সমুদ্র থেকে পাইপলাইনে শুরু হচ্ছে জ্বালানি তেল সরবরাহ

প্রকাশ | ২২ ফেব্রুয়ারি ২০২৪, ০০:০০

ইব্রাহিম খলিল, চট্টগ্রাম
কক্সবাজারের কুতুবদিয়ার গভীর সমুদ্র থেকে পাইপলাইনের মাধ্যমে জ্বালানি তেল সরবরাহ শুরু হচ্ছে। আগামী ২৯ ফেব্রম্নয়ারি থেকে এই তেল যাবে পতেঙ্গার ইস্টার্ন রিফাইনারিতে। এই কার্যক্রম শুরু হলে দেশের জ্বালানি তেল পরিবহণে বৈপস্নবিক পরিবর্তন ঘটবে। সাশ্রয় হবে সময় ও অর্থ। বুধবার এমন তথ্য জানিয়েছেন বিপিসির মহাব্যবস্থাপক (পরিকল্পনা ও উন্নয়ন) প্রকৌশলী মো. আমীর মাসুম। তিনি বলেন, ৭ হাজার কোটিরও বেশি টাকা ব্যয়ে গভীর বঙ্গোপসাগরে বাস্তবায়িত ইন্সটলেশন অব সিঙ্গেল পয়েন্ট মুরিং (এসপিএম) উইথ ডাবল পাইপলাইন প্রকল্পের আওতায় জ্বালানি তেল খালাসে কোটি কোটি টাকা সাশ্রয়ের লক্ষ্যে এই কার্যক্রম শুরু হচ্ছে। এর আগে গত বছর ৩ জুলাই পরীক্ষামূলক জ্বালানি তেল সরবরাহ শুরু করা হয়। শুরুতে যান্ত্রিক ত্রম্নটি ধরা পড়ায় তা বন্ধ হয়ে যায়। এখন সবকিছু ঠিকঠাক করে পুনরায় গভীর সাগরে নোঙর করা দুটি জাহাজ থেকে খালাস করা ক্রুড অয়েল ও ডিজেল পতেঙ্গাস্থ ইস্টার্ন রিফাইনারিতে সরবরাহ শুরু করা হবে। আগামী ২৯ ফেব্রম্নয়ারি এই তেল সরবরাহ শুরু হচ্ছে। বিপিসির তথ্যমতে, গভীর সাগরে নোঙর করা মাদার ভ্যাসেল থেকে লাইটারেজ না করে পাইপ লাইনের মাধ্যমে জ্বালানি তেল খালাসের জন্য সরকার প্রায় ৮ হাজার কোটিরও বেশি টাকা ব্যয়ে ইনস্টলেশন অব সিঙ্গেল পয়েন্ট মুরিং উইথ ডাবল পাইপ লাইন শীর্ষক একটি প্রকল্প বাস্তবায়ন করে। কক্সবাজারের কুতুবদিয়ার অদূরে গভীর সমুদ্রে সিঙ্গেল পয়েন্ট মুরিং নির্মাণ করা হয়। ওখান থেকে ইস্টার্ন রিফাইনারি পর্যন্ত অফ শোর এবং অনশোর মিলে মোট ২২০ কিলোমিটার ডাবল পাইপলাইন স্থাপন করা হয়। এর মধ্যে ১৪৬ কিলোমিটার অফশোর পাইপলাইন এবং ৭৪ কিলোমিটার অনশোর পাইপলাইন রয়েছে। পাইপলাইন ছাড়াও প্রকল্পের আওতায় মহেশখালীতে ১ লাখ ২৫ হাজার টন ক্রুড অয়েল এবং প্রায় ৮০ হাজার টন ডিজেল সংরক্ষণের ট্যাংক নির্মাণ করা হয়। বিদেশ থেকে আমদানিকৃত ক্রুড অয়েল এবং ডিজেল ওই দুটি ট্যাংকে সংরক্ষণ করে ওখান থেকে প্রয়োজনানুযায়ী দুটি পাইপলাইনের একটি দিয়ে ক্রুড অয়েল ইস্টার্ন রিফাইনারিতে এবং অপর পাইপলাইন দিয়ে ডিজেল পদ্মা অয়েল