১৩তম মৃতু্যবার্ষিকী আজ

কর্মগুণে ভক্তদের হৃদয়ে আছেন হুমায়ূন ফরীদি

নাট্যাভিনয় থেকে চলচ্চিত্রে আসাটা ছিল অনেক নাটকীয়। দেশীয় চলচ্চিত্রের তখনকার বেহাল অবস্থা দেখে রুপালি পর্দার জন্য কাজ করবেন কিনা এ বিষয়ে দ্বিধায় ছিলেন তিনি। শেষ পর্যন্ত নিজের দৃঢ়তায় এক নতুন আঙ্গিক নিয়ে বড় পর্দায় আসেন ফরীদি। তানভীর মোকাম্মেলের 'হুলিয়া' তার অভিনীত প্রথম ছবি।

প্রকাশ | ১৩ ফেব্রুয়ারি ২০২৫, ০০:০০

তারার মেলা রিপোর্ট
২০১২ সালের আজকের দিনে (১৩ ফেব্রম্নয়ারি) না ফেরার দেশে চলে যান মঞ্চ, টেলিভিশন ও চলচ্চিত্রের কিংবদন্তি অভিনেতা হুমায়ূন ফরীদি। আজ তার মৃতু্যর ১৩ বছর পূর্ণ হলো। শারীরিক মৃতু্য হলেও নিজ কর্মের মাধ্যমে আজও ভক্তদের মনে বেঁচে আছেন দাপুটে এই অভিনেতা। মঞ্চ, টেলিভিশন ও চলচ্চিত্র-তিন মাধ্যমেই ৩ দশক ধরে সমান তালে দাপিয়ে বেড়িয়েছেন হুমায়ূন ফরীদি। উপহার দিয়ে গেছেন বহু আলোচিত, জনপ্রিয় ও প্রশংসিত কাজ। যে কাজগুলোর জন্য আজও সবাই তাকে স্মরণ করেন। বিশেষ করে জন্ম কিংবা মৃতু্যবার্ষিকীর সময়টায় তাকে নিয়ে আরও বেশি চর্চা হয়। ১৯৫২ সালের ২৯ মে ঢাকার নারিন্দায় জন্মগ্রহণ করেছিলেন হুমায়ূন ফরীদি। তার বাবার নাম এ টি এম নুরুল ইসলাম, মায়ের নাম বেগম ফরিদা ইসলাম। চার ভাইবোনের মধ্যে ফরীদি ছিলেন দ্বিতীয়। ইউনাইটেড ইসলামিয়া সরকারি উচ্চ বিদ্যালয়ের ছাত্র ছিলেন তিনি। ১৯৭০ সালে উচ্চমাধ্যমিক পরীক্ষা দেন চাঁদপুর সরকারি কলেজ থেকে। একই বছর ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্গানিক কেমিস্ট্রিতে ভর্তি হন স্নাতক করতে। কিন্তু পরের বছরই মুক্তিযুদ্ধ শুরু হওয়ায় খাতা-কলম বাক্সবন্দি করে কাঁধে তুলে নেন রাইফেল। দীর্ঘ ৯ মাস পাকিস্তানি হানাদারদের বিরুদ্ধে দামাল ছেলের মতো লড়াই করেছেন ফরীদি। স্বাধীনতার পর ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের পরিবর্তে জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতি বিভাগে স্নাতক জীবন শুরু করেন হুমায়ূন ফরীদি। এখানেই তার অভিনয় প্রতিভার বিকাশ হয়েছিল। অর্থনীতির খটমটে তত্ত্ব বাদ দিয়ে সেলিম আল দীনের কাছে নাট্যতত্ত্বে দীক্ষা নেন তিনি। জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ে থাকতেই সদস্যপদ পান ঢাকা থিয়েটারের। এই নাট্যদল থেকেই ছড়িয়ে পড়তে থাকে তার অভিনয়ের রংগুলো। ছিলেন বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র সংসদের নাট্য সম্পাদক। নাটক, চলচ্চিত্র কিংবা মঞ্চ- সবখানেই ছিল হুমায়ূন ফরীদির অবাধ বিচরণ। মঞ্চ দিয়েই শুরু। ঢাকা থিয়েটারের 'শকুন্তলা', 'মুনতাসীর ফ্যান্টাসি', 'কীর্তনখোলা', 'কেরামত মঙ্গল'-এর মতো মঞ্চনাটকে অভিনয় করে নিজেকে প্রস্তুত করেছিলেন। আদায় করে নেন দর্শকের ভালোবাসা। বাংলাদেশ গ্রাম থিয়েটারের সদস্য হিসেবে গ্রাম থিয়েটারের চট্টগ্রাম বিভাগীয় প্রধান হিসেবে কাজ করেছেন তিনি। ঢাকা থিয়েটারের সদস্য হিসেবে শুধু রাজধানীতে নয়, বিভিন্ন জেলার মঞ্চেও অভিনয় করে জনপ্রিয় হয়েছিলেন। মঞ্চের গন্ডি পেরিয়ে টিভি নাটক আর চলচ্চিত্রেও স্বতন্ত্র অবস্থান গড়ে নেন হুমায়ূন ফরীদি। ১৯৮২ সালে বাংলাদেশ টেলিভিশনে প্রচারিত 'নীল নকশার সন্ধ্যায়' ও 