শনিবার, ১২ অক্টোবর ২০২৪, ২৭ আশ্বিন ১৪৩১
অস্থিতিশীল ডিমের বাজার

চাহিদা ও উৎপাদন তথ্যে বড় গরমিল

জাতিসংঘের খাদ্য ও কৃষি সংস্থার তথ্য অনুযায়ী, দেশে এখন দৈনিক ডিমের চাহিদা ৫ কোটি পিস। আর পোলট্রি খাতের উদ্যোক্তাদের সংগঠন বাংলাদেশ পোলট্রি ইন্ডাস্ট্রিজ সেন্ট্রাল কাউন্সিলের (বিপিআইসিসি) হিসাবে, দেশে দৈনিক ডিমের উৎপাদন ৪.৫ কোটি পিস। দক্ষিণ-পূর্বাঞ্চলের ঘটে যাওয়া বন্যায় ৫০ লাখ পিস কমে ৪ কোটিতে নেমেছে ডিমের উৎপাদন সে হিসাব ডিমে চাহিদা ও উৎপাদনে ১ কোটি ব্যবধান রয়েছে।
রেজা মাহমুদ
  ১২ অক্টোবর ২০২৪, ০০:০০
চাহিদা ও উৎপাদন তথ্যে বড় গরমিল

কোনোভাবেই নিয়ন্ত্রণে আসছে না ডিমের বাজার। এমন পরিস্থিতিতে দাম নির্ধারনসহ ৪ কোটি পিস ডিম আমদানির অনুমতি দেয় সরকার। তবে বাজার চলছে আগের দামেই। সরকারি সংস্থার হিসাবে চাহিদার তুলনায় দেশে ডিমের উৎপাদন বেশি। কিন্তু ব্যবসায়ীরা বলছেন চাহিদা ও উৎপানের মধ্যে তথ্য বড় গরমিলই সংকটের মূলে।

সংশ্লিষ্টরা বলছেন, বর্তমানে দেশে মোট ডিমের উৎপাদন ও বর্ধিত চাহিদার মধ্যে অন্তত ১ কোটি পিসের ফারাক রয়েছে। যদিও প্রাণিসম্পদ অধিদপ্তর মনে করে সাম্প্রতিক বন্যায় ডিমের উৎপাদন প্রায় অর্ধ কোটি কমে যাওয়া ও প্রোটিনের অন্যান্য উৎসের দাম বেশি হওয়ায় ডিমের চাহিদা বৃদ্ধি বাজারে প্রভাব ফেলছে।

জাতিসংঘের খাদ্য ও কৃষি সংস্থার তথ্য অনুযায়ী, দেশে এখন দৈনিক ডিমের চাহিদা ৫ কোটি পিস। আর পোলট্রি খাতের উদ্যোক্তাদের সংগঠন বাংলাদেশ পোলট্রি ইন্ডাস্ট্রিজ সেন্ট্রাল কাউন্সিলের (বিপিআইসিসি) হিসাবে, দেশে দৈনিক ডিমের উৎপাদন ৪.৫ কোটি পিস। দক্ষিণ-পূর্বাঞ্চলের ঘটে যাওয়া বন্যায় ৫০ লাখ পিস কমে ৪ কোটিতে নেমেছে ডিমের উৎপাদন সে হিসাব ডিমে চাহিদা ও উৎপাদনে ১ কোটি ব্যবধান রয়েছে।

অথচ ডিমের উৎপাদনে ভিন্ন তথ্য দিচ্ছে প্রাণিসম্পদ অধিদপ্তর। তাদের তথ্য বলছে, ডিমের দৈনিক উৎপাদন ৬.৩০ কোটি পিস। এখান থেকে ৫০ লাখ পিস উৎপাদন কমে ৫.৮০ কোটি পিসে নামলেও তা দৈনিক চাহিদার তুলনায় বেশি। ফলে সংস্থাটি ডিম আমদানির বিপক্ষে মত দিয়েছিলেন।

