রোববার, ২৯ সেপ্টেম্বর ২০২৪, ১৩ আশ্বিন ১৪৩১

শিল্পাঞ্চলে আইনশৃঙ্খলা জোরদার ও উদ্যোক্তাদের আস্থা ফিরিয়ে আনার দাবি

উচ্চ সুদ হার, উচ্চ বিনিময় হার, ব্যবসায়িক মূলধনের খরচ বৃদ্ধির কারণে সিএমএসএমই খাতে প্রকৃত ঋণপ্রবাহের কার্যকর হার সংকুচিত করছে
অর্থ-বাণিজ্য রিপোর্ট
  ২৯ সেপ্টেম্বর ২০২৪, ০০:০০
শিল্পাঞ্চলে আইনশৃঙ্খলা জোরদার ও উদ্যোক্তাদের আস্থা ফিরিয়ে আনার দাবি

ব্যাংক ঋণের সুদের হার বাড়তে থাকলে মূল্যস্ফীতি সাময়িকভাবে কমবে। তবে এভাবে সুদহার বাড়লে ঋণপ্রবাহও কমে যাবে। তাই সুদ হার পুর্নবিবেচনার প্রয়োজন। এ ছাড়া নিরবচ্ছিন্নভাবে পণ্য উৎপাদনের মাধ্যমে রপ্তানি অব্যাহত রাখার লক্ষ্যে বিশেষ করে শিল্পাঞ্চলে আইনশৃঙ্খলা জোরদারের পাশাপাশি উদ্যোক্তাদের আস্থা ফিরিয়ে আনার ওপর জোরারোপ করেন ঢাকা চেম্বার অব কমার্স অ্যান্ড ইন্ডাস্ট্রি (ডিসিসিআই) সভাপতি আশারাফ আহমেদ।

শনিবার ডিসিসিআই আয়োজিত 'বাংলাদেশের অর্থনীতির দ্বিবার্ষিক পর্যালোচনা (জানুয়ারি-জুন, অর্থবছর ২০২৪); প্রেক্ষিত বেসরকারি খাত' শীর্ষক সেমিনারে তিনি এই অভিমত জ্ঞাপন করেন।

ডিসিসিআই সভাপতি আশরাফ আহমেদ সেমিনারে ২০২৪ অর্থবছরের জানুয়ারি-জুন সময়কালে অর্থনীতির সার্বিক প্রেক্ষাপটের ওপর মূল প্রবন্ধ উপস্থাপন করেন। মূল প্রবন্ধে তিনি বাংলাদেশের অর্থনীতিতে বৈশ্বিক ভূ-অর্থনীতির প্রভাব, বাজেট ও মুদ্রানীতির বাস্তবায়ন অবস্থা, মূল্যস্ফীতি, বেসরকারি বিনিয়োগ, আন্তর্জাতিক বাণিজ্য, কৃষি ও কৃষি প্রক্রিয়াজাতকরণ, তৈরি পোশাক, চামড়া ও চামড়াজাত পণ্য, ওষুধ শিল্প, সিএমএসএমই, বিদু্যৎ ও জ্বালানি, এলডিসি উত্তরণ পরবর্তী চ্যালেঞ্জ এবং আর্থিক খাত নিয়ে বিস্তারিত আলোকপাত করেন।

এ সময় তিনি বলেন, বিদ্যমান পরিস্থিতি মোকাবিলায় কেন্দ্রীয় ব্যাংক কর্তৃক গৃহীত উচ্চ সুদ হার এবং মুদ্রা বিনিময় নিয়ন্ত্রণের উদ্যোগ নিয়েছে, তবে দেশে মূল্যস্ফীতি কমে যাওয়ার পরিস্থিতি বিবেচনায় এই সিদ্ধান্ত পুনর্বিবেচনা করা প্রয়োজন বলে তিনি মত প্রকাশ করেন। ডিসিসিআই সভাপতি আরও বলেন, আমাদের শিল্প-কারখানায় প্রয়োজনীয় জ্বালানি সরবরাহ নিশ্চিতের মাধ্যমে পণ্য উৎপাদন বাড়িয়ে রপ্তানি অব্যাহত রাখতে হবে। তিনি আশা করেন, বেলেন্স অব পেমেন্টের ক্ষেত্রে সংশ্লিষ্ট জটিলতা অচিরেই নিরসন হবে এবং মার্কিন ডলারের সুদ হার হ্রাসের ফলে বাংলাদেশি টাকার মান বৃদ্ধি পাবে।

