বৃহস্পতিবার, ২১ নভেম্বর ২০২৪, ৬ অগ্রহায়ণ ১৪৩১

ফারুকীর নতুন দিগন্ত

অনেকটা চমক দেখিয়ে অন্তর্বর্তী সরকারের উপদেষ্টা পরিষদে জায়গা করে নিয়েছেন নির্মাতা মোস্তফা সরয়ার ফারুকী। এতদিন ধরে বাংলাদেশের চলচ্চিত্রাঙ্গনে যারা নির্মাতা হিসেবে কাজ করে আসছেন এই ফারুকী তাদের থেকে একেবারেই ব্যতিক্রম। এবার সেই ধারা ছাপিয়ে নতুন পরিচয়ে পরিচিত হলেন সরকারের একটি গুরুত্বপূর্ণ মন্ত্রণালয়ের উপদেষ্টা হয়ে। যারা দীর্ঘ ১৬ বছরের অপশাসনের জিঞ্জির ভেঙেচুরে বাকস্বাধীনতা এনে দিয়েছেন ফেসবুকে স্ট্যাটাস দিয়ে- ফারুকী তাদের অন্যতম। যিনি বরাবরই ফ্যাসিবাদবিরোধী
মাতিয়ার রাফায়েল
  ২১ নভেম্বর ২০২৪, ০০:০০
ফারুকীর নতুন দিগন্ত

অনেকটা চমক দেখিয়ে অন্তর্বর্তী সরকারের উপদেষ্টা পরিষদে জায়গা করে নিয়েছেন নির্মাতা মোস্তফা সরয়ার ফারুকী। এতদিন ধরে বাংলাদেশের চলচ্চিত্রাঙ্গনে যারা নির্মাতা হিসেবে কাজ করে আসছেন এই ফারুকী তাদের থেকে একেবারেই ব্যতিক্রম।

এবার সেই ধারা ছাপিয়ে নতুন পরিচয়ে পরিচিত হলেন সরকারের একটি গুরুত্বপূর্ণ মন্ত্রণালয়ের উপদেষ্টা হয়ে। যারা দীর্ঘ ১৬ বছরের অপশাসনের জিঞ্জির ভেঙেচুরে বাকস্বাধীনতা এনে দিয়েছেন ফেসবুকে স্ট্যাটাস দিয়ে- ফারুকী তাদের অন্যতম।

নাটক-চলচ্চিত্রাঙ্গনের মানুষ হয়েও যারা পতিত অপশাসনের নির্লজ্জ পক্ষপাত করেছেন তাদের বিরুদ্ধেও ফারুকী কথা বলেছেন। স্বৈরাচার হাসিনা ও তার সরকার, তার দল- সবার বিরুদ্ধেই সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে হয়ে উঠেছেন অত্যন্ত ক্ষুরধার। বলা যায়, সরয়ার অত্যন্ত চাছাছোলা রূপেই সমালোচনা করেছেন বর্তমানে 'মাফিয়া লীগ' হিসেবে পরিচিত আওয়ামী লীগ ও দলটির প্রধান শেখ হাসিনার।

তারই কি পুরস্কার পেলেন তিনি অন্তর্বর্তী সরকারের নবনিযুক্ত উপেদেষ্টা হয়ে! এটা ঠিক, বাংলাদেশের সংস্কৃতি জগতের লোকগুলো বরাবরই সরকারের অপশাসন ও দুর্বৃত্তায়ন নিয়ে মৌন থাকেন অথবা দালালি করেন। শুরুতে ফারুকীকেও কমবেশী তাদের মধ্যে থাকতে দেখা গেলেও পরে ব্যতিক্রম হিসেবে জাতির ক্রান্তিলগ্নে ছাত্র-জনতার পাশে এসে দাঁড়িয়েছেন। দৈনিক যায়যায়দিনেও ফারুকীর এই নতুন রূপ, ছাত্র-মহাজনতার সপক্ষে দাঁড়ানো- শুরু থেকেই উপস্থাপন করে আসছে।

