মঙ্গলবার, ২৯ এপ্রিল ২০২৫, ১৬ বৈশাখ ১৪৩২

চলচ্চিত্রের উজ্জ্বল নক্ষত্র জহির রায়হান

১৩৬২ বঙ্গাব্দে তার প্রথম গল্পসংগ্রহ সূর্যগ্রহণ প্রকাশিত হয়। 'হাজার বছর ধরে' উপন্যাসের মধ্যে যেভাবে তিনি আবহমান বাংলার স্বকীয়তা ও ধারাবাহিকতাকে বেঁধেছেন, এক কথায় তা অসামান্য। বাংলা সাহিত্যে এমন কালজয়ী উপন্যাস খুব বেশি নয়। ভাষা আন্দোলনের পটভূমিতে জহির রায়হানের লেখা 'একুশে ফেব্রম্নয়ারি' ও 'আরেক ফাল্গুন' নামক উপন্যাস দুটি তার অনবদ্য রচনা। এছাড়াও উলেস্নখযোগ্য গ্রন্থাবলির মধ্যে রয়েছে- সূর্যগ্রহণ, শেষ বিকেলের মেয়ে, হাজার বছর ধরে, আর কতদিন, কয়েকটি মৃতু্য, বরফ গলা নদী, তৃষ্ণা প্রভৃতি।
তারার মেলা রিপোর্ট
  ০৬ ফেব্রুয়ারি ২০২৫, ০০:০০
চলচ্চিত্রের উজ্জ্বল নক্ষত্র জহির রায়হান
চলচ্চিত্রের উজ্জ্বল নক্ষত্র জহির রায়হান

বাংলা সাহিত্য ও চলচ্চিত্রের উজ্জ্বলতম এক নক্ষত্রের নাম জহির রায়হান। প্রগতিশীল ও প্রতিবাদী সাহিত্য চর্চা করতে করতেই এক সময় তিনি চলচ্চিত্রকে মাধ্যম হিসেবে বেছে নেন। পরবর্তী সময়ে চলচ্চিত্রই হয়ে ওঠে তার ধ্যান-জ্ঞান। জহির রায়হান এক কথায় বাংলাদেশের একজন প্রখ্যাত চলচ্চিত্র নির্মাতা, ঔপন্যাসিক এবং গল্পকার। তিনি বাঙালির এক ঐতিহ্য পুরুষ। সংস্কৃতি ও রাজনীতি অঙ্গনের এই কৃতী পুরুষের মূল পরিচয় সাহিত্যিক ও চলচ্চিত্রকার। রাজনৈতিক আদর্শে বিপস্নবে বিশ্বাসী ছিলেন বাঙালির এই বীর সন্তান। তিনি একজন মুক্তিযোদ্ধা, ভাষাসৈনিক, সাংবাদিক- সর্বোপরি একজন প্রতিবাদী মানুষ; যিনি ঐতিহ্যকে লালন করেছিলেন নিজের বিশ্বাসে বলীয়ান থেকে।

১৯৩৫ সালে তিনি ফেনী জেলার মজিপুর গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন। তার পিতা মাওলানা মোহাম্মদ হাবিবুলস্নাহ কলকাতা আলীয়া মাদ্রাসার অধ্যাপক এবং ঢাকা আলীয়া মাদ্রাসার অধ্যক্ষ ছিলেন। জহির রায়হানের প্রকৃত নাম মোহাম্মদ জহিরউলস্নাহ। তার ডাক নাম ছিল জাফর। ছোটবেলাতেই তিনি রাজনীতির সংস্পর্শে আসেন।

বড় ভাই শহীদুলস্নাহ কায়সার ও বড় বোন নাফিসা কবির বাম ধারার রাজনীতির সঙ্গে যুক্ত ছিলেন। তাদের কাছ থেকেই জহির রায়হানের বামপন্থি চিন্তাচেতনায় দীক্ষিত হন। তিনি কলকাতায় মিত্র ইনিস্টিউটে এবং পরে আলীয়া মাদ্রাসায় অধ্যয়ন করেন। ভারত বিভাগের পর তিনি তার পরিবারের সদস্যদের সঙ্গে নিজ গ্রামে চলে যান। ১৯৫০ সালে তিনি আমিরাবাদ উচ্চ বিদ্যালয় থেকে ম্যাট্রিক পাস করেন এবং ঢাকায় এসে কলেজে ভর্তি হন।