কোম্পানি, যমুনা অয়েল কোম্পানি এবং মেঘনা পেট্রোলিয়ামের পতেঙ্গার গুপ্তাখালস্থ প্রধান ডিপোতে পাঠানোর ব্যবস্থা রয়েছে। জার্মানির একটি বিশেষজ্ঞ প্রতিষ্ঠানের তত্ত্বাবধানে চায়না পেট্রোলিয়াম পাইপলাইন অ্যান্ড ইঞ্জিনিয়ারিং নামের কোম্পানি এই প্রকল্পের কাজ করে। ইতোপূর্বে গত বছরের জুলাই মাসে গভীর সাগর থেকে জ্বালানি তেল খালাসের উদ্যোগ নেওয়া হয়। কিন্তু ক্রুড অয়েল খালাস শুরু হলে পাইপ লাইনসহ প্রকল্পে বেশ কিছু ত্রম্নটি ধরা পড়ায় তা সম্ভব হয়নি। পরবর্তীতে ত্রম্নটি সারিয়ে গত ১ ডিসেম্বর সৌদি আরব থেকে আমদানিকৃত ৮২ হাজার টন ক্রুড অয়েলবাহী জাহাজকে বঙ্গোপসাগরে স্থাপিত ভাসমান জেটিতে (এসপিএম বয়া) বার্থিং দেওয়া হয়। জাহাজটি ক্রুড অয়েল খালাস করে চলে যাওয়ার একদিন পরই অপর একটি জাহাজ ৬০ হাজার টন ডিজেল খালাস করে। ক্রুড অয়েল ও ডিজেলগুলো ওখানেই ছিল। পাইপ লাইনের সামান্য জটিলতায় এগুলো ইস্টার্ন রিফাইনারি পর্যন্ত আনা সম্ভব হয়নি। প্রকৌশলী মো. আমীর মাসুম বলেন, ইতোমধ্যে পাইপলাইন প্রকল্পের সব ত্রম্নটি সারিয়ে তোলা হয়েছে। সম্পন্ন হয়েছে পরীক্ষা-নিরীক্ষাও। অবশেষে আগামী ২৯ ডিসেম্বর কুতুবদিয়ার ট্যাংক থেকে পাইপলাইনে ক্রুড অয়েল আসা শুরু হবে ইস্টার্ন রিফাইনারিতে। ইস্টার্ন রিফাইনারি এসব ক্রুড অয়েল পরিশোধন করে জ্বালানি তেল উৎপাদন করে সংশ্লিষ্ট বিপণন কোম্পানিগুলোকে প্রদান করবে। আমদানিকৃত ডিজেলগুলো সরাসরি তিনটি তেল বিপণন কোম্পানিকে প্রদান করা হবে। বিপিসির পরিচালক (অপারেশন্স) খালিদ আহমেদ বলেন, অবিশ্বাস্য রকমের কম সময়ে কুতুবদিয়া থেকে পতেঙ্গায় জ্বালানি তেল পৌঁছাবে। এতে সময় এবং অর্থ দুটোই সাশ্রয় হবে। প্রাথমিকভাবে বছরে অন্তত ৮০০ কোটি টাকা সাশ্রয় হবে। তিনি আরও বলেন, প্রকল্পটি বাস্তবায়নের মাধ্যমে দেশের জ্বালানি তেল পরিবহণের মান্দাতার আমলের ধারণা পাল্টে বিশ্বমানে উন্নীত হবে। বছরের পর বছর ধরে বহির্নোঙরে নোঙর করা মাদার ভ্যাসেল থেকে লাইটারেজ করে তেল পরিবহণ করা হতো। এখন এই লাইটারেজ জাহাজের খরচটি পুরোপুরি বেচে যাবে। এছাড়া একটি জাহাজ থেকে তেল খালাসে আগে যেখানে ১৫ দিন সময় লাগত এখন তা ৩৬ থেকে ৪৮ ঘণ্টায় নেমে আসবে। ইস্টার্ন রিফাইনারির ব্যবস্থাপনা পরিচালক ইঞ্জিনিয়ার মোহাম্মদ লোকমান বলেন, প্রকল্পটি