তাদের মতে, অপ্রত্যাশিত বন্যায় বাজারে মাছ, শাকসবজিসহ সবকিছুর দাম বেড়েছে, তাই ডিমের ওপর বাড়তি চাপ পড়েছে। এজন্য বাজারে সাময়িক অস্থিরতা বিরাজ করছে। বৃষ্টি কেটে গেলে যখন শীতের শাকসবজি বাজারে আসতে শুরু করবে, তখনই ডিমের দাম নিয়ন্ত্রণে চলে আসবে।

কিন্তু চাহিদা ও উৎপাদনের তথ্যে এমন অসামঞ্জস্যতা বাজারে ভুল তথ্য দিয়ে ক্রেতার ব্যয় বাড়িয়ে দিচ্ছে। যদি চাহিদার তুলনায় উৎপাদন বেশি হয়ে থাকে তাহলে সরকারের বাজার ব্যবস্থাপনার বড় সমস্যা রয়েছে বলে মনে করেন বিশ্লেষকরা।

এ বিষয়ে বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের পোলট্রি বিজ্ঞান বিভাগের অধ্যাপক ড. বাপন দে বলেন, আসলে চাহিদা উৎপাদনের পরিষ্কার তথ্য থাকা দরকার। সেটা না হলে সুষ্ঠু ব্যবস্থাপনা সম্ভব না। ডিমসহ অনেক পণ্যের ক্ষেত্রে তা নেই। তিনি বলেন, আবার আমাদের বাজার ব্যবস্থাপনা ঠিক না। ছয়-সাতবার ডিম হাতবদল হচ্ছে। আর প্রতিজনই লাভ নিচ্ছেন। ফলে উৎপাদনকারী কম লাভ পাচ্ছেন, কিন্তু ভোক্তা পর্যায়ে দাম বেড়ে যাচ্ছে। এজন্য সরকারের বিভিন্ন মন্ত্রণালয়ের সমন্বয়ে বাজার মনিটরিং জোরদার করা প্রয়োজন।

প্রাণিসম্পদ অধিদপ্তরের বাৎসরিক তথ্যানুযায়ী, ২০২৩-২৪ অর্থবছরে দেশে ডিমের চাহিদা ছিল ১ হাজার ৮০৯ কোটি ৬০ লাখ পিস। বিপরীতে উৎপাদন হয় ২ হাজার ৩৭৪ কোটি ৯৭ লাখ। উদ্বৃত্ত থাকে ৫৬৫ কোটি ৩৭ লাখ পিস ডিম। ২০২২-২৩ অর্থবছরে চাহিদা ছিল ১ হাজার ৮০৬ কোটি ৪৮ লাখ, উৎপাদন হয়েছে ২ হাজার ৩৩৭ কোটি ৬৩ লাখ পিস। সে হিসাবে উদ্বৃত্ত ছিল ৫৩১ কোটি ১৫ লাখ পিস।

প্রাণিসম্পদ অধিদপ্তরের মহাপরিচালক মোহাম্মদ রেয়াজুল হক বলেন, বাজারে মাছ, সবজির সরবরাহ কম, দামও চড়া। এ কারণে ডিমের ওপর একটা বাড়তি চাপ বেড়েছে, বাড়তি চাহিদা তৈরি হয়েছে। তিনি বলেন, আমাদের ডিমের উৎপাদন এখনো চাহিদার চেয়ে বেশি, যে কারণে আমরা আমদানি না করার বিষয়ে মত দিয়েছিলাম। তবে আমাদের ডিমের উৎপাদন আরও এক কোটি পিস বাড়ানো দরকার।

এদিকে, আমদানির খবরে বাজারে ডিমের দাম কমলেও এখনো প্রতি ডজন ডিম ১৬৫-১৭৫ টাকার মধ্যে বিক্রি হচ্ছে। যা সরকার বেঁধে দেওয়া দামের চেয়ে বেশি। গত সপ্তাহে ডিমের দাম ডজন প্রতি ১৮০ টাকা পর্যন্ত উঠেছিল।