একটা সময় ঢাকায় ভাষা আন্দোলনের দ্বিতীয় পর্বের সূচনা হয়। তিনি সচেতনভাবে যুক্ত হন ভাষা আন্দোলনের সঙ্গে। ১৯৫২ সালের ২১ ফেব্রম্নয়ারি আমতলা বৈঠকের সিদ্ধান্ত মোতাবেক যে ১০ জনের দলটি প্রথম ১৪৪ ধারা ভঙ্গ করে গ্রেপ্তার হন, জহির রায়হান ছিলেন তাদের অন্যতম। ১৯৫৮ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে বাংলায় স্নাতক ডিগ্রি লাভ করেন।

এরই মধ্যে ১৯৫২ সালে তিনি ফটোগ্রাফি শিখতে কলকাতা গমন করেন এবং প্রমথেশ বড়ুয়া মেমোরিয়াল স্কুলে ভর্তি হন। ১৯৫৬ সালে তিনি চলচ্চিত্রে প্রবেশ করেন। ১৯৬১ সালে তার পরিচালিত প্রথম চলচ্চিত্র 'কখনো আসেনি' মুক্তি পায়। তারপর একের পর এক তার নির্মিত চলচ্চিত্র মুক্তি পেতে থাকে। নিপুণ দক্ষতার সঙ্গে চলচ্চিত্র নির্মাণ শিল্পে খুব অল্পসময়ে নিজেকে বিকশিত করেন জহির রায়হান। তার নির্মিত মুক্তিযুদ্ধ ভিত্তিক প্রামাণ্য চিত্রগুলো যুদ্ধকালীন সময়ে বিশ্বমানবতার টনক নাড়িয়ে দেয়।

জহির রায়হানের নির্মিত চলচ্চিত্রগুলো হলো-কখনো আসেনি (১৯৬১), সোনার কাজল (১৯৬২), কাচের দেয়াল (১৯৬৩), সংগ্রাম (১৯৬৪ তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানের সর্বপ্রথম রঙিন চলচ্চিত্র), বাহানা (১৯৬৫), বেহুলা (১৯৬৬), আনোয়ারা (১৯৬৬), দুই ভাই (১৯৬৮), জীবন থেকে নেয়া (১৯৬৯) ও ইংরেজি ভাষায় 'খবঃ ঞযবৎব ইব খরমযঃ'। ১৯৫৫ সালে তার প্রথম গল্পগ্রন্থ সূর্যগ্রহণ ও ১৯৬০ সালে প্রথম উপন্যাস শেষ বিকালের মেয়ে প্রকাশিত হয়।

পেশাগত জীবনে তিনি সাংবাদিকতা ও চলচ্চিত্র সাংবাদিকতার সঙ্গে সরাসরি জড়িত ছিলেন। ১৯৫০ সালে 'যুগের আলো' পত্রিকা দিয়ে তিনি সাংবাদিকতার সঙ্গে যুক্ত হন ও পরবর্তী সময়ে বিভিন্ন পত্রিকায় সাংবাদিকতা করেন। তিনি ১৯৭০ সালে প্রকাশিত ইংরেজি পত্রিকা দ্য উইকলি এক্সপ্রেস প্রকাশের উদ্যোক্তাদের অন্যতম। এছাড়া, তিনি কতিপয় সাহিত্য পত্রিকার সঙ্গেও যুক্ত ছিলেন। ১৯৫৬ সালে 'প্রবাহ' পত্রিকায় জহির রায়হান সম্পাদকের দায়িত্ব পালন করেন। ১৯৬৪ সালে তিনি পাকিস্তানের প্রথম রঙিন চলচ্চিত্র 'সঙ্গম' নির্মাণ করেন (উর্দু ভাষার ছবি) এবং পরের বছর তার প্রথম সিনেমাস্কোপ চলচ্চিত্র 'বাহানা' মুক্তি দেন।

ব্যক্তিগত জীবনে জহির রায়হান ১৯৬১ সালে সুমিতা দেবীকে এবং ১৯৬৬ সালে তিনি সুচন্দাকে বিয়ে করেন। দু'জনেই ছিলেন সে সময়কার বিখ্যাত চলচ্চিত্র অভিনেত্রী। শমী কায়সার জহির রায়হানের বড় ভাই শহীদুলস্নাহ কায়সারের কন্যা।