এটা করতে গিয়ে অবশ্য নিজের সঙ্গে নিজের কম বোঝাপড়াও করতে হয়নি। কেননা, সর্বপ্রথম ফারুকী তার ফেসবুক প্রোফাইলে ছাত্রদের পক্ষে যে স্ট্যাটাস দিয়েছিলেন পরে সেটা মুছে ফেলায় বেশ বিতর্কের মুখে পড়েন। এরপর তার সেই বিতর্কিত সত্তা বেরিয়ে সরাসরিই ছাত্র আন্দোলনের পক্ষ ধরেন। কিন্তু এ নিয়েও যারা বলেন, ছাত্র আন্দোলন বিজয়ের দ্বারপ্রান্তে এটা বুঝতে পেরেই তিনি ছাত্রদের পক্ষে ইতিবাচক সাড়া দেন নয়ত দিতেন না- এটা যদি সত্যও হয়, তারপরেও ফারুকীর ভেতরের সত্তা যে সরকার ও আওয়ামীবিরোধী ছিল এতেও কিন্তু সংশয় নেই। আর এই সংশয় না থাকার কারণেই তিনি বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের পক্ষে সাড়া দিয়েছিলেন।

কারণ আওয়ামী লীগ ও তার সেই সরকারের পক্ষে থাকলেও ভেতরে ভেতরে নিশ্চয়ই তাদের অপশাসন ও দুর্বৃত্তায়নের চিত্রগুলো কিন্তু ফারুকীর নজর এড়ায়নি। তবে যিনি প্রকৃত অনুভূতিশীল শিল্পী তার অন্তর্চক্ষু ঠিকই ধরে ফেলে কখন সেই অপশাসন দুমড়েমোচড়ে ফেলে দিতে প্রস্তুত কোন আন্দোলন। সেই আন্দোলনটিই ছিল এবারের বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন। ফারুকী এবারের ছাত্র আন্দোলনের ভেতরে সেই শক্তিটাই দেখতে পেয়েছেন বলে এক সময়ের অপশাসনের পক্ষ থেকে বেরিয়ে এসে তাদের পক্ষে কথা বলেছেন।

কিন্তু তার আগের এই আওয়ামী পক্ষ থাকা এবং বর্তমানে উপদেষ্টা হওয়া নিয়ে বিভিন্ন মহলে যে তীব্র সমালোচনা হচ্ছে তাদের এটা বুঝতে হবে বিশাল বাজেটের চলচ্চিত্রে একজন পরিচালককে কত রকমের সমস্যা মোকাবিলা করতে হয়।

চলচ্চিত্র কখনোই বিচ্ছিন্নভাবে করা যায় না। সেখানে সরকারেরও সাহায্য লাগে। এমন অবস্থায় কোনো চলচ্চিত্র নির্মাতার পক্ষেই সম্পূর্ণ সরকারবিরোধী হয়ে যাওয়া যায় না। বিচ্ছিন্নভাবে কাজ করতে পারেন লেখকরাই। কিন্তু বাংলাদেশে যেখানে সেই লেখক-কবি-সাহিত্যিক-বুদ্ধিজীবীরাই নিরেট মূর্খের মতো সরকারের অপশাসনের দালালি করেন সেখানে একজন চলচ্চিত্র নির্মাতা কতটুকু স্বাধীনভাবে কাজ করতে পারবেন?

কাজেই অন্তর্বর্তী সরকারের উপদেষ্টা থেকে বহিষ্কার করার কথা যে বলা হচ্ছে বৈষম্য ছাত্র আন্দোলন থেকে- ব্যাপারটি তাদের ভেবে দেখা উচিত। তিনি যে সংস্কৃতি বিষয়ক মন্ত্রণালয়ের দায়িত্ব পেয়েছেন আশা করা যায় তিনি যথাযথভাবে পালন করতে পারবেন। এর আগে এই মন্ত্রণালয়ের দায়িত্ব সামলেছেন বর্তমানে কারান্তরীণ বাংলাদেশের আরেক জনপ্রিয় অভিনয় শিল্পী আসাদুজ্জামান নূর। কিন্তু সবাইকে হতাশ করে দিয়ে তিনি আওয়ামী চরিত্র প্রদর্শন ছাড়া কোনো সফলতা দেখাতে পারেননি।

ফারুকী 'স্বাধীন চলচ্চিত্র' ধারার সিনেমা দিয়ে ঢাকাই সিনেমায় এক নতুন ডাইমেনশন দিয়েছেন। ২০০৪ সালে 'ব্যাচেলর' সিনেমা দিয়ে শুরু। যদিও মূলধারার চলচ্চিত্রের মানুষ তার চলচ্চিত্রকে চলচ্চিত্র হিসেবে মানতে নারাজ। তবে এই ধারাতেই সিনেমা বানিয়ে আজ তিনি অবিসংবাদিত পরিচালক।

