বাংলাদেশের চলচ্চিত্রাঙ্গনে যারা পরিচালক হিসেবে কাজ করছেন তাদের মধ্যে মোস্তাফা সরয়ার ফারুকী একদম ব্যতিক্রম। 'স্বাধীন চলচ্চিত্র' ধারার সিনেমা দিয়ে ঢাকাই সিনেমায় এক নতুন ডাইমেনশন দিয়েছেন। ২০০৪ সালে 'ব্যাচেলর' সিনেমা দিয়ে তার অভিষেক হয় বাংলাদেশের চলচ্চিত্রে। যদিও মুলধারার চলচ্চিত্রের মানুষ তার এই চলচ্চিত্রকে চলচ্চিত্র হিসেবে মানতে নারাজ ছিলেন। কিন্তু ধীরে ধীরে এই ধারাতেই সিনেমা বানিয়ে আজ বাংলাদেশের চলচ্চিত্রাঙ্গনে অবিসংবাদিত পরিচালক। 'মেড ইন বাংলাদেশ', 'থার্ড পারসন সিঙ্গুলার নাম্বার', 'টেলিভিশন', 'পিঁপড়াবিদ্যা' প্রভৃতি সিনেমা আন্তর্জাতিক অঙ্গনে পেয়েছে প্রশংসা।
তবে এবার আরেক পরিচয়ে তিনি নিজেকে নিয়ে গেছেন অন্যরকম উচ্চতায়। সেটাও উপলব্ধির। এই উপলব্ধি আগাম দেখা ও বোঝার বিষয়। এই উপলব্ধি সবার হয় না।
সেটা ঢাকার ছাত্রদের কোটাবিরোধী আন্দোলনে কী বুঝে তার নিরবচ্ছিন্ন সমর্থন দেওয়া। সমর্থন দিয়েছেন এই উপলব্ধিতে যে, তারা এই আন্দোলনে চূড়ান্ত ফল বের করে আনবেই। ফলে, ফেসবুকে স্ট্যাটাস দেওয়াসহ রাজপথেও নেমেছেন তিনি। শেষ পর্যন্ত তিনি বিগত স্বৈরাচারী হাসিনা, এ যুগের ক্লিওপেট্রার একনায়কতন্ত্র অবসানের লক্ষ্যে এক দফা দাবিতেও শামিল হন। ঢাকাই চলচ্চিত্রাঙ্গনে অতীতে সরকারবিরোধী আন্দোলনে চলচ্চিত্রের মানুষকে নামতে দেখা না গেলেও এবার প্রথমবারের মতো মামুনুর রশীদ, মোস্তাফা সরয়ার ফারুকী, আজমেরী হক বাঁধন, অমিতাভ রেজা চৌধুরী প্রমুখ আন্দোলনের জন্য মাঠে নেমেছেন। এটা ঢাকাই চলচ্চিত্রে এক বেনজির ইতিহাস। মোস্তাফা সরয়ার ফারুকী যেমন এরকমই। চলিচ্চত্রেও বেনজির ধারা প্রবর্তন করেছেন আবার সরকারের বৈষম্যবিরোধী আন্দোলনেও মাঠে নেমেছেন। ব্যবসায়ীদের উদ্বুদ্ধ করেছেন আহত ছাত্র-জনতাকে সহায়তা করতে।
ফারুকী এমন যে, কোটা সংস্কার আন্দোলন নিয়ে দেশজুড়ে উদ্ভূত পরিস্থিতিতে শুরু থেকেই শিক্ষার্থীদের পক্ষে সরব ছিলেন। ফেসবুকে প্রতিনিয়ত বিভিন্ন স্ট্যাটাস দিয়ে শিক্ষার্থীদের পাশে দাঁড়িয়েছেন তিনি।
৩১ জুলাই গণ-অভু্যত্থানের একটি পোস্টার ছবি পোস্ট করেছেন। এর ক্যাপশনে তিনি 'আওয়াজ ওডা, বাংলাদেশ' শিরোনামের গানের গায়ককে-গ্রেপ্তার করার প্রতিবাদে নিজের অবস্থান জানান দিয়েছেন। এর আগে রাতে শিক্ষার্থীদের আন্দোলন নিয়ে যারা প্রশ্ন তুলছেন তাদের বুঝিয়ে দিতেই ফারুকী আরও একটি স্ট্যাটাস দিয়েছেন।
এতে তিনি লিখেছেন, কোটা তো মেনে নিয়েছে। এখন কিসের আন্দোলন? এই প্রশ্ন যাদের মনে আসছে তাদের জন্য একটু বুঝায়ে বলি, আমি যদ্দুর বুঝতে পারছি আর কী! শুরুতেই নির্মাতা উলেস্নখ করেন, এই আন্দোলনটা তাচ্ছিল্য এবং বল প্রয়োগ করে থামাতে যেয়ে সরকার প্যান্ডোরার বাক্স খুলে দিয়েছে।
যে বাক্সে জমা ছিল অনেক প্রশ্ন, অনেক আগে থেকেই। এই প্রজন্ম সেই প্রশ্নগুলোকে সামনে নিয়ে এসেছে। তার মধ্যে একটা বড় প্রশ্ন, নাগরিকের সঙ্গে সরকারের সম্পর্ক কি হবে? প্রভু-দাসের নাকি সেবক-মালিকের?
