ মূল্যস্ফীতি ও সুদহারের টানাপড়েনে ভুগছে। একই সময় প্রধান বৈদেশিক মুদ্রার বিনিময় হারের উত্থান-পতন দেশগুলোর জন্য আন্তর্জাতিক ঋণের খরচ বাড়িয়ে দিচ্ছে। এমন পরিস্থিতিতে বৈশ্বিক ঋণদাতা সংস্থাগুলোর প্রতি ঋণব্যয় কমানোর সুযোগ পেতে আহ্বান জানিয়ে আসছিল গ্রহীতা দেশগুলো। এতে সাড়া দিয়েছে অন্যতম সংস্থা আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিল (আইএমএফ)। সম্প্রতি সংস্থাটি ঋণ পরিশোধ প্রক্রিয়ায় বড় ধরনের সংস্কার এনেছে, যাতে বছরে সদস্যদেশগুলোর সাশ্রয় হবে ১২০ কোটি ডলার। সারচার্জ দেওয়া থেকে মুক্তি পাচ্ছে সাতটি ঋণগ্রহীতা দেশ।
গত শুক্রবার আইএমএফের ব্যবস্থাপনা পরিচালক ক্রিস্টালিনা জর্জিয়েভা বিষয়গুলো নিশ্চিত করে জানান, সদস্যদেশগুলোর নেওয়া ঋণ বাবদ খরচ কমাতে একগুচ্ছ নীতি অনুমোদন করেছে সংস্থাটি। এতে দেশগুলোর বার্ষিক ১২০ কোটি ডলার সাশ্রয় হবে। আগামী ১ নভেম্বর থেকে নতুন পরিবর্তনগুলো প্রযোজ্য হবে।
সংস্কার হওয়া নীতিগুলোর মধ্যে প্রাধান্য পাচ্ছে সুদহার ও সারচার্জ হ্রাস। এ বিষয়ে ক্রিস্টালিনা জর্জিয়েভা বলেন, 'অনুমোদিত পদক্ষেপ সদস্যদের জন্য আইএমএফ থেকে নেওয়া ঋণ বাবদ খরচ ৩৬ শতাংশ বা বার্ষিক প্রায় ১২০ কোটি ডলার কমিয়ে দেবে।'
তিনি আরও বলেন, '২০২৬ অর্থবছরে সারচার্জ পরিশোধকারী দেশের সংখ্যা ২০-১৩-এ নেমে আসবে।'
সুদহার ছাড়াও আইএমএফের ঋণের বিপরীতে অনেক দেশকে সারচার্জের মতো অতিরিক্ত ফি দিতে হয়। এ নিয়ে অনেকদিন ধরে বিতর্ক চলমান। সাধারণত নির্দিষ্ট পরিমাণ অর্থ বা মেয়াদের বেশি ঋণের ওপর সারচার্জ আরোপ করা হয়। নতুন নিয়মানুসারে, এতে অতিরিক্ত ফি এবং সারচার্জ কমানোর জন্য ঋণের সীমা বাড়ানো হবে। এর অর্থ আগের চেয়ে কম দেশ অতিরিক্ত চার্জের মুখোমুখি হবে। এখন থেকে দেশগুলো শুধু সুদ পরিশোধের মাধ্যমে ঋণের ব্যয়নির্বাহ করবে।
আইএমএফ ঋণের প্রধান ব্যয় হলো নিয়মিত সুদ। এরপর একটি নির্দিষ্ট থ্রেশহোল্ড বা মেয়াদের ওপর ঋণের জন্য সারচার্জ ও সতর্কতামূলক ব্যবস্থা হিসেবে ধার্যকৃত ফি। আইএমএফ বলেছে, বিতরণ করা ঋণের সুদহারের ওপর চার্জ কমানো হবে। এখন ঋণের পরিমাণ এবং পরিশোধের সময়কালের থ্রেশহোল্ড বাড়বে, প্রতিশ্রম্নতি ফিগুলোর থ্রেশহোল্ডও বাড়বে। ফলে আইএমএফের ঋণ আগের চেয়ে সহজ ও সাশ্রয়ী হয়ে উঠবে।