সেই সঙ্গে বিনিয়োগ বৃদ্ধির পাশাপাশি ব্যবসা সহায়ক পরিবেশ উন্নয়নে মধ্য-মেয়াদি নীতিমালা গ্রহণ এবং ব্যবসা-বাণিজ্য সংশ্লিষ্ট সরকারি বিভিন্ন সংস্থাসমূহের কার্যপরিধি সংস্কার করা আবশ্যক বলে মনে করেন ঢাকা চেম্বার সভাপতি। তিনি বলেন, আমরা দেখতে পারছি, দেশের ব্যাংক খাতের কিছু ব্যাংক, যার সংখ্যা ১০ হতে পারে, মন্দ ঋণের সমস্যায় মারাত্মকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত, তবে অন্যান্য ব্যাংকসমূহের অবস্থা বেশ ভলো। মন্দ ঋণে ক্ষতিগ্রস্ত ব্যাংকসমূহের আমানতকারী এবং ঋণগ্রহীতারা যেন অপেক্ষাকৃত ভালো ব্যাংকে ব্যবসায়িক কার্যক্রম পরিচালনার সুযোগ পান, তা নিশ্চিতকরণে ব্যাংক খাতে কার্যকর স্থিতিশীলতা অপরিহার্য বলে তিনি অভিমত জ্ঞাপন করেন।

আশরাফ আহমেদ উলেস্নখ করেন, উচ্চ সুদ হার, উচ্চ বিনিময় হার, ব্যবসায়িক মূলধনের খরচ বৃদ্ধির কারণে সিএমএসএমই খাতে প্রকৃত ঋণপ্রবাহের কার্যকর হার সংকুচিত করছে, এরপরও দেশের অর্থনীতির সার্বিক উন্নয়নে বিশেষ করে সিএমএসএমই খাতে ঋণপ্রবাহ বাড়ানোর কোনো বিকল্প নেই বলে তিনি অভিমত জ্ঞাপন করেন। ডিসিসিআই সভাপতি মূল্যস্ফীতি সহনীয় হলে সংকোচনমুখী মুদ্রানীতি নমনীয় করার প্রস্তাব করেন। তিনি বলেন, কর আহরণের হার বৃদ্ধি পেলে সরকারের গৃহীত ঋণের সুদ পরিশোধের সক্ষমতাও বাড়াবে। ঢাকা চেম্বার সভাপতি উলেস্নখ করেন, মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণে স্থানীয় সাপস্নাইচেইন ব্যবস্থার উন্নয়ন, পণ্যের পচন হ্রাসে স্টোরেজ ক্যাপাসিটি বাড়ানো, লজিস্টিক ব্যবস্থাপনার আধুনিকায়ন এবং আধুনিক বাজার ব্যবস্থাপনা নিশ্চিতকরণের জোরারোপ করেন। বেসরকারি খাতে ঋণপ্রবাহ কমা প্রসঙ্গে তিনি বলেন, আস্থার পরিবেশের উন্নয়নে হলে দেশে স্থানীয় ও আন্তর্জাতিক বিনিয়োগ সম্প্রসারণ হবে। এ ছাড়াও নিরবচ্ছিন্নভাবে পণ্য উৎপাদনের মাধ্যমে রপ্তানি অব্যাহত রাখার পরামর্শ প্রদান করেন ডিসিসিআই সভাপতি, যার মাধ্যমে বৈদেশিক মুদ্রার আহরণ বৃদ্ধি পাবে। সেই সঙ্গে তৈরি পোশাকের পর ইলেকট্রনিকস এবং সেমিকন্ডাক্টর খাত অত্যন্ত সম্ভাবনাময় বলে তিনি অভিমত জ্ঞাপন করেন।

বিশিষ্ট অর্থনীতিবিদ ও বাংলাদেশ ইন্সটিটিউট অব ডেভেলপমেন্ট স্টাডিজের (বিআইডিএস) সাবেক মহাপরিচালক ড. খান আহমেদ সৈয়দ মুরশিদ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ডেভেপলমেন্ট স্টাডিজ বিভাগের অধ্যাপক ওর্ যাপিড'র নির্বাহী পরিচালক ড. আবু ইউসুফ এবং বাংলাদেশ ব্যাংকের পরিচালক (গবেষণা) ড. মো. সেলিম আল মামুন উক্ত সেমিনারের নির্ধারিত আলোচনায় অংশগ্রহণ করেন।

