বাড়ছে চামড়া উৎপাদন সে তুলনায় কমছে রপ্তানি
চলতি অর্থবছরের ১১ মাসে চামড়া রপ্তানি হয়েছে ৯৬ কোটি ডলার, যা আগের অর্থবছরের একই সময়ের তুলনায় ১৪ দশমিক ১৭ শতাংশ কম। অথচ ২০১৭-১৮ অর্থবছরে ১২৩ কোটি ডলারের চামড়া ও চামড়াজাত পণ্য রপ্তানি করা হয়। রপ্তানি কমে যাওয়ায় রপ্তানিকারকদের কাছে চাহিদা হারাচ্ছে চামড়া।
প্রকাশ | ২১ জুন ২০২৪, ০০:০০
এম সাইফুল
প্রতিবছরই বাড়ছে চামড়া উৎপাদন। বিশেষ করে কোরবানির মৌসুমে সবচেয়ে বেশি চামড়া সংগৃহিত হয়। সেই তুলনায় বাড়ছে না রপ্তানি। আর প্রতিবছর এ সুযোগ নেয় চামড়া সিন্ডিকেট। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, চামড়া শিল্পের রপ্তানি সম্ভাবনা অনেক বেশি। কিন্তু সে তুলনায় এ খাতে উন্নয়ন হচ্ছে না।
রপ্তানি উন্নয়ন বু্যরোর (ইপিবি) তথ্য মতে, চলতি অর্থবছরের ১১ মাসে চামড়া রপ্তানি হয়েছে ৯৬ কোটি ডলার, যা আগের অর্থবছরের একই সময়ের তুলনায় ১৪ দশমিক ১৭ শতাংশ কম। অথচ ২০১৭-১৮ অর্থবছরে ১২৩ কোটি ডলারের চামড়া ও চামড়াজাত পণ্য রপ্তানি করা হয়। রপ্তানি কমে যাওয়ায় রপ্তানিকারকদের কাছে চাহিদা হারাচ্ছে চামড়া।
ফলে এবারের ঈদে সরকার নির্ধারিত দরের চেয়ে চামড়া আড়াইশ' থেকে তিনশ' টাকা কমে বিক্রি হয়েছে। বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের বেঁধে দেওয়া দর অনুযায়ী মাঝারি সাইজের গরুর চামড়ার আনুমানিক মূল্য ১ হাজার ৭৫ টাকা থেকে ১ হাজার ২০০ টাকা হওয়ার কথা থাকলেও ঢাকায় আড়াতদাররা তা কিনেছেন সর্বোচ্চ ৮০০ টাকায়। চট্টগ্রাম ও রাজশাহীতে বড় আকারের কাঁচা চামড়া বিক্রি হয়েছে সর্বোচ্চ ৭০০ টাকায়। মাঝারি ও ছোট আকারের গরুর চামড়ার দাম ছিল ৪০০-৬০০ টাকা। আর একেকটি ছাগলের চামড়া বিক্রি হয়েছে সর্বোচ্চ ১০ টাকায়, যা অনেকটা হাস্যকর।
মৎস্য ও প্রাণিসম্পদ মন্ত্রণালয় সূত্রে জানা গেছে, সদ্য বিদায়ী ঈদুল আজহায় গত বছরের চেয়ে বেশি পশু কোরবানি হয়েছে। এবার ৩.৭ শতাংশ বেশি চামড়া উৎপাদন হয়েছে। ঈদুল আজহায় সারাদেশে মোট ১ কোটি ৪ লাখ ৮ হাজার ৯১৮টি গবাদিপশু কোরবানি হয়েছে। সবচেয়ে বেশি কোরবানি হয়েছে ঢাকা বিভাগে, সবচেয়ে কম ময়মনসিংহ বিভাগে।
মৎস্য ও প্রাণিসম্পদ মন্ত্রণালয় থেকে জানানো হয়েছে, এই বছর কোরবানির পশুর সংখ্যা বেশি। গত বছরের তুলনায় এবার ৩ লাখ ৬৭ হাজার ১০৬টি গবাদি পশু বেশি কোরবানি হয়েছে। ২০২৩ সালে দেশে কোরবানি গবাদি পশুর সংখ্যা ছিল ১ কোটি ৪১ হাজার ৮১২টি। ২০২২ সালে এই সংখ্যা ছিল ৯৯ লাখ ৫০ হাজার ৭৬৩টি।
