সাফল্য পরিমাপের নির্দিষ্ট কোনো মানদন্ড নেই। কিন্তু যদি সিনেমার প্রসঙ্গ আসে, বিশেষত ভারতীয় সিনেমা, তখন একজন মানুষ হয়ে ওঠেন সেই মানদন্ড। যাকে দেখে অভিনেতা হওয়ার স্বপ্ন বুনেছেন হাজারো যুবক, অনেকেই হয়েছেন তারকা। প্রজন্মের পর প্রজন্ম যিনি অভিনয়ের দু্যতি ছড়িয়ে মুগ্ধতার মায়ায় জড়িয়ে রেখেছেন, সেই মহাতারকার নাম অমিতাভ বচ্চন।
জীবনের ৫৩ বছর রুপালি ভুবনে কাটিয়ে দিয়েছেন তিনি। লম্বা এই পথচলার দিকে চোখ রাখলে শুধুই বিস্ময় জাগে। একজন অভিনেতার জীবন কতটা বর্ণিল আর সাফল্যমন্ডিত হতে পারে, তার জ্বলজ্বলে উদাহরণ তিনি। কিন্তু এই ঝলমলে সাফল্যের পেছনে রয়েছে বহু সংগ্রামের গল্প। হাড়ভাঙা পরিশ্রম আর অসামান্য ত্যাগের ফলেই খ্যাতির আকাশ ছুঁয়েছেন তিনি।
অমিতাভের জন্ম বর্তমান ভারতের উত্তর প্রদেশের এলাহাবাদে। ষাটের দশকের শেষ দিকে তিনি মুম্বাইতে এসেছিলেন। হাতে ছিল শুধু একটি ড্রাইভিং লাইসেন্স। অভিনয়ের প্রতি প্রচন্ড ভালোবাসা নিয়ে স্বপ্নের নগরীতে পা রাখেন তরুণ অমিতাভ। তার ধ্যানজ্ঞানে ছিল শুধুই সিনেমা। তাই ওই সময়ে অনেক বিজ্ঞাপনচিত্রের কাজও অবলীলায় ফিরিয়ে দিয়েছিলেন।
এ কারণে চরম আর্থিক সংকট মোকাবিলা করতে হয়েছিল অমিতাভ বচ্চনকে। এমনকি পথের ধারে বেঞ্চে শুয়েও রাত কাটাতে হয়েছিল তাকে। সেই দুঃসময়ের দিনগুলোর কথা ১৯৯৯ সালের এক সাক্ষাৎকারে প্রকাশ্যে আনেন অভিনেতা। বলেছিলেন, 'ওই সময়ে আমার মাসিক আয় ছিল ৫০ রুপি। তখন বিজ্ঞাপনে কাজের জন্য ১০ হাজার রুপির প্রস্তাবও পেয়েছিলাম, কিন্তু গ্রহণ করিনি। কারণ, আমার মূল ফোকাস ছিল সিনেমায়। শুধু একটি ড্রাইভিং লাইসেন্স নিয়ে বোম্বে এসেছিলাম। ভাবনা ছিল, যদি অভিনেতা না হতে পারি তাহলে ক্যাব চালাব। তখন আমার থাকার জায়গাও ছিল না। বেড়াতে গিয়ে বন্ধুদের বাড়িতেও একটা নির্দিষ্ট সময়ের বেশি থাকা যায় না। এ কারণে কিছু রাত আমি মেরিন ড্রাইভের বেঞ্চে কাটিয়েছি, আমার দেখা সবচেয়ে বড় ইঁদুরগুলোর সঙ্গে।'
এ তো গেল ক্যারিয়ার শুরুর প্রথম দিকের কথা। তারকা হওয়ার আগে কম-বেশি সবারই দুর্দিন পার করতে হয়। কিন্তু তারকা হওয়ার পরও একবার ভয়ংকর আর্থিক সংকটে পড়তে হয়েছিল বিগ বি-কে। বাধ্য হয়ে নিজের কর্মচারীর কাছ থেকেও টাকা ধার নিয়েছিলেন তিনি। এ বিষয়টি প্রকাশ্যে এনেছেন তার পুত্র অভিষেক বচ্চন।