জহির রায়হান 'লেট দেয়ার বি লাইট' নামে একটি ইংরেজি ছবি নির্মাণ শুরু করেন। কিন্তু মুক্তিযুদ্ধ শুরু হওয়ায় তিনি তা শেষ করতে পারেননি। ১৯৭১ সালে মুক্তিযুদ্ধ শুরু হলে তিনি কলকাতায় চলে যান এবং সেখানে বাংলাদেশের স্বাধীনতার পক্ষে প্রচারাভিযান ও তথ্যচিত্র নির্মাণ শুরু করেন। সেখান থেকে পাকিস্তানি সামরিক জান্তার গণহত্যার চিত্র সংবলিত 'স্টপ জেনোসাইড' নির্মাণ করেন। ছবিটি পৃথিবীজুড়ে আলোড়ন সৃষ্টি করে। সে সময়ে তিনি চরম অর্থনৈতিক দৈন্যের মধ্যে থাকা সত্ত্বেও তার চলচ্চিত্র প্রদর্শনী থেকে প্রাপ্ত সমুদয় অর্থ তিনি মুক্তিযোদ্ধা তহবিলে দান করেন।

জহির রায়হানের চিন্তাচেতনা ছিল ভিন্নতর। প্রকৃতপক্ষে তিনি ছিলেন একজন নাগরিক লেখক। নগরকেন্দ্রিক ঘটনাবলি ছিল তার উপন্যাসের মূল উপজীব্য। ছাত্রজীবনেই তিনি লেখালেখিতে আগ্রহ প্রকাশ করেন। লেখক হিসেবে জহির রায়হানের জনপ্রিয়তাও ছিল তুঙ্গে। সাতটি উপন্যাসের মধ্যে কেবল 'হাজার বছর ধরে' ছাড়া অন্য সবের পটভূমি শহর বা নগর কেন্দ্রিক।

১৩৬২ বঙ্গাব্দে তার প্রথম গল্পসংগ্রহ সূর্যগ্রহণ প্রকাশিত হয়। 'হাজার বছর ধরে' উপন্যাসের মধ্যে যেভাবে তিনি আবহমান বাংলার স্বকীয়তা ও ধারাবাহিকতাকে বেঁধেছেন, এক কথায় তা অসামান্য। বাংলা সাহিত্যে এমন কালজয়ী উপন্যাস খুব বেশি নয়। ভাষা আন্দোলনের পটভূমিতে জহির রায়হানের লেখা 'একুশে ফেব্রম্নয়ারি' ও 'আরেক ফাল্গুন' নামক উপন্যাস দুটি তার অনবদ্য রচনা। এছাড়াও উলেস্নখযোগ্য গ্রন্থাবলির মধ্যে রয়েছে-সূর্যগ্রহণ, শেষ বিকেলের মেয়ে, হাজার বছর ধরে, আর কতদিন, কয়েকটি মৃতু্য, বরফ গলা নদী, তৃষ্ণা প্রভৃতি।

জহির রায়হান 'হাজার বছর ধরে' উপন্যাসের জন্য ১৯৬৪ সালে 'আদমজী পুরস্কার' পান। ১৯৭২ সালে তাকে বাংলা একাডেমি পুরস্কার (মরণোত্তর) এবং ১৯৭৭ সালে একুশে পদকে ভূষিত করা হয়। এছাড়া, শ্রেষ্ঠ বাংলা ছবি হিসেবে 'কাচের দেয়াল' চলচ্চিত্রের জন্য তিনি 'নিগার পুরস্কার' লাভ করেন।

১৯৭১ সালে জহিরের জ্যেষ্ঠ ভ্রাতা প্রখ্যাত লেখক শহীদুলস্নাহ কায়সারকে অজ্ঞাতনামা দুর্বৃত্তরা তার বাসভবন থেকে তুলে নিয়ে যায়। তিন খবর পান যে, শহীদুলস্না কায়সারকে ঢাকার মিরপুরে রাখা হয়েছে। এরপর তিনি তাকে উদ্ধারের জন্য বেরিয়ে পড়েন। কিন্তু ১৯৭২ সালের ৩০ জানুয়ারির পর তাকে আর দেখা যায়নি কোথাও।

জহির রায়হান আজও স্মরণীয়, বরণীয় এবং বাঙালির স্মৃতিপটে অম্স্নান। তিনি প্রজন্ম থেকে প্রজন্মে আজন্মের আলোকবর্তিকা; শিল্প-সৃজনে অনুপ্রেরণার এক সূতিকাগার। তার অনবদ্য সৃজনালোয়ে তিনি উজ্জ্বল হয়ে বেঁচে থাকবেন বাঙালির স্মৃতি-সত্তায়।

  • সর্বশেষ
  • জনপ্রিয়

উপরে