বুধবার, ২৩ এপ্রিল ২০২৫, ১০ বৈশাখ ১৪৩২
মৃতু্যবার্ষিকীতে স্মরণ

কিংবদন্তি এ টি এম শামসুজ্জামান

চলচ্চিত্রে এ টি এম শামসুজ্জামানের প্রাপ্তি অনেক। শ্রেষ্ঠ কৌতুক অভিনেতা হিসেবে তিনি জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কার পেয়েছেন তিনবার, শ্রেষ্ঠ অভিনেতা হিসেবে একবার, শ্রেষ্ঠ পার্শ্ব চরিত্রে একবার এবং আজীবন সম্মাননা হিসেবে একবার জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কারে ভূষিত হয়েছেন তিনি। এছাড়া, ২০১৫ সালে শিল্পকলায় অসামান্য অবদান রাখায় রাষ্ট্রীয় সম্মান একুশে পদক লাভ করেন এই গুণী অভিনেতা।
তারার মেলা রিপোর্ট
  ২০ ফেব্রুয়ারি ২০২৫, ০০:০০
কিংবদন্তি এ টি এম শামসুজ্জামান
কিংবদন্তি এ টি এম শামসুজ্জামান

এ টি এম শামসুজ্জামানের পুরো নাম আবু তাহের মোহাম্মদ শামসুজ্জামান। তার বেড়ে ওঠা তথা শৈশব-কৈশোর কেটেছে পুরান ঢাকার দেবেন্দ্রনাথ দাস লেন এলাকায়। তিনি পড়াশোনা করেছেন ঢাকার পগোজ স্কুল, কলেজিয়েট স্কুল ও রাজশাহীর লোকনাথ হাই স্কুলে। ময়মনসিংহ সিটি কলেজিয়েট হাইস্কুল থেকে ম্যাট্রিকুলেশন পাস করার পর এ টি এম জগন্নাথ কলেজ থেকে উচ্চতর শিক্ষা লাভ করেন।

এ টি এম শামসুজ্জামানের জন্ম ১৯৪১ সালের ১০ সেপ্টেম্বর নোয়াখালীর দৌলতপুরে নানার বাড়িতে। তবে তার গ্রামের বাড়ি লক্ষ্ণীপুরের ভোলাকোটের বড়বাড়ী। পরিবারের কোনো সূত্র ছিল না বিনোদন দুনিয়ায়। কিন্তু এ টি এম শামসুজ্জামান নিজের ভবিষ্যৎ এই জগতেই ভেবেছেন। সেই লক্ষ্যে ১৯৬১ সালে পরিচালক উদয়ন চৌধুরীর 'বিষকন্যা' চলচ্চিত্রে সহকারী পরিচালক হিসেবে কাজ শুরু করেন। এরপর তিনি খান আতাউর রহমান, কাজী জহির, সুভাষ দত্তের মতো বিখ্যাত পরিচালকদের সহকারী হিসেবে কাজ করেছেন।

চিত্রনাট্যকার ও কাহিনীকার হিসেবেও সফল এ টি এম শামসুজ্জামান। তার চিত্রনাট্যে প্রথম সিনেমা হচ্ছে 'জলছবি'। পরবর্তী সময়ে তিনি শতাধিক সিনেমার চিত্রনাট্য লিখেছেন। এ টি এম শামসুজ্জামানের অভিনয় জীবন শুরু হয়েছিল কৌতুক অভিনেতা হিসেবে। সে সময় তিনি বেশ কয়েকটি সিনেমায় কৌতুকাভিনেতার ভূমিকায় অভিনয় করেছেন। এই চরিত্রে তার অভিনীত সিনেমাগুলোর মধ্যে রয়েছে- 'জলছবি', 'যাদুর বাঁশি', 'রামের সুমতি', 'ম্যাডাম ফুলি', 'চুড়িওয়ালা' ইত্যাদি। কৌতুক চরিত্রে তিনি সে সময় দারুণ জনপ্রিয়তা অর্জন করেছিলেন।