মন্ত্রণালয়ের দেওয়া তথ্য অনুযায়ী, ঢাকা বিভাগে ২৫ লাখ ২৯ হাজার ১৮২টি, চট্টগ্রাম বিভাগে ২০ লাখ ৫৭ হাজার ৫২০টি, রাজশাহী বিভাগে ২৪ লাখ ২৬ হাজার ১১১টি, খুলনা বিভাগে ১০ লাখ ৮ হাজার ৮৫৫টি, বরিশাল বিভাগে ৪ লাখ ২৮ হাজার ৪৩৮টি, সিলেট বিভাগে ৩ লাখ ৯৩ হাজার ৭৪২টি, রংপুর বিভাগে ১১ লাখ ৭২ হাজার ৫৫৩টি ও ময়মনসিংহ বিভাগে ৩ লাখ ৯২ হাজার ৫১৭ টি গবাদিপশু কোরবানি হয়েছে।
কোরবানি হওয়া গবাদিপশুর মধ্যে ৪৭ লাখ ৬৬ হাজার ৮৫৯টি গরু, ১ লাখ ১২ হাজার ৯১৮টি মহিষ, ৫০ লাখ ৫৬ হাজার ৭১৯টি ছাগল, ৪ লাখ ৭১ হাজার ১৪৯টি ভেড়া ও ১ হাজার ২৭৩টি অন্যান্য পশু।
চামড়া খাত সংশ্লিষ্টরা বলছেন, ২০৩০ সাল নাগাদ সাড়ে ১২ বিলিয়ন ডলারের চামড়া ও চামড়াজাত পণ্য রপ্তানির লক্ষ্য সরকারের। যা অর্জনে অন্তত ২০টি বড় ট্যানারির লেদার ওয়ার্কিং গ্রম্নপের (এলডবিস্নউজি) সনদ দরকার।
বিশ্বজুড়ে টেকসই ও পরিবেশসম্মত চামড়া প্রক্রিয়াজাত নিশ্চিতে কাজ করছে এলডবিস্নউজি। দেশের ট্যানারিগুলোর এ সনদ না থাকায় ইউরোপ-আমেরিকার ক্রেতারা পণ্য কিনছে না। সেজন্য অন্য দেশের ক্রেতাদের কাছে কম দামে বিক্রি হচ্ছে চামড়া।
এছাড়া ট্যানারি ব্যবসায়ীরা বলছেন, ২০১৭ সালে সাভারে ট্যানারি স্থানান্তর হলেও অর্থসংকট কাটেনি। সেজন্য কয়েকশ' কোটি টাকা ঋণ দেওয়ার দাবি তাদের।
অন্যদিকে ইউরোজোন থেকে রপ্তানি আদেশ কমায় এই শিল্পের রপ্তানি আয় কমেছে। রপ্তানি আদেশ কমায় চামড়াজাত জুতার নেতিবাচক প্রবৃদ্ধি নিয়ে নতুন অর্থবছর শুরু হচ্ছে। ক্রমাগত রপ্তানি আদেশ কমার বিষয়ে ইউরোজোনের অর্থনৈতিক পরিস্থিতিকে দায়ী করেন সংশ্লিষ্টরা। বিশেষ করে রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের প্রভাবে এই অঞ্চলের অর্থনীতি ঝুঁকিপূর্ণ অবস্থায় রয়েছে। ফলে সেখানকার মানুষ চামড়াজাত জুতার মতো বিলাসবহুল পণ্য কিনতে অনিচ্ছুক হওয়ায় রপ্তানি কমেছে। এছাড়া সাভার ট্যানারি ইন্ডাস্ট্রিয়াল কমপেস্নক্সে সেন্ট্রাল এফ্লুয়েন্ট ট্রিটমেন্ট পস্ন্যান্টে (সিইটিপি) লেদার ওয়ার্কিং গ্রম্নপের সার্টিফিকেট না থাকায় বৈশ্বিক ব্র্যান্ডগুলো স্থানীয় চামড়া নেয় না।
এছাড়া জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের (এনবিআর) হয়রানি ও রপ্তানিবিরোধী নীতিমালা চামড়াজাত জুতা রপ্তানিতে বাধা সৃষ্টি করেছে, ফলে নতুন বিনিয়োগকারীরা আগ্রহ হারাচ্ছে। ব্যাংক ঋণের উচ্চ সুদের হারের কারণে ওভারহেড খরচ বৃদ্ধি পেয়েছে, যা রপ্তানিকে বাধাগ্রস্ত করছে।
