শুক্রবার, ২৫ এপ্রিল ২০২৫, ১২ বৈশাখ ১৪৩২
কনকচাঁপা

সঙ্গীতবাগানের সৌরভ

আমি বিগত সাতটি বছর বিভিন্নভাবে নিগৃহীত হয়েছি, তাতে মোটেই ভেঙে পরিনি। আমি সবর সময় হাসিখুশি থেকেছি। কখনো কাঁদিনি। কখনো হতাশ হইনি। যত সমস্যা এসেছে, কারো কাছে অভিযোগও করিনি। আমাকে সাত বছর বোবা করে রাখা হয়েছে- যা বর্ণনাতীত। আমি কোনো কিছু লিখতে পারতাম না। শুধু তাই নয়, আমি গান গাইতেও পারিনি। একজন শিল্পী যদি গান গাইতে না পারে, তার বোবা হয়ে যাওয়াই ভালো। কিন্তু আমি এতকিছুর পরও আশা হারাইনি।
মাতিয়ার রাফায়েল
  ২৮ নভেম্বর ২০২৪, ০০:০০
সঙ্গীতবাগানের সৌরভ
সঙ্গীতবাগানের সৌরভ

বাংলা সঙ্গীতাকাশের এক উজ্জ্বল নক্ষত্রের নাম রুমানা মোর্শেদ কনকচাঁপা। অসংখ্য গান গেয়ে মানুষের মন জয় করে আসছেন তিনি। বিটিভির ?'অন্তরঙ্গ' অনুষ্ঠানে 'এলোমেলো চুল আর ললাটের ভাঁজ' গান গাওয়ার মাধ্যমে ১৯৮২ সালে সঙ্গীতাঙ্গনে প্রবেশে শ্রোতানন্দিত কণ্ঠশিল্পী রোমানা মোর্শেদ কনকচাঁপার। এর চার বছর আগে নতুন কুঁড়ির সঙ্গীত পরিচালনার মাধ্যমে ১৯৭৮ সালে দেশীয় সঙ্গীতাঙ্গনে আত্মপ্রকাশ করেছিলেন মঈনুল ইসলাম খান।

দুজনের প্রথম পরিচয়টা ১৯৮২ সালের দিকেই। কনকচাঁপার প্রথম গানটির সুর করেছিলেন মঈনুল ইসলাম খান। সেখান থেকেই ভালোলাগা ও ১৯৮৪ সালের ৬ ডিসেম্বর, বিয়ের পিঁড়িতে বসা। সেই থেকে অবিরল আজও সেই দাম্পত্য জীবন অটুঁট। আমাদের দেশের শোবিজে বিয়ে বিচ্ছেদ মামুলি বিষয়। কিন্তু যাদের দাম্পত্য জীবন কাটে মসৃণতার সঙ্গে বছরের পর বছর সেই দাম্পত্যসঙ্গীর পরিচয়টাও উঠে আসে তার সঙ্গে। বিশেষ করে নারীর পরিচয়টাই যেন বেশি। এমন নারীকে নিয়ে কেউ ঘুণাক্ষরেও কোনো গসিপও তৈরি করতে পারে না।

একে তো দুজনেই একই অঙ্গনের মানুষ তার ওপর নিজের গানের প্রতিও যত্নটাও হয় ভালো তাই দুজনের সম্পর্কটাও হয় অনেক মধুর। তাই কনকচাঁপা বলেন, 'আমার জীবনে অনেক চমৎকার কিছু গানের পেছনে তার অবদান অনেক বেশি। তার গান গাওয়ার সময় আমাকে বেশ সতর্ক থাকতে হয়। স্বাভাবিক চোখে তার গানগুলো সহজ মনে হলেও গাওয়াটা অনেক কঠিন। আর গাওয়ার পর তার গানগুলো একেকটা মাস্টারপিস হয়ে ওঠে। আমি খুব ভাগ্যবান যে স্বামী হিসেবে মঈনুল ইসলাম খানের মতো একজন মানুষকে পাশে পেয়েছি।' মানুষের ভালো থাকার সেরা পরিচয় তো দাম্পত্যজীবনেই।

