শ্রমিক অসন্তোষের পেছনে যেমন ষড়যন্ত্র আছে, তেমনি তাদের কিছু ন্যায্য দাবিও আছে। তবে যারা উসকানি দিচ্ছে তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেয়া হচ্ছে বলে জানিয়েছেন শ্রম ও কর্মসংস্থান মন্ত্রণালয়ের উপদেষ্টা আসিফ মাহমুদ সজীব ভূঁইয়া। একই সঙ্গে দেশে চলমান শ্রমিক অসন্তোষের জেরে ১৫-২০ শতাংশ ক্রয়াদেশ বাতিল হয়েছে বলেও জানান তিনি। গতকাল অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূসের নেতৃত্বে উপদেষ্টা পরিষদের (কেবিনেট) বৈঠক শেষে ফরেন সার্ভিস একাডেমিতে ব্রিফিংকালে এসব কথা বলেন শ্রম উপদেষ্টা।
শ্রমিক অসন্তোষের পেছনে ষড়যন্ত্রের কথা তুলে ধরে আসিফ মাহমুদ বলেন, 'আমরা এরই মধ্যে কিছু রিপোর্ট পেয়েছি যেটা ওইদিকেই (ষড়যন্ত্র) ইঙ্গিত করে। রেজাল্টটা যদি আপনারা দেখেন এ সেপ্টেম্বর ও অক্টোবরে, আসলে এটা তো সিজনাল বিজনেস, তিন মাস আগে আমাদের মালিক পক্ষকে প্রস্তুত করতে হয়, তিন মাস পর যে অর্ডারটা মার্কেটে যাবে, সেটাকে প্রস্তুত করতে হয়। সে অর্ডারগুলো কিন্তু অনেক জায়গায় বাতিল হয়ে যাচ্ছে। ১৫-২০ শতাংশ অর্ডার বাতিল হয়েছে। আমরা দেখতে পাচ্ছি কিছু নির্দিষ্ট দেশের বায়াররা এসে এ অর্ডারগুলো নেয়ার জন্য লবিং করছেন। আমাদের শ্রম ও কর্মসংস্থান মন্ত্রণালয়ের যিনি নতুন সচিব তিনি এ কথা বলেছেন। আসলে রেজাল্ট দেখে লক্ষণটা বোঝা যায়। আমরা আশা করি খুব দ্রম্নত সময়ের মধ্যে আর্নেস্ট আছে এটা নিয়ন্ত্রণে আসবে।'
শ্রম ও কর্মসংস্থান মন্ত্রণালয়ের উপদেষ্টা বলেন, 'শ্রম আইন নিয়ে যারা কাজ করছেন তাদের নিয়ে একটি কমিটি করা হয়েছে। তাদের মাধ্যমে শ্রমিকদের অভিযোগ শুনে শ্রম অসন্তোষ নিরসন করা হবে। শ্রমিক অসন্তোষের পেছনে যারা ষড়যন্ত্র করছে তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেয়া হচ্ছে। এদিকে শ্রমসংক্রান্ত সব ধরনের অভিযোগ জানাতে ১৬৩৫৭ নম্বরে কল দেয়ার আহ্বান জানিয়েছে শ্রম ও কর্মসংস্থান মন্ত্রণালয়। টোল ফ্রি এ নম্বরে কল করে শ্রমিকরা অভিযোগ দায়ের করতে পারবেন।'
তিনি বলেন, '১১ সেপ্টেম্বর তৈরি পোশাক খাত (আরএমজি) এবং নন-আরএমজি খাতের শ্রম অসন্তোষ পর্যালোচনায় শ্রমসংক্রান্ত অভিযোগ পর্যবেক্ষণ কমিটি গঠন করা হয়। আপাতত শ্রমিকরা যে সমস্যাগুলোর সম্মুখীন হচ্ছেন এবং তাদের দাবিগুলো যাতে নির্দিষ্ট কর্তৃপক্ষের কাছে পেশ করতে পারেন, সে লক্ষ্যে একটি কমিটি করা হয়েছে। এতে শ্রম অনুবিভাগের অতিরিক্ত সচিবকে আহ্বায়ক এবং শ্রম অধিদপ্তরের ট্রেড ইউনিয়ন ও সালিশির পরিচালককে সদস্য সচিব করে এ কমিটি করা হয়েছে। এতে তিন শ্রমিক নেতা, সুপ্রিম কোর্টের দুই আইনজীবী এবং মালিক পক্ষের দুজন সদস্য আছেন।'