ড. খান আহমেদ সৈয়দ মুরশিদ বলেন, আমাদের অর্থনৈতিক বহির্ভূত অনেক চ্যালেঞ্জ রয়েছে, তাই স্বচ্ছতা ও জবাবদিহিতা বাড়ানোর মাধ্যমে বেসরকারি খাতের আস্থা বৃদ্ধি করতে হবে। তিনি বলেন, আমাদের শুধুমাত্র জিডিপি প্রবৃদ্ধি বাড়ানোর ওপর নজর দিলেই হবে না, সুশাসন, আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির উন্নয়ন, স্বাস্থ্য ও শিক্ষার ওপর গুরুত্ব দেওয়ার সময় এসেছে। এ ছাড়াও খাদ্য নিরাপত্তা, নিরবচ্ছিন্ন জ্বালানি সরবরাহ নিশ্চিতকরণ এবং দক্ষ মানবসম্পদ তৈরিতে শিক্ষা কার্যক্রমের সংস্কারের ওপর তিনি জোরারোপ করেন। বিশেষ করে শিল্প-কারখানায় নিরবচিছন্ন জ্বালানি সরবরাহ নিশ্চিতকল্পে জ্বালানি মূল্য নির্ধারণে নীতিমালা প্রণয়ন ও বাস্তবায়নের প্রতি তিনি আহ্বান জানান।

ড. আবু ইউসুফ বলেন, কার্যকর নীতিমালা প্রণয়নে খাতভিত্তিক পরিসংখ্যানের কোনো বিকল্প নেই, যেখানে আমাদের ঘাটতি রয়েছে এবং সময় এসেছে বিশেষ করে অর্থনীতিভিত্তিক পরিসংখ্যানগুলোর স্বচ্ছতা ও জবাবদিহিতা নিশ্চিতকরণের। তিনি উলেস্নখ করেন, চামড়া শিল্পে শুধুমাত্র কমপস্নায়েন্স নিশ্চিত করা সম্ভব হলে, এই খাত থেকে ১০ বিলিয়ন মার্কিন ডলারের রপ্তানি সম্ভব। তিনি আরও বলেন, সাম্প্রতিক সময় আমরা লক্ষ্য করছি, শুল্ক হ্রাস করা হলেও বাজারে পণ্যের মূল্য হ্রাসে তেমন প্রভাব পড়ছে না, এ ক্ষেত্রে মুদ্রানীতি, বাজেট এবং বাজার ব্যবস্থাপনার মধ্যকার সমন্বয় বাড়ানোর ওপর গুরুত্বারোপ করেন। এ ছাড়াও দেশের তরুণ জনগোষ্ঠীর দক্ষতা বৃদ্ধির ওপর তিনি জোরারোপ করেন। সেই সঙ্গে সামষ্টিক অর্থনৈতিক স্থিতিশীলতা ধরে রাখাই অর্থনীতির জন্য এখন গুরুত্বপূর্ণ বলে তিনি মত প্রকাশ করেন।

ড. মো. সেলিম আল মামুন বলেন, মুদ্রানীতি বিনিময় হার ও পণ্যের সাপস্নাইচেইনে অস্থিতিশীলতা এবং সাম্প্রতিক সময় দেশের বিভিন্ন স্থানে অপ্রতাশিত বন্যা আমাদের জিডিপি প্রবৃদ্ধিতে ভূমিকা রাখবে। তিনি বলেন, চলমান সংস্কার কার্যক্রমের একটি অন্যতম অনুষঙ্গ হলো- আর্থিক খাতের সংস্কার বাস্তবায়ন, যেখানে এতে বেসরকারি খাতের অংশগ্রহণ নিশ্চিত করতে হবে। তিনি আরও বলেন, দেশের নিম্নআয়ের মানুষকে মূল্যস্ফীতির প্রভাব থেকে রেহাই দিতে কেন্দ্রীয় ব্যাংক সংকোচনমুখী মুদ্রানীতি অনুসরণ করছে, মূল্যস্ফীতি কিছুটা নিয়ন্ত্রণে এলে আবার টাকার প্রবাহ বাড়বে এবং বেসরকারি খাত সুফল পাবে, স্বল্প সময়ের জন্য বেসরকারি খাতকে ধৈর্য ধারণের আহ্বান জানান।

ঢাকা চেম্বারে ঊর্ধ্বতন সহ-সভাপতি মালিক তালহা ইসমাইল বারী, পরিচলনা পর্ষদের সদস্যরাসহ সরকারি-বেসরকারি খাতের আমন্ত্রিত অতিথিরা এ সময় উপস্থিত ছিলেন।

  • সর্বশেষ
  • জনপ্রিয়

উপরে