বাস্তবায়নের পর এই প্রথম পাইপ লাইনে জ্বালানি তেল পরিবাহিত হবে। এটি দেশের জ্বালানি নিরাপত্তাসহ সার্বিক ক্ষেত্রে একটি বৈপস্নবিক পরিবর্তন নিয়ে আসবে। তিনি আরও বলেন, ইস্টার্ন রিফাইনারিতে বছরে ১৫ লাখ টন অপরিশোধিত জ্বালানি তেল পরিশোধন করা যায়। সিঙ্গেল পয়েন্ট মুরিং উইথ ডাবল পাইপলাইন (এসপিএম) প্রকল্প প্রতিষ্ঠানটির দ্বিতীয় ইউনিট। এটি চালু হলে পরিশোধন ক্ষমতা ৪৫ লাখ টনে উন্নীত হবে। প্রকল্পের তথ্যমতে, ২০১৫ সালে পাইপলাইন বসানোর প্রকল্পটি হাতে নেওয়া হয়। মোট চার হাজার ৯৩৫ কোটি ৯৭ লাখ টাকায় ২০১৮ সালের ডিসেম্বরের মধ্যে প্রকল্পটির কাজ শেষ করার কথা ছিল। এরই মধ্যে প্রকল্পের মেয়াদ তিনবার বৃদ্ধি করা হয়েছে। এর সঙ্গে সঙ্গে ব্যয়ও বেড়ে সাত হাজার ১২৫ কোটি টাকায় ঠেকেছে। এর মধ্যে চার হাজার ৬৮৮ কোটি টাকা ঋণ সহায়তা দিচ্ছে চীন সরকার। বাংলাদেশ পেট্রোলিয়াম করপোরেশন (বিপিসি) এক হাজার ৮৩৫ কোটি টাকা এবং বাংলাদেশ সরকার ৬০১ কোটি টাকা দিচ্ছে এই প্রকল্প বাস্তবায়নে। প্রকল্পের অধীনে এক সেট এসপিএম-পিএলইএম, একটি ভাসমান বয়া, ২২০ কিলোমিটার পাইপলাইন, এর মধ্যে ১৪৬ কিলোমিটার সাগরের তলদেশ দিয়ে এবং ৭৪ কিলোমিটার পাইপলাইন উপকূল দিয়ে, দুই লাখ ৮৮ হাজার ঘনমিটারের ছয়টি স্টোরেজ ট্যাংক, তিনটি বস্নক ভাল্ব স্টেশন নির্মাণ করা হচ্ছে। ইস্টার্ন রিফাইনারির এই কর্মকর্তা বলেন, বর্তমানে পরিশোধিত (রিফাইন) এবং অপরিশোধিত (ক্রুড) মিলে বছরে ৬০ লাখ টনের বেশি জ্বালানি তেল আমদানি করা হয়। এর পুরোটা আনা হয় সাগরপথে। মধ্যপ্রাচ্যসহ বিশ্বের নানা দেশ থেকে আনা জ্বালানি তেলবাহী বড় বড় অয়েল ট্যাংকার চট্টগ্রাম বন্দরের বহির্নোঙরে অবস্থান নিত। সেখান থেকে লাইটার ট্যাংকারে করে তেল নিয়ে আসা হতো পতেঙ্গার গুপ্তাখাল প্রধান ডিপো এবং ইস্টার্ন রিফাইনারির ট্যাংকে। দীর্ঘদিন ধরে চলে আসা এই প্রক্রিয়ায় বিপিসির কোটি কোটি টাকা খরচ হতো এবং দীর্ঘ সময় লাগত। লাইটারেজ করার সময় নানা কারণে অপচয়সহ বিপুল পরিমাণ তেল চুরি হতো। জ্বালানি তেল খালাসের মান্দাতার আমলের এই প্রক্রিয়ায় পরিবেশেও নেতিবাচক প্রভাব পড়ত। বিপিসির হিসাব মতে, মাদার ভ্যাসেল বসিয়ে রাখা এবং বিএসসির দুটি জাহাজ দিয়ে তেল লাইটারিং করতে বিপিসির বছরে খরচ হতো প্রায় ৮০০ কোটি টাকা।