কাপুর পরিবারের সিনেমা সম্রাট পৃথ্বীরাজ কাপুর

প্রকাশ | ২১ নভেম্বর ২০২৪, ০০:০০

সালেহ ইমরান
পৃথ্বীরাজ কাপুর ছিলেন ভারতীয় থিয়েটার এবং হিন্দি সিনেমা শিল্পের অগ্রদূত। তিনি হিন্দি চলচ্চিত্রের নির্বাক যুগে অভিনয়ের মাধ্যমে তার কর্মজীবন শুরু করেছিলেন। এছাড়াও তিনি ভারতীয় গণনাট্য সংঘের প্রতিষ্ঠাতা সদস্য এবং ১৯৪৪ সালে মুম্বাই অঞ্চলের চলমান থিয়েটার কোম্পানি পৃথ্বী থিয়েটার প্রতিষ্ঠা করেছিলেন। পৃথ্বীরাজ কাপুরের জন্ম ৩ নভেম্বর, ১৯০৬ সালে ব্রিটিশ ভারতের পাঞ্জাবের লায়লপুর জেলা, সামুন্দ্রি তহসিলের সমুন্দ্রি, খত্রি পাঞ্জাবি হিন্দু পরিবারে জন্মগ্রহণ করেন। পৃথ্বীরাজ কাপুরের বাবা বাশশ্বরনাথ কাপুর পেশোয়ার শহরে ইন্ডিয়ান ইম্পেরিয়াল পুলিশে পুলিশ অফিসারের পদে দায়িত্ব পালন করেছিলেন। তিনি প্রথমে খালসা কলেজ লায়লপুরে পড়াশোনা করেন। পৃথ্বীরাজ কাপুর পরে অ্যাডওয়ার্ডস কলেজ পেশোয়ারে। যখন তার দাদা, কেশবমল কাপুর ছিলেন একজন শিলদার। বিখ্যাত বলিউড নির্মাতা ও অভিনেতা, নির্মাতা অনিল, বনি এবং সঞ্জয় কাপুরের বাবা সুরিন্দর কাপুর ছিলেন পৃথ্বীরাজ কাপুরের চাচাতো ভাই। কাপুর তার অভিনয় জীবন শুরু করেছিলেন লায়লপুর এবং পেশোয়ারের প্রেক্ষাগৃহে। ১৯২৮ সালে তিনি খালার কাছ থেকে ঋণ নিয়ে বোম্বে চলে আসেন। সেখানে তিনি ইম্পেরিয়াল ফিল্মস সংস্থায় যোগদান করেন এবং সিনেমাতে ছোটখাটো চরিত্রে অভিনয় শুরু করেন। ১৯২৮ সালে, তিনি তার প্রথম ছবি 'ধারি তালওয়ার হন' দিয়ে অতিরিক্ত (এক্সটা) হিসেবে অভিনয়ের সূচনা করেছিলেন। ১৯২৯ সালে মুক্তিপ্রাপ্ত সিনেমা গার্ল নামে তার তৃতীয় ছবিতে তিনি প্রধান চরিত্রে অভিনয় করেছিলেন। বি ধরি তালোয়ার, সিনেমা গার্ল, শের-ই-আরব এবং যুবরাজ বিজয়কুমার সহ নয়টি নীরব ছায়াছবিতে অভিনয় করার পরে, পৃথ্বীরাজ কাপুর ভারতের প্রথম চলচ্চিত্রের আলাপ আলম আরা এ সহায়ক ভূমিকা পালন করেছিলেন। বিদ্যাপতিতে তার অভিনয় বেশ প্রশংসিত হয়েছিল। তার সর্বাধিক পরিচিত অভিনয় সম্ভবত সোহরাব মোদির সিকান্দারে আলেকজান্ডার দ্য গ্রেট হিসেবে। এরপর তিনি গ্রান্ট অ্যান্ডারসন থিয়েটার কোম্পানিতে যোগ দিয়েছিলেন, একটি ইংরেজি নাট্য সংস্থা যা এক বছরের জন্য বোম্বেতে ছিল। এত বছর ধরে, কাপুর থিয়েটারের প্রতি অনুগত ছিলেন এবং নিয়মিত মঞ্চে অভিনয় করেছিলেন। তিনি মঞ্চ এবং পর্দা উভয়ই অভিনয়ে পারদর্শী ছিলেন। তার অভিনয় খুব সূক্ষ্ণ এবং বহুমাত্রিক অভিনেতা হিসেবে খ্যাতি অর্জন করেন। ১৯৪৪ সাল নাগাদ কাপুরের নিজস্ব