বলিষ্ঠ অভিনেতা আলমগীর

ঢাকাই চলচ্চিত্রের জন্য আরেকটি স্বর্ণযুগ দরকার। তার মানে আমরা আবার সেই সাদা-কালো যুগে ফিরে যাওয়ার কথা বলছি। আমি বলছি, এমন একটি স্বর্ণযুগের- যেটা হবে ডিজিটাল এবং স্মার্ট। শুধু শুধু 'ভাইরাল' হয়ে স্টার হওয়া যায় না। অভিনেতা-অভিনেত্রী হওয়া যায় না। আর অশ্লীল মানেই অশ্লীল, সেটি সিনেমা হলের বড় পর্দায় হোক কিংবা ওটিটি। অশ্লীল কখনো শ্লীল হতে পারে না।

প্রকাশ | ০৫ ডিসেম্বর ২০২৪, ০০:০০

মাতিয়ার রাফায়েল
.

ঢালিউডের জীবন্ত কিংবদন্তি চিত্রনায়ক আলমগীর। বাংলাদেশের চলচ্চিত্রে অভিনেতা হিসেবে সবচেয়ে বেশি পুরস্কার অর্জন করেছেন তিনি। পুরো নাম মহিউদ্দিন আহমেদ আলমগীর। এমন নয় যে, তিনি ফাঁকা মাঠে এই পুরস্কারগুলো অর্জন করেছেন। দেশ স্বাধীন হওয়ার পর যখন তিনি ঢাকাই সিনেমায় নাম লেখান তখন নায়করাজ রাজ্জাকের মতো কিংবদন্তি অভিনেতা সদর্পে ঢাকাই সিনেমা শাসন করছিলেন। যার সঙ্গে লড়ছিলেন চলচ্চিত্রের আরেক যুবরাজ ওয়াসিম। ১৯৭৩ সালে অভিনেতা বুলবুল আহমেদও এফডিসিতে পা রাখেন। অন্যদিকে, ১৯৭১ সালে ঢাকাই চলচ্চিত্রে পা রাখেন আরেক হিরো ঢাকাই চলচ্চিত্রের 'মিয়া ভাই'খ্যাত আকবর হোসেন পাঠান দুলু, যিনি চিত্রজগতে ফারুক নামেই পরিচিত। তিনিও ছিলেন নায়করাজ রাজ্জাকের অন্যতম প্রতিদ্বন্দ্বী। যেখানে আবার একই সময়ে সিনেমায় পা রাখা আরও একজন অভিনেতার ফাঁকে নায়করাজ রাজ্জাকের শক্তির পরীক্ষা নিচ্ছিলেন- তিনি 'মেগাস্টার'খ্যাত উজ্জ্বল। ছিলেন আরও অনেকেই। তারাও ছিলেন নিজ নিজ নামের ওপর আলোচিত অভিনেতা। আনোয়ার হোসেন, সোহেল রানা, জাফর ইকবাল, প্রবীর মিত্র, মাহমুদ কলি, আবুল খায়ের জসিম উদ্দিন চলচ্চিত্রে তিনি জসিম নামেই পরিচিত এবং সর্বশেষ তার কয়েক বছর পর যুক্ত হওয়া ইলিয়াস কাঞ্চন (১৯৭৭)। তবে নায়ক আলমগীরকে দর্শক চিনতে শুরু করেন নায়করাজ রাজ্জাক এবং সোহেল রানার সঙ্গে 'জিঞ্জির' (১৯৭৮) ছবিতে কো-আর্টিস্ট হিসেবে অভিনয় করার সময় থেকে। এরপর তাকে আর পেছনে তাকাতে হয়নি। যদিও তার চলচ্চিত্রের মাঠ কুসুমাস্তীর্ণ ছিল না। লড়াই করতে হয়েছে অনেক জায়ান্ট অভিনেতাদের সঙ্গে। সেই কঠিন লড়াইয়ের মধ্যে থেকেই তিনি অর্জন করে নিয়েছেন বাংলাদেশ জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কারের সর্বোচ্চ দশটি জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কার। বাংলাদেশের অভিনেতাদের মধ্যে যে তিনজন অভিনেতা তাদের অভিনয়ে মেলোড্রামা দিয়ে দর্শক মাত করেছিলেন তাদের মধ্যে আনোয়ার হোসেন, নায়করাজ রাজ্জাক ও আলমগীর। কিন্তু এ তিনজনের মধ্যে আলমগীরের মেলোড্রামার সঙ্গে বলিষ্ঠ সংলাপ থ্রো যেন জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কার প্রাপ্তির জন্য সবচেয়ে বেশি উপযোগী। একটি আজীবন সম্মাননা এবং ৯টি চলচ্চিত্রের জন্য ৭ বার শ্রেষ্ঠ অভিনেতা ও ২ বার শ্রেষ্ঠ পার্শ্ব অভিনেতা হিসেবে পুরস্কার প্রাপ্তিই তার প্রমাণ দেয়। এই যে একজন নায়ক, তার অভিনয় জীবনের তিন দশকের ক্যারিয়ারে এক বাংলাদেশ জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কারেই ১০টি পুরস্কার অর্জন করে নিলেন