তারল্য সংকটে ভুগতে থাকা ইসলামী ব্যাংক রাষ্ট্রায়ত্ত সোনালী ব্যাংকের কাছে ১ হাজার ১০০ কোটি টাকা ধার চেয়েছে; যেটির জামিনদার হয়ে বাংলাদেশ ব্যাংক অনুমোদন দিলেই টাকা পাবে শরিয়াহভিত্তিক ব্যাংকটি।
সোনালী ব্যাংকের শীর্ষ কর্মকর্তারা বলছেন, এক সময় উদ্বৃত্ত তারল্য নিয়ে বসে থাকা ইসলামী ব্যাংককে এই সুবিধা দিতে পারবে তারা। তবে এখনো কোনো সিদ্ধান্ত হয়নি।
মঙ্গলবার কেন্দ্রীয় ব্যাংককে গ্যারান্টর (জামিনদার) হওয়ার অনুরোধ করে চিঠিও দিয়েছে ইসলামী ব্যাংক। তবে বুধবার পর্যন্ত বাংলাদেশ ব্যাংক এ বিষয়ে সবুজ সংকেত দেয়নি। ক্ষমতাচু্যত আওয়ামী লীগের সময় জোরজবরদস্তি করে ব্যাংকের নিয়ন্ত্রণ নেওয়া এস আলম নানা অনিয়মের মাধ্যমে বিপুল পরিমাণ টাকা বের করে নিলে দেশের অন্যতম বৃহৎ ইসলামী ব্যাংক তারল্য সংকটে জেরবার হয়ে পড়ে। সরকার পতনের পর তা আরও তীব্র হয়।
এস আলম গ্রম্নপের অধীনে যাওয়ার পর হাজার হাজার কোটি টাকা মন্দ ঋণের কবলেও পড়ে ব্যাংকটি।
প্রবল গণআন্দোলনের মুখে শেখ হাসিনা সরকারের পতনের পর অন্তর্র্বর্তী সরকার ক্ষমতায় এসে ব্যাংক খাত পুনর্গঠনে উদ্যোগ নেয়। এরই মধ্যে ইসলামী ব্যাংকের পর্ষদ পুনর্গঠন করা হয়েছে।
অপরদিকে তারল্য সংকটে ধুঁকতে থাকা ব্যাংকগুলোর পাশে দাঁড়ানোর ঘোষণা দিয়েছে বাংলাদেশ ব্যাংকের নতুন গভর্নর আহসান এইচ মনসুর। তবে সরাসরি সহায়তা না দিয়ে আন্তঃব্যাংক ব্যবস্থা থেকে ধার দিয়ে সংকট উত্তরণের একটি পন্থা বাতলে দিয়েছেন তিনি।
গভর্নরের দেখিয়ে দেওয়া সেই উপায় অবলম্বন করে সোনালী ব্যাংকের কাছে তারল্য সহায়তা চেয়েছে ইসলামী ব্যাংক। এ জন্য বাংলাদেশ ব্যাংকের মধ্যস্থতাও চেয়েছে ব্যাংকটি।
ব্যাংকটির এ আবেদনের প্রক্রিয়ায় আরেকটি বিষয় সামনে চলে এসেছে। দেখা গেছে, গত বছর ২৬ ডিসেম্বর সোনালী ব্যাংকের কাছে ১৪ দিনের জন্য এক হাজার কোটি টাকা ঋণ নেয় ইসলামী ব্যাংক।
'কল অ্যান্ড শর্ট নোটিশ ডিপোজিট' নামে পরিচিত তারল্য সহায়তার আওতায় ইসলাম ব্যাংক এই অর্থ গ্রহণ করে, যার মধ্যে সোনালী ব্যাংক তাদের অভ্যন্তরীণ ঋণসীমার বাইরে গিয়ে ৬২১ কোটি টাকা সরবরাহ করে এবং সে সময় তারা কেন্দ্রীয় ব্যাংককেও বিষয়টি অবহিত করেছিল।
সেই অর্থ এখনো পরিশোধ করতে পারেনি ইসলামী ব্যাংক। এমন অবস্থায় বাংলাদেশ ব্যাংককে গ্যারান্টর করে সোনালী ব্যাংকের কাছ থেকে আবার বড় অঙ্কের নগদ টাকার সহায়তা চেয়ে চিঠি দিল ইসলামী ব্যাংক।
নতুন সহায়তার আবেদনের বিষয়ে বাংলাদেশ ব্যাংকের একজন ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা বলেন, সোনালী ব্যাংক এরই মধ্যে মৌখিকভাবে টাকা দিতে চেয়েছে। বাংলাদেশ ব্যাংকের অনুমোদনের পেলেই ইসলামী ব্যাংককে তারা তারল্য সহায়তা দিতে পারবে।
এ বিষয়ে বুধবার সোনালী ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালক আফজাল করিমের সঙ্গে যোগাযোগ করা হলে তিনি বলেন, "ইসলামী ব্যাংক আগে যে ১ হাজার কোটি টাকা নিয়েছিল সেটার সুদ দিচ্ছে, আর কিছু প্রিন্সিপাল পরিশোধ করছে। তাতে ওই ঋণটা কমিয়ে আনা হচ্ছে।"
জানতে চাওয়া হয় ইসলামী ব্যাংক সম্প্রতি সোনালী ব্যাংকের কাছে ১ হাজার ১০০ কোটি টাকা চেয়েছে, এটি এখন কোন পদ্ধতি অনুসরণ করে দেওয়া হবে। জবাবে আফজাল করিম বলেন, "সেই বিষয়ে এখনো কোনো সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়নি। আর বাংলাদেশ ব্যাংক তো বলেছে, বাংলাদেশ ব্যাংক গ্যারান্টি দেবে। সেটা ভিন্ন ইসু্য। ইসলামী ব্যাংক আমাদের চিঠি দিয়েছে, তবে এ বিষয়ে আমরা এখনো সিদ্ধান্ত নেইনি।"