এরপর নিজের অবস্থান আরও বেশি পোক্ত করেন খল অভিনেতা হিসেবে। খল চরিত্রে এ টি এম শামসুজ্জামানের অভিষেক হয় ১৯৭৬ সালে চলচ্চিত্র পরিচালক আমজাদ হোসেনের 'নয়নমণি' সিনেমার মাধ্যমে। এই সিনেমার পর তিনি বহু বছর ধরে খল চরিত্রে অভিনয় করেছেন। আর কুড়িয়েছেন প্রশংসা। নেতিবাচক ভূমিকায় এ টি এম যেসব সিনেমায় অভিনয় করেছেন, তার মধ্যে উলেস্নখযোগ্য হচ্ছে- 'অনন্ত প্রেম', 'দোলনা', 'অচেনা', 'মোলস্না বাড়ির বউ', 'হাজার বছর ধরে' ও 'চোরাবালি'।

এ টি এম শামসুজ্জামান অভিনীত সিনেমার তালিকাটা দীর্ঘ। সেই তালিকায় সফল সিনেমার সংখ্যাই বেশি। তার মধ্যে রয়েছে-'বড় বউ', 'ওরা ১১ জন', 'লাঠিয়াল', 'নয়নমনি', 'অশিক্ষিত', 'সূর্য দীঘল বাড়ি', 'ছুটির ঘণ্টা', 'লাল কাজল', 'দায়ী কে?', 'রাজলক্ষ্ণী শ্রীকান্ত', 'স্বপ্নের নায়ক', 'শ্বশুরবাড়ি জিন্দাবাদ', 'আমার স্বপ্ন তুমি', 'দাদিমা', 'ডাক্তার বাড়ি', 'চাঁদের মতো বউ', 'গেরিলা', 'লাল টিপ' হাসু আমার হাসু, সময় কথা বলে, বংশধর, পরিবর্তন, তালাক, বউ কথা কও, ষড়যন্ত্র, মৎস্যকুমারী, মনাপাগলা, মায়ের আঁচল, রামের সুমতি, ফুলেশ্বরী, ইন্সপেক্টর, শুভরাত্রি, সাথী, প্রেমিক, অস্বীকার, পাগলী, দুলারী, ইনসাফ, শিরি ফরহাদ, তালুকদার, উসিলা, চাঁপাডাঙ্গার বউ, তওবা, ওগো বিদেশেনী, পরিণীতা, শত্রম্ন, ফুলের মালা, প্রেমবিরহ, মর্যাদা, ঢাকা-৮৬, দায়ী কে?, দোলনা, ঘৃণা, অচেনা, পদ্মা মেঘনা যমুনা, অজান্তে, স্বপ্নের নায়ক, ভন্ড, বাদশা ভাই, মাটির কসম, খুনি আসামি, বদসুরত, বাঁচার লড়াই, তোমার জন্য পাগল, ম্যাডাম ফুলি, চুড়িওয়ালা, লঙ্কাকান্ড, জামাই শ্বশুর, আধিয়ার, শাস্তি, মোলস্না বাড়ির বউ, হাজার বছর ধরে, আমার স্বপ্ন তুমি, আয়না, চাঁদের মতো বউ, মন বসেনা পড়ার টেবিলে, এবাদত, পরাণ যায় জ্বলিয়ারে, কুসুম কুসুম প্রেম, গেরিলা, লালটিপ, চোরাবালি, পাগল তোর জন্য, দুটি মনের পাগলামি, দুই বেয়াইয়ের কীর্তি, আইসক্রিম, পাংকু জামাই, রাত্রির যাত্রী, আলফা, ইত্যাদি।

চলচ্চিত্রে এ টি এম শামসুজ্জামানের প্রাপ্তি অনেক। শ্রেষ্ঠ কৌতুক অভিনেতা হিসেবে তিনি জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কার পেয়েছেন তিনবার, শ্রেষ্ঠ অভিনেতা হিসেবে একবার, শ্রেষ্ঠ পার্শ্ব চরিত্রে একবার এবং আজীবন সম্মাননা হিসেবে একবার জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কারে ভূষিত হয়েছেন তিনি। এছাড়া, ২০১৫ সালে শিল্পকলায় অসামান্য অবদান রাখায় রাষ্ট্রীয় সম্মান একুশে পদক লাভ করেন এই গুণী অভিনেতা।

