অস্বাভাবিক উৎপাদন ব্যয় কমছে না পোল্ট্রি পণ্যের দাম

ডিম ও মুরগির উৎপাদন ব্যয় ভারতের থেকে দ্বিগুণ বেশি, ৩৫ টাকায় উৎপাদিত ফিড বিক্রি হয় ৭২ টাকায় কর্পোরেট ফিড উৎপাদনকারীদের হাতে জিম্মি সাধারণ খামারিরা

প্রকাশ | ০৪ সেপ্টেম্বর ২০২৪, ০০:০০

রেজা মাহমুদ
দীর্ঘদিন ধরেই দেশের পোল্ট্রি পণ্যের বাজারে অস্থিরতা চলছে। সর্বশেষ বন্যার প্রভাবে বাজার আরও অনিয়ন্ত্রতিত হয়ে পড়েছে। এ অবস্থায় দর সহনীয় রাখতে শুল্কমুক্ত ডিম আমদানি করার কথা ভাবছে সরকার। কিন্তু এতে দেশীয় উৎপাদকরা নতুর করে ক্ষতিগ্রস্ত হবেন বলে মনে করছেন সংশ্লিষ্টরা। তাদের মতে উৎপাদন খরচ না কমিয়ে বাজার সহনীয় রাখা অসম্ভব। অন্যদিকে শুল্কমুক্ত আমদানি প্রান্তিক খামারিদের আরও বড় বিপদের মধ্যে ফেলবে। এ অবস্থায় অস্বাভাবিক উৎপাদন ব্যয় কামানোর তাগিদ দিয়েছেন খামারিরা। ডিম ও মুরগির উৎপাদকরা বলছেন, বর্তমান বাজারে একটি ডিমের উৎপাদন খরচ ১০ টাকা ৩০ পয়সা। ফলে খুচরা বাজারে ১২ টাকা বিক্রি না হলে লোকসান গুনতে হয় খামারিদের। যেহেতু চাহিদার থেকেও বেশি ডিম দেশেই উৎপাদন হয় তাই আমদানি করা হলে নেতিবাচক প্রভাব পড়বে খামারিদের ওপর। তবে ডিম ও মুরগির উৎপাদন খরচ কমানো গেলে দাম সহনীয় হতে পারে। খামারিরা জানিয়েছেন, ভারতে প্রতি পিস ডিমের উৎপাদন ব্যয় ৫ টাকা এবং বিক্রয়যোগ্য মুরগির উৎপাদন ব্যয় প্রতিকেজি ৭৬-৮৬ টাকা। যা বাংলাদেশে ১৬০-১৭৫ টাকা। অর্থাৎ ভারতের থেকে দ্বিগুণেরও বেশি খরচ হয় দেশীয় খামারিদের। এ অবস্থায় বাজার সহনীয় রাখতে উৎপাদন ব্যয় কমানোর কোনো বিকল্প নেই। সেক্ষেত্রে পোল্ট্রি ফিডের দাম কমানো গেলে বাজারে ২০ শতাংশ পর্যন্ত ডিম ও মুরগির দাম কমতে পারে। খামারিরা বলছেন, পোল্ট্রি ফিডের বাজার শতভাগ নিয়ন্ত্রণ করে কর্পোরেট খামারিরা। তারা ডলারের দাম বৃদ্ধি ও আন্তর্জাতিক বাজারে ফিডের কাঁচামালের দাম বৃদ্ধির কারণ দেখিয়ে অস্বাভাবিক হারের ফিডের দাম বাড়িয়ে চলছে যার প্রভাব পড়ছে খামারিদের উৎপাদনে। অথচ বিগত ২ বছরের সব ধরনের ফিডের দাম আন্তর্জাতিক বাজারে কমতির দিকে রয়েছে। কিন্তু দেশের বাজারে ক্রমাগত বাড়ানো হচ্ছে। বাংলাদেশ পোল্ট্রি অ্যাসোসিয়েশনের তথ্যমতে, দেশের বর্তমান ফিডের দাম স্বাভাবিকের থেকে