কোটা আন্দোলনে নাটক-চলচ্চিত্রের একটা বড় অংশ একাত্মতা প্রকাশ করা ছিল এবারের আন্দোলনে এক বেনজির ইতিহাস। তাতে মাইল্ড স্ট্রোক করা মোস্তাফা সরয়ার ফারুকীও ছিলেন।

ফেসবুকে প্রতিনিয়ত বিভিন্ন স্ট্যাটাস দিয়ে শিক্ষার্থীদের পাশে দাঁড়িয়েছেন তিনি। এরপর ঐতিহাসিক বিজয়, শেখ হাসিনার পলায়ন, নতুন সরকার গঠন- সব মিলিয়ে যখন এক নতুন বাংলাদেশ মানুষের আশার সঞ্চার করছে- তখন পলাতক হাসিনা, পলাতক আওয়ামী লীগের পতিত মন্ত্রী, নেতাকর্মীরা, কবি-সাহিত্যিক-সাংবাদিকদের মধ্যে কোনো অনুশোচনা নেই- দেশ আবার অস্থিতিশীল করার ষড়যন্ত্রে লিপ্ত তারা। কিন্তু এখানেও মোস্তফা সরয়ার ফারুকী থেমে নেই। প্রায় প্রতিদিন পলাতক হাসিনা ও তার দোসরদের বিরুদ্ধে ফারুকীর লেখা সচল থেকেছে। কোনো আওয়ামী দোসরের পক্ষে এভাবে নিরন্তর আওয়ামী স্বৈরাচারবিরোধী লেখা সম্ভব না। টুকটাক কিছু কেউ লিখতে পারেন তবে নিরন্তর এমন করে কারো পক্ষে লেখা সম্ভব না। অন্তরের ভেতরে জ্বালা, দাহ থাকলেই সম্ভব। কোটা আন্দোলন থেকে শুরু করে বর্তমান সময় পর্যন্ত যা লিখেছেন তা অন্তরের সেই জ্বালা, দাহ থেকেই তিনি লিখেছেন। তার প্রতিটা লেখাই সেই অন্তরের জ্বালা, দাহরই প্রতিফলন ঘটেছে।

যেমন ধরা যাক, আন্দোলনের সময়ে লিখেছেন, 'কোটা তো মেনে নিয়েছে। এখন কিসের আন্দোলন? এই প্রশ্নটা যারা করছে তাদের বলি, আমি যদ্দুর বুঝতে পারছি আর কি! এই আন্দোলনটা তাচ্ছিল্য এবং বল প্রয়োগ করে থামাতে যেয়ে সরকার প্যান্ডোরার বাক্স খুলে দিয়েছে।

যে বাক্সে জমা ছিল অনেক প্রশ্ন, অনেক আগে থেকেই। এই প্রজন্ম সেই প্রশ্নগুলোকে সামনে নিয়ে এসেছে। তার মধ্যে একটা বড় প্রশ্ন, নাগরিকের সঙ্গে সরকারের সম্পর্ক কি হবে? প্রভু-দাসের নাকি সেবক-মালিকের?

একদিনে এতজন দাস মেরে ফেললে তো দাস বিদ্রোহ হয়ে যেত? স্বাধীন দেশের মালিক জনগণকে নিরাপত্তা দেওয়ার জন্য যে পাবলিক সার্ভেন্টদের নিয়োগ দেওয়া হলো, তারা আমাদের এত মানুষকে মেরে ফেলল?

যারা এত খুনের সঙ্গে জড়িত, হুকুমের আসামি তাদের শাস্তি হবে কবে? একদিকে, আলোচনা আর অন্যদিকে, গ্রেপ্তার-গুলি এটা কোন খেলা? এটা কখন বন্ধ হবে?

এরপর ফারুকী লেখেন, সরকারে যারা ক্ষমতায় থাকে তারা জনগণের সঙ্গে দম্ভ আর অহমিকা নিয়ে অপমান করে কথা বলবে? নাকি রেসপেক্ট নিয়ে কথা বলবে?