আসিফ মাহমুদ বলেন, 'আসলে কোনো শ্রমিক তার ফ্যাক্টরিতে হামলা করবে না কখনো। তাহলে মাস শেষে সে বেতনটা পাবে না। ফ্যাক্টরি বন্ধ হয়ে গেলে সবচেয়ে বেশি ক্ষতি হয় শ্রমিকের। আর মালিক তো বিত্তশালী। কোনো শ্রমিক এখনো ফ্যাক্টরিতে হামলা করেনি, এ ধরনের কোনো ঘটনা আমরা পাইনি। আমরা দেখেছি বেকার যুবসংঘের নামে যারা বিভিন্ন ফ্যাক্টরিতে হামলা করেছে অনেক ফ্যাক্টরিতে শ্রমিকরা বেরিয়ে এসে প্রতিহত করেছে। আপনারা দেখেছেন বেকার যুবসংঘের একজনকে নেত্রকোনা থেকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে। দেখা গেল তিনি ছাত্রলীগের পোস্টেড নেতা ছিলেন।'
অন্তর্বর্তী সরকার দায়িত্ব নেয়ার পর দেশের বিভিন্ন ক্ষেত্রে যে বঞ্চনা ও দাবি দাওয়া নিয়ে অস্থিরতা সৃষ্টি হয়, এবার তা ছড়িয়েছে পোশাক শিল্পেও। সেপ্টেম্বরের শুরু থেকে শ্রমিক অসন্তোষ-বিক্ষোভের জেরে একের পর এক বন্ধ হচ্ছে কারখানা। প্রতিদিনই বাড়ছে তার সংখ্যা। বেতন ও হাজিরা বোনাস বৃদ্ধি, শ্রমিক ছাঁটাই বন্ধ, টিফিন বিল বৃদ্ধি এবং সমানুপাতিক হারে পুরুষ শ্রমিক নিয়োগসহ বিভিন্ন দাবিতে শ্রমিক বিক্ষোভের জেরে এসব কারখানা কর্তৃপক্ষ বন্ধ ঘোষণা করেছে বলে জানায় শিল্পাঞ্চল পুলিশ।
সংশ্লিষ্টদের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, যেসব কারখানা থেকে শ্রমিক অসন্তোষ ছড়াচ্ছে, তার বেশির ভাগের মালিকানায় আছেন আওয়ামী লীগ ঘনিষ্ঠ বা সংশ্লিষ্টরা, যাদের অনেকের নামেই এরই মধ্যে মামলা হয়েছে, কিংবা তারা গা ঢাকা দিয়েছেন। রাজনৈতিক ও ব্যক্তিগত উদ্দেশ্য পূরণে শ্রমিকদের মধ্যে অসন্তোষ পরিকল্পিতভাবে উসকে দিতে কোনো কোনো মালিক তৎপর বলে অভিযোগ তুলেছেন শ্রমিক নেতারা।
শ্রমিক নেতারা বলছেন, ৮ সেপ্টেম্বর বৈঠকের পর গার্মেন্টসের সমস্যাগুলো কমে এসেছে। এর পরিপ্রেক্ষিতে ৯ সেপ্টেম্বর তিন পক্ষের সভা হয়। সেখান থেকে মালিকদের সঙ্গে একটা বোঝাপড়াও হয়। কিন্তু পরের দিন যখন কারখানায় শ্রমিকরা ফিরে যান, তখন আমরা দেখেছি কোনো কারণ ছাড়াই কারখানা ছুটি ঘোষণা করে দিতে। শ্রমিকরা নিজ নিজ কারখানা থেকে আগের দিনের আলোচনা অনুযায়ী কী তারা পাবেন, যেই জানতে চাচ্ছেন তখনই কারখানা সাধারণ ছুটি ঘোষণা করা হচ্ছে। একটি কারখানায় ২০-৩০ হাজার শ্রমিক কাজ করেন। একটি বন্ধ করলে তখন স্বাভাবিকভাবে বাকিগুলোয় প্রভাব পড়ে।