থিয়েটার গ্রম্নপ পৃথ্বী থিয়েটারের উদ্বোধন করেন এবং যার প্রথম অভিনয় ছিল ১৯৪২ সালে কালিদাসের অভিজাকনকান্তম-এ অভিনয় করেন। ১৯৪৬ সাল নাগাদ তার বড় ছেলে রাজ কাপুর নিজেই অভিনয় করেছিলেন; তার প্রযোজিত চলচ্চিত্রগুলিতে সফলও হয়েছিল এবং এটি ছিল একটি সফল চলচ্চিত্র প্রতিষ্ঠান। পৃথ্বীরাজ কাপুর নিজ থিয়েটারে প্রচুর বিনিয়োগ করেছিলেন- যা ভারতজুড়ে স্মরণীয় প্রযোজনা প্রতিষ্ঠান হিসেবে সুনাম অর্জন করেছিল তৎকালীন সময়ে। এ প্রতিষ্ঠান প্রযোজিত নাটকগুলো ছিল অত্যন্ত প্রভাবশালী এবং তরুণদের ভারতীয় স্বাধীনতা আন্দোলন এবং ভারত ত্যাগ আন্দোলনে অংশ নিতে যথেষ্ট অনুপ্রাণিত করেছিল। প্রতিষ্ঠানের অস্তিত্বের ১৬ বছরেরও বেশি সময় ধরে প্রেক্ষাগৃহটিতে প্রায় ২,৬৬২টি প্রদর্শনী হয়- যাতে তিনি নিজে অভিনয় করেন। পৃথ্বীরাজ প্রতিটি শো'তে প্রধান চরিত্রে অভিনয় করেছিলেন। পৃথ্বীরাজ কাপুরের জনপ্রিয় একটি নাটকের নাম ছিল পাঠান একশ' চুরানব্বই- যা মুম্বাইয়ের মঞ্চে প্রায় ৬ হাজার বার পরিবেশিত হয়েছিল। এটি একটি মুসলিম এবং তার হিন্দু বন্ধুর গল্প। ১৯৫০-এর দশকের শেষের দিকে পৃথ্বীরাজ পুরোদমে চলচ্চিত্রে ফিরে আসেন। 'মোগল-এ-আজম' ছবিতে সম্রাট আকবরের চরিত্রে অভিনয় করে তিনি ব্যাপক জনপ্রিয়তা পান। এ ছবিটি ওই সময়ে সবচেয়ে বেশি আয় করা চলচ্চিত্রের মর্যাদা পায়। এছাড়া, পৃথ্বীরাজ 'হরিশচন্দ্র তরমতি', 'মহারথী কর্ণ', 'বিদ্যাপতি', 'আনন্দ মঠ'-এর মতো জনপ্রিয় ছবিতেও অভিনয় করেন। পৃথ্বীরাজ কাপুর ও অমিতাভ বচ্চনের বাবা লেখক হরিবংশ রায় বচ্চন ছিলেন ঘনিষ্ঠ বন্ধু। পৃথ্বীরাজ তার নাট্যদল নিয়ে এলাহাবাদে গেলে প্রায়ই লেখকের বাড়িতে যেতেন। পৃথ্বীরাজ ও হরিবংশ একই শহরে থাকলেই অভিনেতা প্রতিটি পারফরম্যান্সের পর লেখককে ডাকতেন কবিতা আবৃত্তি করার জন্য। পৃথ্বীরাজের তিন সন্তান রাজ, শাম্মী ও শশী কাপুর অভিনয়ে আসার পর তিনি চলচ্চিত্রে কাজ কমিয়ে দেন। হিন্দি সিনেমার অন্যতম প্রতিষ্ঠাতা পুরুষ হিসেবে বিবেচিত পৃথ্বীরাজ কাপুর ১৯৬৯ সালে পদ্মভূষণ ও ১৯৭১ সালে দাদাসাহেব ফালকে পুরস্কারে ভূষিত হন। ১৯৫২ থেকে ১৯৬০ সাল পর্যন্ত তিনি রাজ্যসভার সদস্য ছিলেন। পৃথ্বীরাজ কাপুর ১৯৭২ সালে ক্যানসারে আক্রান্ত হয়ে মারা যান। তার নাতি-নাতনি ও পরবর্তী প্রজন্মের অনেকেই আজ সফল অভিনেতা, যাদের মধ্যে রয়েছেন রণবীর কাপুর, কারিনা কাপুর ও কারিশমা কাপুর। তবে তাদের কেউই পৃথ্বীরাজ বা রাজ কাপুরের মতো ৫০টিরও বেশি হিট চলচ্চিত্র উপহার দেওয়ার রেকর্ড ভাঙতে পারেনি।