কিন্তু বাংলা সঙ্গীত কাননে সৌরভ ছড়ানো এই সুরভিত ফুল কনককাঁপা যখন জনপ্রিয়তার মধ্যগগণে বিরাজ করছেন, পেস্ন-ব্যাকে সাবিনা ইয়াসমিনের পরেই যার স্থান সেই কনকচাঁপাই হঠাৎ যেন নাই হয়ে গেলেন। কোনো নতুন গান আর শোনা যায় না কি অডিওতে, কি পেস্ন-ব্যাকে এমনকি স্টেজেও। এমন কি তার গাওয়া মৌলিক গান নতুন কণ্ঠশিল্পীদেরও গাইতে দেখা যায় না। পুরনো দিনের গান হিসেবে নতুন শিল্পীরা অনেকেরই গাওয়া গান গেয়ে থাকেন। কিন্তু কনকচাঁপার গান গাইতে দেখা যায় না তাদের। ফলে, শ্রোতারাও পুরনো দিনের গান হিসেবেও নতুনদের কণ্ঠে কনকচাঁপার গান শুনতে পেতেন না। ফ্যাসিস্ট হাসিনার রাজত্বে কী এমন 'পাপ' করলেন কনকচাঁপা যে, তার গাওয়া গানও গাইতে পারবে না নতুনরা?

এই কনকচাঁপার গুঁটিয়ে যাওয়া, এটা কি তার এমনি এমনিই, না চাপে পড়ে নিজেকে গুঁটিয়ে নেওয়া? কিন্তু শিল্পী হিসেবে তো বটেই, মানুষ হিসেবেও এমন ভালো শিল্পীকে মানসিক নির্যাতনের মধ্যে রেখেছে দীর্ঘ ষোলোটি বছর স্বৈরাচার শেখ হাসিনা সরকার।

গত ৫ আগস্ট ছিল বাংলাদেশের ৫৩ বছরের ইতিহাসে এক রাজকীয় ঐতিহাসিক দিন। দিনটিতে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের রক্তক্ষয়ী এক মহা সংগ্রামের ফলে পতন হয় স্বৈরাচার শেখ হাসিনা সরকারের। পদত্যাগ করে দেশ ছাড়েন ফ্যাসিস্ট শেখ হাসিনা। এরপর দেশে গঠিত হয় নতুন অন্তর্র্বর্তীকালীন সরকার। অতঃপর সেই ফ্যাসিস্ট হাসিনার সময়ে দেশসেরা শিল্পীদের কণ্ঠ দমিয়ে রাখা ও কালো তালিকায় রাখা মানুষ এখন মুখ খুলছেন একের পর এক। সেই তাদেরই একজন নন্দিত গায়িকা কনকচাঁপা।

সেই বিগত সময়ের কথা বলতে গিয়ে কনকচাঁপা বলেন, 'আমি বিগত সাতটি বছর বিভিন্নভাবে নিগৃহীত হয়েছি, তাতে মোটেই ভেঙে পরিনি। আমি সবর সময় হাসিখুশি থেকেছি। কখনো কাঁদিনি। কখনো হতাশ হইনি। যত সমস্যা এসেছে, কারো কাছে অভিযোগও করিনি। আমাকে সাত বছর বোবা করে রাখা হয়েছে- যা বর্ণনাতীত। আমি কোনো কিছু লিখতে পারতাম না। শুধু তাই নয়, আমি গান গাইতেও পারিনি। একজন শিল্পী যদি গান গাইতে না পারে, তার বোবা হয়ে যাওয়াই ভালো। কিন্তু আমি এতকিছুর পরও আশা হারাইনি।'