প্রতি কেজিতে ১৫ থেকে ২০ টাকা পর্যন্ত বাড়তি নেওয়া হয়। এ ছাড়া ফিডের কাঁচামাল ৬০-৭০ শতাংশ দেশেই উৎপাদিত হয়। কিন্তু কর্পোরেট প্রতিষ্ঠানগুলোর দাবি তারা শতভাগ কাঁচামাল আমদানি করে। এই সিন্ডিকেট না ভাঙতে পারলে উৎপাদন খরচ কমানো অসম্ভব। এমনকি বাংলাদেশ ট্যারিফ কমিশনের বাজার বিশ্লেষণেও ফিডের উৎপাদন ব্যয় ও খামারিদের কাছে বিক্রয় ব্যয়ের মধ্যে অস্বাভাবিক দামের পার্থক্য পাওয়া যায়। কিন্তু গত সরকারের আমলে কর্পোরেট সিন্ডিকেট সরকারের বিভিন্ন কর্তাদের ম্যানেজ করে বাড়তি দামেই ফিড বিক্রি করে বলেও অভিযোগ রয়েছে। বর্তমানে বাজারে প্রতিকেজি ব্রয়লার ও লেয়ার ফিড বিক্রি হচ্ছে ৭২ টাকা দরে। এসব ফিড প্রায় ২৩ ধরনের উপাদান দিয়ে তৈরি। যার মধ্যে প্রধান দুটি উপাদান ভুট্টা ও সয়াবিন। এই দুই পণ্যের দাম আন্তর্জাতিক বাজারে ৩০ শতাংশ পর্যন্ত কমেছে কিন্তু দেশের ফিডের বাজারে তার প্রভাব নেই। ফিড উৎপাদনকারী প্রতিষ্ঠানগুলোর তথ্যমতে প্রতি কেজি ব্রয়লার ফিডের উৎপাদন ব্যয় ৫৫ টাকা ৭৩ পয়সা এবং বিক্রি করছেন ৭২ টাকা দরে। তবে খামারিরা বলছেন প্রতিকেজি ব্রয়লার ফিডের সর্বোচ্চ উৎপাদন ব্যয় ৪৫ টাকা এবং লেয়ার ফিডের উৎপাদন ব্যয় ৩৫ টাকার আশপাশে। যদি বাজার নিয়ন্ত্রণ করতে হয় তাহলে ফিডের প্রকৃত উৎপাদন ব্যয় যাচাই করে সে অনুযায়ী খুচরা মূল্য নির্ধারণ প্রয়োজন। তা করা গেলেই ডিম ও মুরগির উৎপাদন ব্যয় ২০ শতাংশ কমে আসবে যার প্রভাব পড়বে ভোক্তা পর্যায়ে। এ বিষয়ে জানতে চাইলে বিপিএ সভাপতি সুমন হাওলাদার বলেন, খামারিরা মুরগির ফিডের ক্ষেত্রে বরাবরই কর্পোরেট প্রতিষ্ঠানের ওপর নির্ভরশীল। কারণ তারাই একমাত্র ফিডের কাঁচামাল আমদানিকারক। বর্তমান অন্তর্বর্তী সরকারের কাছে খামারিদের পক্ষ থেকে ফিডের যৌক্তিক দাম নির্ধারণের দাবি জানাচ্ছি। যেখানে ভারত ৫ টাকায় একটি ডিম উৎপাদন করে সেখানে আমাদের কেন ১০ টাকা ৩০ পয়সা লাগবে। একইভাবে একটি মুরগি উৎপাদনে কেন ৩গুণ বেশি ব্যয় হবে। এসব বিষয় সমাধান করা গেলে আমাদের ডিম আমদানির প্রয়োজন পড়বে না। কিন্তু তা না করে আমদানি করা হলে খামারিরা উৎপাদন বন্ধ করে দিতে বাধ্য হবেন। যা দীর্ঘমেয়াদে বাজার অস্থিতিশীল করে তুলবে এবং বাজার আমদানিনির্ভর করে তুলবে।