গত ৫ অগাস্ট ক্ষমতার পালাবদলের পর ব্যাংকিং খাত পরিবর্তনের ভেতর দিয়ে যাচ্ছে। ইতোমধ্যে ইসলামী ব্যাংকসহ ১১টি ব্যাংকের পরিচালনা পর্ষদ পুনর্গঠন করা হয়েছে।
২০১৭ সালে ইসলামী ব্যাংকের নিয়ন্ত্রণ নেয় ব্যবসায়ী গোষ্ঠী এস আলম গ্রম্নপ। ব্যাংকটির মালিকানা নেওয়ার পর থেকে নামে-বেনামে অন্তত ৫০ হাজার কোটি টাকা বের করে নিয়েছে এই ব্যবসায়ী গ্রম্নপ। ব্যাংকটি থেকে ঋণ দেওয়া হলেও সেই অর্থ আর ব্যাংকের ফেরত আসেনি। তাতে আর্থিক সংকটে পড়ে যায় ব্যাংকটি।
ইসলামী ব্যাংক দীর্ঘদিন ধরে বাংলাদেশ ব্যাংকের সিআরআর ও এসএলআর রাখতে ব্যর্থ হচ্ছে। পাশাপাশি ব্যাংকটির বাংলাদেশ ব্যাংকের সঙ্গে চলতি হিসাবেও ঘাটতি তৈরি হয়েছিল। ঋণাত্মক হলেও লেনদেন অব্যাহত রাখার সুযোগ দিয়েছিলেন সাবেক গভর্নর আব্দুর রউফ তালুকদার। টাকা ছাপিয়ে দেওয়া সেই বিশেষ সুবিধা এখন বন্ধ করে দিয়েছে বাংলাদেশ ব্যাংক। তাই ব্যাংকটি এখন তারল্য সংকটে বাংলাদেশ ব্যাংক ও বিভিন্ন ব্যাংকের কাছে ধার চাচ্ছে।
বাংলাদেশ ব্যাংকে পাঠানো চিঠিতে বলা হয়, ইসলামী ব্যাংক বাংলাদেশ প্রথম প্রজন্মের শরিয়াভিত্তিক বেসরকারি বাণিজ্যিক ব্যাংক। সারা দেশে ব্যাংকটির বর্তমানে ৩৯৫টি ব্রাঞ্চ, ২৫২টি সাব-ব্রাঞ্চ এবং দুই হাজার ৭৮৭টি এজেন্ট আউটলেট রয়েছে।
সম্প্রতি উচ্চ মূল্যস্ফীতি, ক্রমবর্ধমান জীবনযাত্রার ব্যয় এবং দেশের সামগ্রিক সামষ্টিক অর্থনৈতিক পরিস্থিতির কারণে ব্যাংক খাত থেকে আমানত তোলার চাহিদা বেড়েছে। এমন পরিস্থিতিতে ব্যাংকের ওপর তারল্যের চাপ সৃষ্টি হয়েছে। তাই সামষ্টিক অর্থনৈতিক স্থিতিশীলতা নিশ্চিত করতে তিন মাসের জন্য আন্তঃব্যাংক থেকে তারল্য সহায়তা পেতে ব্যাংকের পক্ষ থেকে সোনালী ব্যাংকের অনুকূলে এক হাজার ১০০ কোটি টাকার একটি ব্যাংক গ্যারান্টি ইসু্য করার অনুরোধ করা হয়েছে।
এই চিঠিতে ইসলামী ব্যাংক বাংলাদেশের ব্যবস্থাপনা পরিচালক মুহাম্মদ মুনিরুল মওলার স্বাক্ষর রয়েছে।
কেন্দ্রীয় ব্যাংকের কর্মকর্তারা বলছেন, শুধু ইসলামী ব্যাংক নয়, তারল্য সুবিধার জন্য অনেকগুলো ব্যাংকই আবেদন করেছে। তবে আন্তঃব্যাংক পদ্ধতিতে গ্যারান্টি চেয়ে কেবল ইসলামী ব্যাংক বাংলাদেশ চিঠি দিয়েছে। অবশ্য এখনো কোনো সিদ্ধান্ত হয়নি।
সংকটে পড়া ব্যাংকগুলো কীভাবে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের গ্যারান্টি নিয়ে আন্তঃব্যাংক মার্কেট থেকে ধার নেবে, সে বিষয়ে একটি খসড়া তৈরি হয়েছে।
এ বিষয়ে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের একজন কর্মকর্তা বলেন, যে ব্যাংক ধার নেবে তার কাউন্টার পার্টি ব্যাংক থেকে আগে মৌখিক সম্মতি নিতে হবে। ধার নেওয়া ব্যাংকের বোর্ডে বিষয়টি তুলে অনুমোদন করাতে হবে। এরপর বাংলাদেশ ব্যাংকে আবেদন করতে হবে।
তারা বলছেন, এ ক্ষেত্রে কত টাকা নেবে, তা কীভাবে পরিশোধ করবে; সুদহার কত হবে, তার একটি পরিকল্পনা দিতে হবে ধার চাওয়া ব্যাংককে। তিন মাসে ধার শোধ করতে না পারলে ব্যাংকটি আরও ৯ মাস সময় পাবে। বাংলাদেশ ব্যাংক গ্যারান্টি দেওয়ার ক্ষেত্রে একটি কমিশনও পাবে।