এ টি এম শামসুজ্জামান শুধু চলচ্চিত্রেই না, অভিনয় করেছেন মঞ্চ-বেতার ও টেলিভিশনেও। অভিনয় জীবনের প্রথম থেকে ষাটের দশকেই টিভি নাটকে অভিনয় করেছেন তিনি। স্বাধীনতার আগে যে 'সংশপ্তক' নাটক টিভিতে প্রচারিত হয়েছে, সেখানে এ টি এম শামসুজ্জামান 'রমজান' চরিত্রে অভিনয় করেছিলেন। তিনি বিটিভির বহু বিখ্যাত বিখ্যাত নাটকে অভিনয় করেছেন। পরবর্তী সময়ে বিভিন্ন টিভি চ্যানেলে অসংখ্য নাটকে, নানা ধরনের চরিত্রে তিনি অভিনয় করেছেন। তার অভিনীত শত শত নাটক রয়েছে। এর মধ্যে উলেস্নখযোগ্য হচ্ছে- 'রঙের মানুষ', 'ভবের হাট', 'শিলবাড়ি', 'ঘর কুটুম', 'বউ চুরি', 'নোয়াশাল', 'শতবর্ষে দাদাজান', 'সেরা কিপ্টুস', 'নাপিত', 'গরু চোর', 'মুরুব্বি জামাই', 'আমার বউ বেশি বুঝে', 'পিতা পুত্র', 'সিন্দুকনামা', 'ওস্তাদজি', 'আক্কেল আলীর নির্বাচন', 'ইলু ইলু', 'শোধবোধ', 'এই যে দুনিয়া', 'তরিক আলী হাডারি' ইত্যাদি।

একটা জীবন এ টি এম শামসুজ্জামান বিলিয়ে দিয়েছেন দেশের সংস্কৃতির জন্য। কয়েক প্রজন্মকে মাতিয়ে রেখেছেন তার কর্মনৈপুণ্যে। আজ তিনি নেই। কিন্তু কিংবদন্তিদের তো প্রস্থান নেই। তারা চলে গিয়েও থেকে যান। এ টি এম শামসুজ্জামানও থেকে যাবেন সবার মনে, দেশের অভিনয় ইতিহাসের স্বর্ণালি এক অধ্যায় হিসেবে।

এ টি এম শামসুজ্জামানের স্ত্রী রুনী জামান। এই দম্পতির ৩ ছেলে ও ৩ মেয়ে রয়েছে। ২০১২ সালের ১৩ মার্চ এ টি এম শামসুজ্জামানের ছোট ছেলে এ টি এম খলিকুজ্জামান কুশল নিজ বড় ভাই এ টি এম কামালুজ্জামান কবিরকে ছুরিকাঘাতে হত্যা করেন। হত্যাকান্ডের পর এ টি এম শামসুজ্জামান নিজেই ছেলে কুশলের বিরুদ্ধে মামলা করেন। হত্যার অভিযোগে এ টি এম খলিকুজ্জামান কুশলকে ২০১৩ সালে যাবজ্জীবন কারাদন্ড দেন আদালত।

এ টি এম শামসুজ্জামান ২০২১ সালের ২০ ফেব্রম্নয়ারি ঢাকার সূত্রাপুরের দেবেন্দ্রনাথ দাস লেনে নিজ বাসায় মৃতু্যবরণ করেন। তিনি দীর্ঘদিন ধরে বার্ধক্যজনিত নানা অসুখে ভুগছিলেন। তার মরদেহ জুরাইন কবরস্থানে তার বড় ছেলে কামরুজ্জামান কবীরের পাশে সমাহিত করা হয়।

  • সর্বশেষ
  • জনপ্রিয়

উপরে