'দূরবীন দিয়ে দেখুন' নাটকে অভিনয় করে তিনি তাক লাগিয়ে দেন। তার অভিনীত ধারবাহিক নাটক 'সংশপ্তক' আজও দর্শকের স্মৃতির পাতায় ভাস্বর। এতে কানকাটা রমজান চরিত্রে অভিনয় করে নিজেকে অন্য এক উচ্চতায় নিয়ে যান তিনি। অন্য নাটকগুলোর মধ্যে আছে 'ভাঙনের শব্দ শুনি', 'বকুলপুর কতদূর', 'দুই ভুবনের দুই বাসিন্দা', 'একটি লাল শাড়ি', 'মহুয়ার মন', 'সাত আসমানের সিঁড়ি', 'একদিন হঠাৎ', 'অযাত্রা', 'পাথর সময়', 'দুই ভাই', 'শীতের পাখি', 'কোথাও কেউ নেই', 'তিনি একজন', 'চন্দ্রগ্রস্ত', 'কাছের মানুষ', 'মোহনা', 'শৃঙ্খল', 'প্রিয়জন নিবাস'। সর্বশেষ তিনি 'তখন হেমন্ত' নামের একটি ধারাবাহিক নাটক পরিচালনা করেন এবং 'পূর্ণ চাঁদের অপূর্ণতায়' নামের একটি নাটকে অভিনয় করেন। ফরীদির নাট্যাভিনয় থেকে চলচ্চিত্রে আসাটা ছিল অনেক নাটকীয়। দেশীয় চলচ্চিত্রের তখনকার বেহাল অবস্থা দেখে রুপালি পর্দার জন্য কাজ করবেন কিনা এ বিষয়ে দ্বিধায় ছিলেন তিনি। শেষ পর্যন্ত সুবর্ণা মুস্তাফার অকুণ্ঠ সমর্থনে এবং নিজের দৃঢ়তায় এক নতুন আঙ্গিক নিয়ে বড় পর্দায় আসেন ফরীদি। তানভীর মোকাম্মেলের 'হুলিয়া' তার অভিনীত প্রথম ছবি। নব্বই দশকে বাণিজ্যিক ছবির পরিচালক শহীদুল ইসলাম খোকনের 'সন্ত্রাস', 'দিনমজুর', 'বীরপুরুষ' ও 'লড়াকু' ছবিতে নেতিবাচক চরিত্রে অভিনয় করেন। এরপরেই দেশীয় চলচ্চিত্রে খলনায়কের চরিত্র পায় এক অন্যমাত্রা। অবস্থা এমনই দাঁড়িয়েছিল যে, এক সময় মানুষ নায়কের পরিবর্তে তাকে দেখার জন্যই প্রেক্ষাগৃহে যেত। তাই শহীদুল ইসলাম খোকন 'বিশ্বপ্রেমিক', 'অপহরণ', 'দুঃসাহস'সহ ২৮টি ছবির মধ্যে ২৫টিতেই রাখেন ফরীদিকে। তার অভিনীত ছবির তালিকায় আরও আছে 'দহন', 'একাত্তরের যীশু', 'দূরত্ব', 'ব্যাচেলর', 'জয়যাত্রা', 'শ্যামল ছায়া', 'মায়ের অধিকার', 'অধিকার চাই', 'ত্যাগ', 'মায়ের মর্যাদা', 'মাতৃত্ব' ও 'আহা!'র মতো ছবিতে অভিনয় করে এ দেশের চলচ্চিত্রাঙ্গনে এক উলেস্নখযোগ্য পরিবর্তন আনেন ফরীদি। বেশ কিছু দিন ফুসফুসের জটিলতাসহ বিভিন্ন রোগে ভুগছিলেন হুমায়ূন ফরীদি। এই গুণী শিল্পীর ব্যক্তিজীবন খুব বেশি সুখের ছিল না। আশির দশকের শুরুর দিকে মিনুকে বিয়ে করেছিলেন। প্রথম সংসারে দেবযানী নামের এক মেয়েকে রেখে গেছেন তিনি। প্রথম স্ত্রীর সঙ্গে ছাড়াছাড়ির পর অভিনেত্রী সুবর্ণা মুস্তাফাকে ভালোবেসে ঘর বেঁধেছিলেন ফরীদি। ২০০৮ সালে সেই সম্পর্কেরও বিচ্ছেদ হয়। পরের সময়গুলো অনেকটা নিঃসঙ্গ কেটেছে এই শক্তিমান অভিনেতার। নানামুখী প্রতিভার এই অভিনেতার মৃতু্যর মধ্য দিয়ে এ দেশের অভিনয় ভুবনে একটি যুগের অবসান হয়। হুমায়ূন ফরীদি উইলিয়াম শেক্সপিয়রের 'কিং লিয়ার' নাটকে অভিনয়ের বাসনা জানিয়েছিলেন। নাটকটি আর করা হয়নি তার। কিন্তু জীবনের নানা পথপরিক্রমায় তার জীবনটাও যেন রাজা লিয়ারের মতো সুখে-দুঃখে ঘেরা! তবে যে ভালোবাসা তিনি পেয়েছেন, তা আজীবন দর্শকের হৃদয়ে থেকে যাবে। ভক্তদের ভালোবাসায় হুমায়ূন ফরীদি অমর হয়ে থাকবেন। কাজের স্বীকৃতিস্বরূপ 'মাতৃত্ব' সিনেমার জন্য ২০০৪ সালে সেরা অভিনেতা হিসেবে জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কার পান হুমায়ূন ফরীদি। এছাড়া, ২০১৮ সালে তাকে মরণোত্তর একুশে পদক দেওয়া হয়।