সেই সঙ্গে বাচসাসসহ আরও বহু পুরস্কার আছেই- সে কি পুরস্কার কমিটির জুরি বোর্ড এমনিতেই দিয়ে দিল? ঢাকাই সিনেমার অভিনয়ে মেলোড্রামা দিয়ে রুপালি পর্দা কাঁপিয়েছেন আনোয়ার হোসেন, নায়করাজ রাজ্জাক, উজ্জ্বলসহ অনেকেই কিন্তু নায়ক আলমগীর তার মেলোড্রামা দিয়ে যেভাবে পর্দা কাঁপিয়েছেন, ধরিয়েছেন নারীর হৃদয়ে কাঁপন- সেরকম অভিনয় আর কে দিতে পেরেছেন? পারিবারিক টানাপড়েন, সামাজিক অ্যাকশন, রোমান্টিক অ্যাকশন, ফোক ফ্যান্টাসিসহ সব ধরনের চলচ্চিত্রেই তার এই মেলোড্রামা এ দেশের তরুণ-তরুণীদের মনে কাঁপন ধরিয়ে দিয়েছিল। এমন সাফল্যের স্বীকৃতিরই পরিচয় এতগুলো জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কার। জুটেছে এ বছর একুশে পদকও। এফডিসিতে পা রাখার শুরুর দিকে নায়করাজ রাজ্জাকসহ অন্যান্যের দাপটে তেমন সুবিধা না করতে পারলেও একপর্যায়ে যখন রাজ্জাকের বয়স বাড়তে থাকে এবং নায়ক হিসেবে দর্শককের চাহিদাপূরণ করতে ব্যর্থ হলে তার সেই জায়গাটি দখল নিতে অন্যেরা সফল না হলেও নায়ক আলমগীর বিস্ময়করভাবে তার সফলতা দেখান। নায়ক আলমগীর ১৯৮৫ সালে যখন তার 'মা ও ছেলে' সিনেমায় 'দীপক চৌধুরী' চরিত্রে সর্বপ্রথম জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কার লাভ করেন তখন নায়করাজ রাজ্জাকের বয়স ৪৪। অর্থাৎ নায়ক হিসেবে তিনি তখন পড়তির দিকে। নায়করাজ রাজ্জাক যেমন তার মেলোড্রামা দিয়ে দর্শকপ্রিয় হয়ে উঠেছিলেন আলমগীরও তেমন তার মেলোড্রামা দিয়ে দ্রম্নত দর্শকের প্রিয় হয়ে উঠেন। শুধু মেলোড্রামাই নয়, তার ওই মেলোড্রামাটিক অভিনয়ের সঙ্গে যেন তার চকচকে চোখের ভাষাটিও যেন দারুণ মূর্ত হয়ে উঠতো এমন অভিনয়ের সময়ে। এটাই তাকে নায়করাজ রাজ্জাক থেকে অনেকটা এগিয়ে রাখে এবং বিশিষ্টতা অর্জনে সহায়ক হয়ে ওঠে। একপর্যায়ে দেখা যায়, জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কার নিজের ঝুলিতে পূরণের ক্ষেত্রে নায়ক আলমগীরের প্রতিদ্বন্দ্বী ছিলেন মাত্র দু'জনই। এক তার পূর্বসূরি নায়করাজ রাজ্জাক এবং তার সময়ের বুলবুল আহমেদ। নায়করাজ রাজ্জাক শ্রেষ্ঠ অভিনেতা হিসেবে পাঁচবার জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কার এবং আজীবন সম্মাননাসহ ৬ বার জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কার লাভ করেন। অন্যদিকে, বুলবুল আহমেদ শ্রেষ্ঠ অভিনেতা হিসেবে তিনবার জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কার লাভ করেন এবং একবার শ্রেষ্ঠ চলচ্চিত্র পরিচালক পুরস্কার হিসেবে মোট চারবার জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কার লাভ করেন। তবে তাকে চলচ্চিত্রের জন্য আজীবন সম্মাননা দেওয়া হয়নি। যেমন নায়করাজ রাজ্জাককে প্রথম সর্বোচ্চ বেসমারিক পুরস্কার স্বাধীনতা পদক দেওয়া হলেও দেওয়া হয়নি রাষ্ট্রের দ্বিতীয় সর্বোচ্চ পুরস্কার একুশে পদক। নিজেই তার সাফল্যের মূল্যায়ন করতে গিয়ে নায়ক এম এ আলমগীর বলেন, 'ঢাকাই চলচ্চিত্রের জন্য আরেকটি স্বর্ণযুগ দরকার। তার মানে আমরা আবার সেই সাদা-কালো যুগে ফিরে যাওয়ার কথা বলছি। আমি বলছি, এমন একটি স্বর্ণযুগের- যেটা