এ বিষয়ে ক্রিস্টালিনা জর্জিয়েভা বলেন, 'ঋণের খরচ যথেষ্ট পরিমাণে কমানো হলেও চার্জ ও সারচার্জগুলো আইএমএফের সমবায় ধাঁচের ঋণদান এবং ঝুঁকি ব্যবস্থাপনা কাঠামোর একটি অপরিহার্য অংশ হিসেবে রয়ে গেছে। কারণ, এতে সব সদস্য অবদান রাখে এবং প্রয়োজনে সবার সমর্থন থেকে দেশগুলো উপকৃত হতে পারে।'
প্রায় এক দশক পর আলোচ্য বিষয়গুলোর মাধ্যমে আইএমএফের ঋণ প্রক্রিয়ায় পরিবর্তন আসতে যাচ্ছে। ২০১৬ সালের পর এবারই প্রথম ফি ও সারচার্জের বিষয়ে নিজেদের নীতি পর্যালোচনা করার সিদ্ধান্ত নিয়েছে সংস্থাটি। কারণ হিসেবে বলা হচ্ছে, উচ্চ সুদহারের কারণে বিশ্বব্যাপী ঋণের ব্যয় এখন অনেক বেড়েছে। এ কারণে ঋণ নেওয়া দেশগুলো নির্ধারিত সময় ঋণ পরিশোধে হিমশিম খাচ্ছে।
এ বাস্তবতা সামনে রেখে ক্রিস্টালিনা জর্জিয়েভা বলেন, 'একটি চ্যালেঞ্জিং বৈশ্বিক পরিবেশ এবং উচ্চ সুদহারের সময় আমাদের সদস্যরা একটি বিস্তৃত প্যাকেজের বিষয়ে ঐকমত্যে পৌঁছেছে, যা প্রয়োজনে দেশগুলোকে সহায়তা করার জন্য আইএমএফের আর্থিক সক্ষমতা রক্ষার পাশাপাশি সদস্যদের ঋণ বাবদ ব্যয়কে উলেস্নখযোগ্যভাবে কমিয়ে আনবে।'
যুক্তরাষ্ট্রের বোস্টন বিশ্ববিদ্যালয়ের গেস্নাবাল ডেভেলপমেন্ট পলিসি সেন্টারের গবেষণা অনুসারে, ইউক্রেন, মিসর, আর্জেন্টিনা, ইকুয়েডর ও পাকিস্তান সর্বোচ্চ সারচার্জ প্রদানকারী পাঁচটি দেশ।
এ দেশগুলোর মধ্যে আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিল থেকে সবচেয়ে বেশি ঋণ করেছে আর্জেন্টিনা। সম্প্রতি বিষয়টি নিশ্চিত করেছেন দক্ষিণ আমেরিকার দেশটির অর্থমন্ত্রী পাবলো কুইরনো। আর নীতি পরিবর্তনের কারণে আর্জেন্টিনার সাশ্রয় হবে ৩০০ কোটি ডলারেরও বেশি।
একই সঙ্গে আট দেশের ওপর থেকে সারচার্জ দেয়ার বাধ্যবাধকতা উঠে যাচ্ছে। এ দেশগুলো হলো- বেনিন, আইভরি কোস্ট, গ্যাবন, জর্জিয়া, মলদোভা, সেনেগাল, শ্রীলংকা ও সুরিনাম।
আইএমএফের এই নীতি সংস্কারের ফলে অনেক সদস্যদেশ লাভবান হলেও সারচার্জ বিষয়ে শিক্ষাবিদ, অলাভজনক গোষ্ঠী ও অন্য অর্থনীতিবিদদের দাবি পুরোপুরি মানা হয়নি। এসব গোষ্ঠী অনেকদিন ধরে সংস্থাটির বিতরণ করা ঋণের ওপর থেকে সারচার্জ সম্পূর্ণ বাতিল করার পক্ষে যুক্তি দিয়ে আসছে। তাদের মতে, সাধারণত গুরুতর অর্থনৈতিক পরিস্থিতিতে আইএমএফের দ্বারস্থ হয় বেশির ভাগ দেশ। তখন সারচার্জের মতো ফি ঋণগ্রহীতা দেশের ওপর অতিরিক্ত বোঝা চাপিয়ে দেয়, যা ঋণগ্রহীতাদের জন্য অর্থনৈতিক উন্নতির চেয়ে নতুন প্রতিকূল পরিবেশ তৈরি করে।