এক সাক্ষাৎকারে অভিষেক জানান, তিনি তখন যুক্তরাষ্ট্রে অভিনয়ের ওপর পড়াশোনা করছিলেন। ওই সময়ে তাদের বাড়িতে এত দুঃসময় ছিল যে, রাতে খাবারের ব্যবস্থাও ছিল না। বাধ্য হয়ে অভিষেক দেশে ফিরে আসেন বাবা অমিতাভের পাশে থাকার জন্য। অভিষেক বলেছেন, 'আমি বস্টনে বসে থাকতে পারি না, যখন আমার বাবা এটাও জানেন না যে, রাতে কী খাবেন! সময়টা এতই খারাপ ছিল। খাবার কেনার জন্য তিনি তার কর্মচারীর কাছ থেকে টাকা ধার নিয়েছিলেন। তখন আমি বাবাকে ফোন করে বলেছিলাম, 'বাবা, আমার মনে হয় আমি মাঝপথে কলেজ ছেড়ে আসতে চাই এবং তোমার পাশে থাকতে চাই। যেভাবেই হোক, তোমাকে সহযোগিতা করতে চাই। অন্তত তুমি জানো, তোমার ছেলে পাশে আছে'।
ইন্টারনেট সূত্রে জানা যায়, অমিতাভ বচ্চনের মোট সম্পদের পরিমাণ ৪৫৫ মিলিয়ন ডলার। যা বাংলাদেশি মুদ্রায় ৪ হাজার ৬০০ কোটি টাকারও বেশি। এই বিপুল সম্পদ এবং মহাতারকার খ্যাতি অর্জনের পেছনে তার কী অমানসিক পরিশ্রম করতে হয়েছিল, কতটা ত্যাগ করতে হয়েছিল, সেগুলোর খুব কম অংশই মানুষ জানতে পেরেছে।
শুধু জনপ্রিয়তা আর সম্পদ নয়, অমিতাভ বচ্চনের অর্জনের ঝুলিতে পুরস্কার ও সম্মাননারও কমতি নেই। ভারত সরকারের কাছ থেকে 'পদ্ম বিভূষণ', 'পদ্ম ভূষণ' ও 'পদ্মশ্রী' পদক পেয়েছেন। ফরাসি সরকারের সর্বোচ্চ বেসামরিক সম্মাননা 'লিজিয়ন অব অনার' এবং আফগানিস্তানের রাষ্ট্রপতির কাছ থেকেও সম্মাননাও লাভ করেছেন তিনি।
এছাড়া ভারতীয় চলচ্চিত্রের সর্বোচ্চ পুরস্কার দাদাসাহেব ফালকে পুরস্কার পেয়েছেন ২০১৮ সালে। এর আগে মোট চারবার শ্রেষ্ঠ অভিনেতা হিসেবে দেশটির জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কার অর্জন করেছেন অমিতাভ বচ্চন। আজীবন সম্মাননাসহ মোট ১৬ বার পেয়েছেন ফিল্মফেয়ার। এগুলো ছাড়াও আরও অসংখ্য পুরস্কার-সম্মাননা রয়েছে তার প্রাপ্তির খাতায়।
তার উলেস্নখযোগ্য সিনেমার মধ্যে রয়েছে- 'আনন্দ', 'পরওয়ানা', 'রেশমা ঔর শেরা', 'বাওয়াটি', 'বম্বের টু গোয়া', 'জঞ্জীর', 'অভিমান', 'নেমক-হারাম', 'কুঁওয়ারা বাপ', 'দোস্ত', 'রোটি কাপড়া অর মকান', 'মজবুর', 'চুপকে চুপকে', 'দিওয়ার', 'শোলে', 'কাভি কাভি', 'অমর আকবর অ্যান্থনী', 'কসমে ওয়াদে', 'ত্রিশূল', 'মুকদ্দর কা সিকান্দর', 'মিস্টার নটবরলাল', 'কালা পাত্থার', 'দোস্তানা', 'সিলসিলা', 'রাম বলরাম', 'লাওয়ারিস', 'ডারনা জারুরি হেয়', 'কাভি আল বিদা না কেহনা' ইত্যাদি।
বিস্ময়কর ব্যাপার হলো, যে বয়সে প্রায় সব অভিনেতা অবসর জীবন কাটান, সে বয়সে এখনো দাপটের সঙ্গে কাজ করে যাচ্ছেন অমিতাভ বচ্চন। তুমুল জনপ্রিয় টিভি শো 'কউন বানেগা ক্রোড়পতি' সঞ্চালনা করছেন, পাশাপাশি বিজ্ঞাপন ও সিনেমায় কাজ চলছে হরদম।