হবে ডিজিটাল এবং স্মার্ট। শুধু শুধু 'ভাইরাল' হয়ে স্টার হওয়া যায় না। অভিনেতা-অভিনেত্রী হওয়া যায় না। আর অশ্লীল মানেই অশ্লীল, সেটি সিনেমা হলের বড় পর্দায় হোক কিংবা ওটিটি। অশ্লীল কখনো শ্লীল হতে পারে না। অশ্লীলতা দিয়ে কখনো টিকে থাকা যায় না। কারণ অশ্লীলতাকে দর্শক সব সময়ই দূরে ছুড়ে ফেলে দেয়।' তবে, দিনকে দিন জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কার নিয়ে যেমন বিতর্ক হচ্ছিল তেমন পুরস্কার প্রদানে পাত্র বাছাইয়েও প্রশ্ন উঠছিল গত দেড়যুগে। স্বৈরশাসনের সেই সময়ে রাজনৈতিক বিবেচনাকেই প্রধান স্বীকৃতি ধরে পুরস্কার দেওয়া হয়েছে। অনেক পুরস্কারই হয়েছে বিতর্কিত। ফলে, চলচ্চিত্র নির্মাতাদের মধ্যে যারা পুরস্কার পাওয়ার আশা করে সিনেমা বানান তারাও তাদের চলচ্চিত্রে সেই হিসাব কষেই অভিনেতা-অভিনেত্রী যুক্ত করতেন। এভাবে ঢাকাই চলচ্চিত্রে গত দেড় যুগে গুণী অভিনেতা-অভিনেত্রীও কমে আসছিল। বর্তমানে সেই কাঠামোর আমূল বদলে ফেলা হচ্ছে। নতুন জুরিবোর্ড গঠন করা হয়েছে। বর্তমানে গুরুত্বপূর্ণ প্রতিটি ক্ষেত্রেই সংস্কার চলছে। কিন্তু বাংলাদেশের চলচ্চিত্রে একজন গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তিত্ব আলমগীর একেবারেই চুপ হয়ে গেছেন। এমন নয়, তিনি বৈষম্যবিরোধী আন্দোলনের বিপক্ষে ছিলেন। আবার পক্ষেও ছিলেন বলা যাচ্ছে না। চলচ্চিত্রের এমন গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তি জাতির গুরুত্বপূর্ণ সময়েই নেই- এটা যেন তার নামের বিপরীতে একেবারেই বেমানান। চিত্রজগতের সিনিয়রদের অনেককেই জাতির এই গুরুত্বপূর্ণ সময়ে দেখা যায়নি। চুপ ছিলেন কণ্ঠশিল্পী রুনা লায়লাও; তাকেও দেখা যায়নি। অর্থাৎ সংস্কৃতি জগতে গুরুত্বপূর্ণ হলেও জাতির ইতিহাসে একটা গুরুত্বপূর্ণ পরিবর্তন আসছে সেটা তারা আগে থেকে হয়তো বুঝতে পারেননি। সেটা ধরতে পারলে নিশ্চয়ই ছাত্র আন্দোলনের পক্ষেই সাড়া দিতেন, কথা বলতেন। আবার ফ্যাসিস্ট সরকার টিকে যাবে কিনা- এ নিয়েও ছিলেন দ্বিধাদ্বন্দ্বে। যদি ফ্যাসিস্ট সরকার টিকে যেত তবে কি তার হয়ে কথা না বলার জন্য বা চুপ থাকার জন্যও কি তাদের এমন পরিস্থিতিতে পড়তে হতো না- যেমন এখন হচ্ছেন! কেমন নাজুক পরিস্থিতি গেছে এই সময়ে আলমগীরের জন্য! তবে নাগরিক আলমগীরের 'চুপ' থাকারও অধিকার আছে। এটাও স্বাধীনতা। কথা বলেননি, তাই তারা দেশ নিয়েও কোনো কথাও বলতে পারছেন না। এমনকি সাম্প্রতিক ভারতের ভূমিকার ব্যাপারেও। এর চেয়ে বড় ব্যর্থতা আর কীসে হতে পারে! নায়ক আলমগীর রুপালি পর্দায় বলিষ্ঠ হলেও বাস্তবে ঠিক তার বিপরীত, একেবারেই নাজুক। ঝুঁকি নিতে নারাজ। যেসব অভিনেতা মুক্তিযুদ্ধে গিয়েছিলেন তারাই সাহস করেননি! তবে কি নায়ক-নায়িকারা সিনিয়র হয়ে গেলেই সাহস হারিয়ে ফেলেন? ১৯৫০ সালের ৩ এপ্রিল আলমগীরের জন্ম হয়েছিল ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে। তার বাবার নাম আলহাজ কলিম উদ্দিন আহম্মেদ ওরফে দুদু মিয়া। তিনি বাংলাদেশের প্রথম সবাক চলচ্চিত্র 'মুখ ও মুখোশ'-এর অন্যতম একজন প্রযোজক ছিলেন। আলমগীরদের গ্রামের বাড়ি ব্রাহ্মণবাড়িয়ার নবীনগরে।