এক সময় পেস্ন-ব্যাকের সম্রাজ্ঞী কনকচাঁপা জানান, প্রায় অর্ধযুগেরও বেশি সময় ধরে তাকে গান গাওয়া থেকে বিরত রাখা হয়েছিল।

গত ৭ বছরে আমার কোনো গান বেতার কিংবা বিটিভিতে প্রচার হয়নি। শিল্পকলা একাডেমিতেও ডাকা হয়নি। নতুন শিল্পীদেরও গাইতে দেয়া হয়নি আমার কোনো গান। আর সরকারি অনুষ্ঠানে তো আমি বস্ন্যাক লিস্টেডই ছিলাম।

'কি জাদু করেছো বলো না', 'একবিন্দু ভালোবাসা দাও', 'ভালো আছি ভালো থেকো', 'তোমায় দেখলে মনে হয়', 'আকাশ ছুঁয়েছে মাটিকে', 'অনন্ত প্রেম তুমি দাও আমাকে', 'তুমি আমার এমনই একজন', 'অনেক সাধনার পরে আমি পেলাম তোমার মন', 'এই বুকে বইছে যমুনা', 'নীলাঞ্জনা নামে ডেকনা'- এমনি অসংখ্য জনপ্রিয় গানের নন্দিত কণ্ঠশিল্পী কনকচাঁপা। একেবারে ছোটবেলাতেই তার গানে হাতে খড়ি। রেডিওতে কলকাকলি অনুষ্ঠান দিয়ে গান গাওয়া শুরু। বাংলাদেশ টেলিভিশনের নতুন কুঁড়ি অনুষ্ঠানে ১৯৭৮ সালে পেয়েছিলেন জাতীয় পুরস্কার।

তিনবার জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কারপ্রাপ্ত এ কণ্ঠশিল্পী চলচ্চিত্রের গানে কণ্ঠ দিয়েই শ্রোতাদের মনে ঠাঁই করে নিয়েছেন। নিজেকে সব সময় একজন 'কণ্ঠশ্রমিক' হিসেবে পরিচয় দিতে স্বাচ্ছন্দ্যবোধ করেন সঙ্গীতের এই বিরল প্রতিভা কোকিলকণ্ঠি। আমাদের সঙ্গীত-বাগানে কনকচাঁপা যেন বৈচিত্র্যময় সৌরভ ছড়ানো এক ফুল। সঙ্গীতাকাশের উজ্জ্বলতম এক নক্ষত্র। গানের বাগানের এই শিল্পী যে শুধু গানেরই না, এ শিল্পী ছবিও আঁকেন। পাশাপাশি লেখক হিসেবেও কনকচাঁপার সুখ্যাতি রয়েছে। অমর একুশে বইমেলায় বইও প্রকাশিত হয়েছে কনকচাঁপার। বেশ কয়েকটি জাতীয় দৈনিকে নিয়মিত কলামও লেখেন তিনি।

নিজের সম্পর্কে কনকচাঁপা বলেন, 'কর্মহীন দীর্ঘজীবন আমার খুবই অপছন্দ। জীবনের শেষ দিন পর্যন্ত কর্মক্ষম থাকতে চাই, গানের সঙ্গে, সত্যের সঙ্গে, ভালো কাজের সঙ্গেও থাকতে চাই। জীবনের শেষ দিনটি পর্যন্ত যেন সুস্থ থাকতে পারি সৃষ্টিকর্তার কাছে এটাই প্রার্থনা।'