ফারুকীর কথায়, 'জনগণ সরকারকে ব্যঙ্গ করবে, অপমান করবে, তীব্র সমালোচনায় ছিলে ফেলবে। শিল্পী স্বাধীনভাবে গান বানাবে, ফিল্ম বানাবে, কারো মেপে দেয়া স্বাধীনতা নিয়ে তাকে চলতে হবে না। এসবই গণতন্ত্রের অংশ।'

তবে এটা ঠিক ফারুকী একপর্যায়ে বুঝে গিয়েছিলেন এই আন্দোলন ব্যর্থ হওয়ার নয়। তাইতো ফারুকী একপর্যায়ে ফারুকীর পোস্ট ছিল, 'স্বাধীনতা থেকে অল্প একটু দূরে দাঁড়িয়ে আমরা।'

তবে ব্যর্থ হলে কিন্তু ইতিহাসের সব স্বৈরশাসকদের মতোই দমন-পীড়নের মুখে পড়তে হতো মোস্তফা সরয়ার ফারুকীকে। 'বাঘে ধরলে বাঘে ছাড়ে শেখ হাসিনা ধরলে ছাড়ে না'- এই ভয়াবহ নৃশংসতম ফ্যাসিস্ট মহিলা এমন যে, এক সময়ে সরকারের পক্ষে ছিলেন বলে ফারুকীকেও ছেড়ে দিতেন না। শিল্পী, নির্মাতা- এই অজুহাতেও। আর যারা ছিলেন ছাত্র সমন্ব্বয়কের দায়িত্বে তাদের কথা তো বলাই বাহুল্য। আরও নামে, বেনামে অসংখ্য মানুষকে। খুন, গুম, ফাঁসি, আয়নাঘর- আরও কত কী হতো! এ নিয়ে চিন্তা করতে গেলেই গা শিউরে উঠে!

কিন্তু ফারুকী সেই পতিত ফ্যাস্টিটকে সমর্থন করেছেন বলে যে অভিযোগ উঠছে তার জবাবে তিনি বলেন, 'আমি ফ্যাসিস্টদের সমর্থন করি, এটা বলা অবিশ্বাস্য। এর জবাব দেওয়ার দরকার নেই। আমার লেখাগুলো পড়ুন।'

ফারুকী নিজের লেখা ২০১৪ সালের একটি নিবন্ধের প্রসঙ্গ টেনে সেই নিবন্ধ পড়ার অনুরোধ জানান।

'এই চেতনা নিয়ে আমরা কী করব? ২০১৪ সালে যেদিন শাহবাগে ফ্যাসিবাদ শুরু হয়েছিল, সেদিন লিখেছিলাম,' বলেন ফারুকী। এই কথা তিনি সেই সময়ে বলেছিলেন যখন শাহবাগে যুদ্ধাপরাধী সবাইকে ফাঁসি দেওয়ার জন্য টালমাটাল আন্দোলন চলছিল। যখন আন্তর্জাতিক ট্রাইবু্যনাল কাদের মোলস্নাকে যাবজ্জীবন রায় দেয় তারপরও এই সুদুর প্রাচীন, আদিম বর্বর শাহবাগীরা নিজেরাই প্রধান বিচারপতি হয়ে তাকে দেওয়া সেই রায় বদলে অনৈতিক ফাঁসি'র দাবি তোলে। আর এই বর্বরদের শাহবাগে নামিয়ে দেয় '৭১ পুঞ্জীভূত চেতনার আদিম বর্বর স্বৈরাচার শেখ হাসিনাই মূলত। এই স্বৈরাচারটাই আন্দোলনের পশ্চাদদেশে হাওয়া দিয়ে ফুলিয়ে ফাঁপিয়ে স্ফীত করে তোলেন।

এটা এমন সময়, যে সময়ে কোনো কথা প্রকাশ্যে বললে নূ্যনতমও যদি সেটা জামায়াতের পক্ষে যায়- সে কথা প্রকাশ্যে বলতে কেউই সাহস পেত না। তখন তাকে রাজাকার বলা হতো। কিন্তু সেই কোণঠাসা সময়ে জামায়াতের পক্ষে যায় এমন কথা বলেছিলেন ফারুকী। তিনিও পেয়েছিলেন রাজাকারের ট্যাগ। তখন তার নির্মাতা হিসেবে ক্যারিয়ারের শুরু। এটাই তো প্রকৃত বুদ্ধিজীবীর অবস্থান। কেউ যখন কথা বলতে না পারে, প্রকৃত বুদ্ধিজীবীরাই তখন কথা বলে।

কাজেই বর্তমানকে গুরুত্ব দিয়ে এবং অতীতের ইতিহাস না টেনে ফারুকীকেও এই বৈষম্যবিরোধী আন্দোলনকারীদের ঘরেরই সন্তান ভাবলে ক্ষতি কী?

  • সর্বশেষ
  • জনপ্রিয়

উপরে