সংশ্লিষ্টরা বলছেন, এসব চ্যালেঞ্জ মোকাবিলা করতে পারলে ২০২৬ সালের মধ্যে চামড়াজাত জুতা খাত কমপক্ষে ৫ বিলিয়ন ডলারের পণ্য রপ্তানি করতে সক্ষম হবে এবং কমপক্ষে এক লাখ লোকের কর্মসংস্থানের সুযোগ সৃষ্টি হবে।
বাংলাদেশ ট্যানার্স অ্যাসোসিয়েশনের চেয়ারম্যান শাহীন আহমেদ বলেন, 'এই শিল্পের চ্যালেঞ্জ থেকে উত্তরণের একমাত্র উপায় সরকারের সহযোগিতা। যাতে করে প্রতিটি ট্যানারি কমপস্নাইন্স হতে পারে। যারা গ্রিন টাস্ক কনভেনশন ফান্ড অর্থাৎ সফট লোনের মাধ্যমে কমপস্নাইন্স করার জন্য সহযোগিতা করতে হবে তাহলে এই খাতটা ঘুরে দাঁড়াবে।'
এবার পশু বেচাকেনায় ভর করে কোরবানি ঈদের আগের অর্থনীতির আকার প্রায় ১ লাখ কোটি টাকা। উচ্চ মূল্যস্ফীতির কারণে পোশাক ও সাজসজ্জার পণ্য বিক্রি কমলেও, পশুর হাট ছিল চাঙ্গা। অথচ ঈদের দিন বিকাল থেকে শুরু হয় চামড়া নিয়ে হাহাকার।
দেশের কয়েক লাখ প্রান্তিক কৃষক পশুপালন করেন। গরু-ছাগল পালনে গড়ে উঠেছে ছোট বড় অনেক বাণিজ্যিক খামারও। এ বছর এক কোটি ৭ লাখ চাহিদার বিপরীতে কোরবানিযোগ্য ছিল ১ কোটি ৩০ লাখ পশু। যার মধ্যে গরু ৫২ লাখের বেশি। ১ থেকে দেড় লাখ টাকা দামের গরুর চাহিদা ছিল বেশি। বাজারে বেশিরভাগ ছাগল বিক্রি হয়েছে ১২ থেকে ১৮ হাজার টাকার মধ্যে।
কোরবানি ঈদের পশু কেনাবেচা হয়েছে আনুমানিক ৭৫ হাজার কোটি টাকার। এরসঙ্গে পশু পরিবহণ, খাদ্য, কসাই ও আনুষঙ্গিক খরচ ৫ হাজার কোটি টাকা। কাঁচা চামড়া-লবণ ও শ্রমিকের মজুরি ১ হাজার কোটি টাকা। পেঁয়াজ, রসুন ও মসলার বাজার ৮ হাজার কোটি টাকার। ফ্রিজ-ইলেকট্রনিক্স পণ্য, পোশাক, পর্যটন ও যাতায়াত খরচ ১০ হাজার কোটি।
প্রতি বছরই ঈদের দিন থেকে চামড়া নিয়ে সিন্ডিকেটের দৌরাত্ম্য শুরু হয়। মূলত চামড়া বিক্রির অর্থ বিভিন্ন এতিমখানা ও গরিবদের মাঝে বিতরণ করা হয়। ঈদের আগের মতো যদি চামড়ার বাজার চাঙ্গা থাকতো তাহলে সমাজের দুস্থ মানুষের সঙ্গে এ খাতের ব্যবসায়ীরাও খুশি থাকতে পারতেন।
অর্থনীতিবিদ অধ্যাপক আবু ইউসুফ বলেন, 'ফ্যাক্টরি মালিকরা তাদের মানদন্ড ঠিক করবে এবং সরকার সিইটিপি ও সলিড ওয়েস্ট (কঠিন বর্জ্য) ম্যানেজমেন্ট ঠিক করে দেবে। তাহলে আমাদের এটা যদি কমপস্নায়েন্ট হয় এবং এলডবিস্নউজি সনদ পায় আমরা ঠিকই ২০৩০ সালের মধ্যে সেটা সাড়ে ১২ বিলিয়ন ডলারে নিতে পারব। এটা ২৫০ বিলিয়ন ডলারের একটা মার্কেট। কিন্তু আমরা এখন যেভাবে যাচ্ছি সেভাবে হবে না।'