প্রাণিসম্পদ অধিদপ্তর বলছে, অপ্রত্যাশিত বন্যায় এখনো সেভাবে শীতকালীন সবজি আসেনি। মাছের দাম বেশি। এ কারণে ডিমের চাহিদা বেশি, দামও বেড়েছে। বৃষ্টি পরিস্থিতি কেটে গেলে যখন শীতের সবজিগুলো বাজারে আসতে থাকবে তখনই ডিমের দাম নিয়ন্ত্রণে চলে আসবে।

তবে যত দ্রম্নত সম্ভব স্থানীয়ভাবে উৎপাদন বাড়িয়ে সরবরাহ স্বাভাবিক করার বিকল্প নেই বলেই জানান উৎপাদন সংশ্লিষ্টরা। প্রান্তিক খামারিদের সংগঠন বাংলাদেশ পোলট্রি অ্যাসোসিয়েশনের (বিপিএ) সভাপতি মো. সুমন হাওলাদার বলেন, বন্যায় হাজার হাজার খামার একেবারে বন্ধ হয়ে গেছে। এ কারণে ডিমের সরবরাহ কমেছে। কিন্তু এ সময় করপোরেট প্রতিষ্ঠানগুলো ডিমের দাম বাড়িয়ে বিক্রি করছে বলে বাজারে অস্থিরতা। তাদের সুবিধা দিতে সরকার এখনো এ খাতে উৎপাদন কমার বিষয়টি গোপন করছে। তারপরও আমদানি করে করে সবার ক্ষতি না করে সরকারের উচিত করপোরেট কোম্পানিগুলোকে ধরা এবং ক্ষতিগ্রস্ত খামারিদের পুনরায় উৎপাদনে ফিরিয়ে আনা।

এই খামারির দাবি, প্রান্তিক খামারি ডিম এবং মুরগি উৎপাদন করে, কিন্তু দাম নির্ধারণ করতে পারে না। দাম নির্ধারণ করে করপোরেট গ্রম্নপ ও তেজগাঁও ডিম ব্যবসায়ী সমিতি। তাদের সুবিধামতো যে দাম নির্ধারণ করে সে দামে প্রান্তিক খামারিদের ডিম, মুরগি বিক্রয় করতে হয়। উৎপাদন কম বা বেশি যাই হোক। অন্যদিকে কোম্পানিগুলো বারবার বাজারে সিন্ডিকেট করে হাজার হাজার কোটি টাকা লুট করে নিলেও তাদের শাস্তি না হওয়ায় বাজারে অস্থিরতা বেড়েই চলছে।

বাংলাদেশ পোলট্রি ইন্ডাস্ট্রিজ সেন্ট্রাল কাউন্সিলের (বিপিআইসিসি) তথ্য অনুযায়ী, দেশে ডিমের উৎপাদনের ১৩.৯৬ শতাংশ বা ৬০ লাখ পিস সরবরাহ করে বড় প্রতিষ্ঠান এবং বাকি ৮৬.০৪ শতাংশ সরবরাহ আসে ক্ষুদ্র খামারি থেকে। এ হিসাব করা হয়েছে বন্যার আগের প্রতিদিনের সাড়ে ৪ কোটি পিস উৎপাদনের তথ্য থেকে।

পরিস্থিতি বিবেচনায় সরকার সাত প্রতিষ্ঠানকে সাড়ে চার কোটি ডিম আমদানির অনুমতি দিয়েছে। এছাড়া বাজারে ডিমের দাম কমাতে ডিম আমদানির ওপর থাকা শুল্ক-কর সাময়িকভাবে প্রত্যাহারের সুপারিশ করেছে বাংলাদেশ ট্রেড অ্যান্ড ট্যারিফ কমিশন।

  • সর্বশেষ
  • জনপ্রিয়

উপরে