বিশ্বমানের অভিনেতা তুলসী চক্রবর্তী

প্রকাশ | ০৫ ডিসেম্বর ২০২৪, ০০:০০

সালেহ ইমরান
সাদা-কালো যুগের প্রবাদপ্রতিম অভিনেতা তুলসী চক্রবর্তী। মূলত কৌতুকের চরিত্রের শিল্পী ছিলেন, কিন্তু আজও তিনি যে কোনো উঠতি অভিনেতা-অভিনেত্রীর অনুপ্রেরণা। গত শতাব্দীর ষাট-সত্তর দশকের বাংলা চলচ্চিত্র যারা দেখেছেন, তাদের কাছে তুলসী চক্রবর্তী অপরিচিত নন। এই নাম শুনলে অনেকেরই চোখে ভেসে ওঠে দুটি সিনেমা। একটি সত্যজিৎ রায়ের 'পরশ পাথর', অন্যটি নির্মল দে পরিচালিত 'সাড়ে চুয়াত্তর'। তিনি অভিনয় জীবনে সবচেয়ে বেশি আনন্দ পেয়েছিলেন সত্যজিৎ রায়ের 'পরশ পাথর' ছবিতে অভিনয় করে। 'বউ মানে কী? বউ মানে গাছতলা, মানুষ তেতেপুড়ে এসে গাছতলায় বসে। তা তুমি হচ্ছো আমার খেজুর গাছ। কাঁটা আছে, ছায়া নেই।' 'সাড়ে চুয়াত্তর' সিনেমার এই বিখ্যাত ডায়লগটি ভুলবে না আপামর বাঙালি সিনেমাপ্রেমীরা। কিন্তু ভুলে গেছে সেই অভিনেতাকে, যার ছায়া এই সিনেমায় জনপ্রিয় জুটি উত্তমকুমারের উপস্থিতিকেও ম্স্নান করে দিয়েছিল। অনেকেই মনে করেন 'উত্তম-সুচিত্রা' জুটির থেকেও সাড়ে চুয়াত্তর 'তুলসী-মলিনা'র ছবি। তিনি এতটাই উজ্জ্বল হয়ে উঠেছিলেন এই ছবিতে। ১৯৫৩ সালে মুক্তি পেয়েছিল নির্মল দে পরিচালিত 'সাড়ে চুয়াত্তর'। \হদেখতে কখনো তথাকথিত নায়কের মতো নন। সুদর্শনও বলা যাবে না। বড় বড় চোখ, এক মাথা টাক, অবিন্যস্ত দাঁত আর মোটা ভুঁড়ির ছোট চরিত্রের বড় অভিনেতা তুলসী চক্রবর্তীর অভিনয় প্রতিভাকে একমাত্র সত্যজিৎ রায়ই বুঝতে পেরেছিলেন। তাকে না পেলে সত্যজিৎ রায় যে 'পরশ পাথর' বানাতে পারতেন না, এটা তিনি তার শেষজীবনে বলে গেছেন। সত্যজিৎ রায় বলেছিলেন 'তুলসী চক্রবর্তীর মতো অভিনেতা এ পোড়া দেশে না জন্মে হলিউডে জন্মালে অস্কার পেতেন।' অনেকেই জানেন না, এই অসম্ভব প্রতিভাসম্পন্ন অভিনেতা ছোটবেলায় বাড়ি থেকে পালিয়ে গিয়েছিলেন বোস সার্কাসের সঙ্গে রেংগুনে। সেখানে জোকার সেজে খেলা দেখাতেন। কলকাতায় ফিরে ছাপাখানায় কাজ করেছেন। কাজ করেছেন মদের দোকানেও। তার জ্যাঠামশাই হারমোনিয়াম-বাদক প্রসাদ চক্রবর্তীকে স্টার থিয়েটারে খাবার পৌঁছে দিতে গিয়ে তার নাট্যজগতে আসা। সেখান থেকেই সিনেমার অফার। তার প্রথম ছবি 'পুনর্জন্ম'। বাংলা সিনেমার পাশাপাশি পঁচিশটি হিন্দি ছবিতে অভিনয় করেছেন তিনি। অভিনয়ের পাশাপাশি অনেক ছবির গীতিকারও ছিলেন তিনি। শু্যটিং চলাকালীন মুখে মুখে রচনা করতেন গান। কী বিস্ময়কর প্রতিভা। কিন্তু এমন শিল্পীর শেষ জীবন কিন্তু ভালো কাটেনি। না ছিল অর্থ, না তাকে সিনেমা জগৎ দিতে পেরেছে সঠিক সম্মান। অনেকে তাকে শুধু ঠকিয়ে নিয়েছে। পারিশ্রমিক পাননি ঠিকমতো। ছবিও নির্বাচন করতেন না তিনি। যে যা রোল দিত, রাজি হয়ে যেতেন বিনা শর্তে। আসলে তিনি ভয় পেতেন যদি কাজ না থাকে। সত্যজিৎ রায় গাড়ি পাঠাতে চাইলে বলেছিলেন, 'আমার ট্রামের সেকেন্ড ক্লাসই ভালো। গাড়ি চললে যদি লোকে ভাবে পারিশ্রমিক বেশি নিই।' যার ফলে, 'পরশ পাথরের' নায়ককে দিয়ে ছোটখাটো ভাঁড়ের রোল করানো হতো। 'হাসি শুধু হাসি নয়' সিনেমায় ১৩টি সন্তানের জনক হিসেবে পর্দা মাতিয়ে দিলেও বাস্তবে নিঃসন্তান ছিলেন তুলসী। ছোট্ট বাড়িতে তার সঙ্গী ছিল কেবল দারিদ্র?্য। স্ত্রী উষারাণী চক্রবর্তীর কথা ভাবতেন। নিজের বাড়িটি দান করে গেছিলেন এলাকার গরীব পুরোহিতদের জন্য। কিন্তু তার মৃতু্য পর স্ত্রী উষারাণী দেবী একমুঠো খাবারের জন্য ভিক্ষা করেছেন। এমন কী স্বামীর মেডেলও বিক্রি করেছেন অভাবের তাড়নায়। এর চেয়ে মর্মান্তিক ঘটনা আর কী হতে পারে। কিছু অনুদান ছাড়া বিশ্বমানের অভিনেতা, একার জোরে বক্স অফিস কাঁপিয়ে দেওয়া তুলসী চক্রবর্তীর প্রতিভার সম্মান রাখতে পারেনি বাংলার সিনেজগতে। এ বড় বেদনার কথা।