কনকচাঁপা দীর্ঘ ক্যারিয়ারে এ পর্যন্ত চলচ্চিত্রের তিন হাজারেরও বেশি গানে কণ্ঠ দিয়েছেন কনকচাঁপা। প্রকাশিত হয়েছে ৩৫টি একক গানের অ্যালবাম। কনকচাঁপা বিখ্যাত কণ্ঠশিল্পী বশীর আহমেদের ছাত্রী। দীর্ঘদিন তার কাছে উচ্চাঙ্গ, নজরুল সঙ্গীতসহ অন্যান্য ভারতীয় সঙ্গীতের তালিম নিয়েছেন। বর্তমানে পেস্ন-ব্যাক সিঙ্গার হিসেবে নিয়মিত কাজ করছেন তিনি। তার ৩৫টি একক গানের অ্যালবাম রয়েছে। চলচ্চিত্রের গান নিয়ে তার সর্বশেষ প্রকাশিত অ্যালবাম 'আবার এসেছি ফিরে'।

সঙ্গীতশিল্পীর বাইরে লেখক হিসেবেও তার সুখ্যাতি রয়েছে। ২০১০ সালের অমর একুশে বইমেলায় 'স্থবির যাযাবর', ২০১২ সালের বইমেলায় 'মুখোমুখি যোদ্ধা' ও ২০১৬ সালের বইমেলায় 'মেঘের ডানায় চড়ে' নামে তিনটি বই প্রকাশিত হয়েছে কনকচাঁপার।

তার জনপ্রিয় গানের মধ্যে অন্যতম হচ্ছে- অনেক সাধনার পরে আমি পেলাম তোমার মন, তোমাকে চাই শুধু তোমাকে চাই, ভালো আছি ভালো থেকো, যে প্রেম স্বর্গ থেকে এসে জীবনে অমর হয়ে রয় (খালিদ হাসান মিলুর সঙ্গে), আমার নাকেরই ফুল বলে রে তুমি যে আমার, তোমায় দেখলে মনে হয়, আকাশ ছুঁয়েছে মাটিকে, অনন্ত প্রেম তুমি দাও আমাকে, তুমি আমার এমনই একজন।

গানের জন্য রুমানা মোর্শেদ কনকচাঁপা জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কার ছাড়াও বাচসাস চলচ্চিত্র পুরস্কার, দর্শক ফোরাম পুরস্কার, প্রযোজক সমিতি পুরস্কারসহ অসংখ্য পুরস্কার-সম্মাননা পেয়েছেন।

'যে প্রেম স্বর্গ থেকে এসে/জীবনে অমর হয়ে রয়। সেই প্রেম আমাকে দিও, জেনে নিও/তুমি আমার প্রাণের চেয়ে প্রিয়।' মনের মানুষকে নিয়ে এটি কনকচাঁপার গাওয়া অন্যতম জনপ্রিয় একটি গান। বাংলার সঙ্গীতাঙ্গনে এই গানের মতোই সুরের যেই সৌরভ ছড়িয়ে দিয়েছেন কনকচাঁপা, তা বহুকাল সঙ্গীতপ্রেমীদের হৃদয়ে গেঁথে থাকবে। একইভাবে সুরের এই রাজকন্যা তার অনন্য কণ্ঠবীণায় আরও দীর্ঘ সময় আমাদের সঙ্গীত পিপাসুদের মন রাঙিয়ে যাবেন। সুরে-গানে আরও আলোকিত করবেন বাংলার সঙ্গীত ভুবন।

১৯৬৯ সালের ১১ সেপ্টেম্বর ঢাকার শান্তিবাগে জন্ম কনকচাঁপার। তার দাদার বাড়ি সিরাজগঞ্জের কাজীপুরে। তবে কনকচাঁপার জন্ম ও বেড়ে ওঠা ঢাকায়। তার বাবার নাম আজিজুল হক মোর্শেদ। পাঁচ ভাইবোনের মধ্যে কনকচাঁপা তৃতীয়। অসংখ্য জনপ্রিয় গান উপহার দিয়ে তিনি বাংলা গানের ভান্ডারকে সমৃদ্ধ করেছেন। চলচ্চিত্র, আধুনিক গান, নজরুল সঙ্গীত, লোকগীতিসহ সব ধরনের গানে কনকচাঁপা সমান পারদর্শী।

  • সর্বশেষ
  • জনপ্রিয়

উপরে