একদিনে এতজন দাস মেরে ফেললে তো দাস বিদ্রোহ হয়ে যেত? স্বাধীন দেশে দেশের মালিক জনগণকে নিরাপত্তা দেওয়ার জন্য যে পাবলিক সারভেন্টদের নিয়োগ দেওয়া হলো, তারা আমাদের এতগুলো মানুষকে মেরে ফেলল?
যারা এতগুলো খুনের সঙ্গে জড়িত, হুকুমের আসামি তাদের শাস্তি হবে কবে? একদিকে আলোচনা আর অন্যদিকে, গ্রেপ্তার-গুলি এটা কোন খেলা? এটা কখন বন্ধ হবে?
এরপর ফারুকী লেখেন, প্রশ্ন আরো উঠেছে, সরকারে যারা ক্ষমতায় থাকে তারা জনগণের সঙ্গে দম্ভ আর অহমিকা নিয়ে অপমান করে কথা বলবে? নাকি রেসপেক্ট নিয়ে কথা বলবে?
ফারুকীর কথায়, জনগণ সরকারকে ব্যঙ্গ করবে, অপমান করবে, তীব্র সমালোচনায় ছিলে ফেলবে। শিল্পী স্বাধীনভাবে গান বানাবে, ফিল্ম বানাবে, কারো মেপে দেয়া স্বাধীনতা নিয়ে তাকে চলতে হবে না। এসবই গণতন্ত্রের অংশ।
সরকারে যেই থাকুক তাকে বিনয়ের সঙ্গে এগুলো গ্রহণ করতে হবে, এটাই গণতান্ত্রিক সমাজের রীতি। সরকার কি আদৌ এই রীতি মানার জন্য মানসিকভাবে তৈরি? নাকি সরকার বুলেট-ধমক-গ্রেপ্তারের ভাষায় কথা বলবে?
শেষে আরেকটা উপলব্ধির কথা বলি, এই আন্দোলনের চরিত্র যারা এখনো বুঝতে পারেননি, তাদের উদ্দেশে বলি, এই আন্দোলনে কারা আছে তাদের পরিচয় দেখেন। হিন্দু-মুসলমান-বৌদ্ধ-খ্রিস্টান, ইংলিশ মিডিয়াম-বাংলা মিডিয়াম-আরবি বিভাগ সব এসে এক কাতারে হাজির। এদের দাবি 'ন্যায়বিচার আর মর্যাদা'! কার রাজনৈতিক বিশ্বাস কি সেটা বিবেচনায় নিয়ে এরা আন্দোলনে নামেনি। ফলে, ওইসব পুরোনো দিনের বাইনারি দিয়ে এদের ভাগ করতে পারবেন না, এদের বুঝতে পারবেন না।
ফারুকীর কথায়, আপাতত এতটুকু বলতে পারি, এই আন্দোলন কোনো ছেলে ভোলানো ছড়া বা নাটক দিয়ে থামানো যাবে না। এই প্রশ্নগুলোর উত্তর নিয়েই এই আন্দোলন থামবে।
গণতান্ত্রিক সমাজ তৈরির ক্ষেত্র তৈরি না করে ব্যারাকে ফিরে গেলে আমাদের আরেকটা ব্যর্থ বিপস্নবের মোয়া হাতে নিয়েই ঘুমাতে হবে। তবে আমার বিশ্বাস এই আন্দোলন আমাদের একটা স্বাধীন এবং গণতান্ত্রিক সমাজে উত্তরণের রাস্তা দেখাবে। কেন এই বিশ্বাস? কারণ মানুষের এত স্বতঃস্ফূর্ত আবেগ এর আগে আমি দেখিনি।
সবশেষ একটা উদাহরণ টেনে ফারুকী বলেন, একটা উদাহরণ দেই- এক ছাত্রকে আটকের পর কোর্টে হাজির করা হইছে। পেছন পেছন তার মা দৌড়ে এসে ছেলের পাশে দাঁড়ায়ে ছেলের বুকে সজোরে থাম্প দিয়ে বলে, 'টেনশন করিস না'!
এই যে কথাগুলো বলেছিলেন ফারুকী, তাতেই বোঝা যায় ফারুকী সর্বান্তকরণ থেকেই বুঝে গিয়েছিলেন এই আন্দোলন কিছুতেই ব্যর্থ হওয়ার নয়। ঠিক ওই ছাত্রের মায়ের মতো, যে তার ছেলেকে বলছে, 'টেনশন করিস না'। ওই মাও নিশ্চিত, তাদের বিজয় হবেই।
আর যেসব টিভি-চলচ্চিত্র ও গানের তারকারা সরকারের বিরামহীন খুন, গুম, গুলির পক্ষে দাঁড়িয়ে বিটিভি ভবনে গলা ছেড়ে তাদেরই বিজয়েরই কথা বলেন, আর ছাত্রদের ঘরে ফিরে যেতে পরামর্শ দেন, তারা ভুলে গিয়েছেন যে, তাদের পাশে আছে বাংলার অমিততেজী জনতা, যে জনতা তাদের আন্দোলনকে বিজয়ী করার শক্তি, যে জনতা আরও একবার বিজয় এনে দিয়েছেন '৭১ এ। নির্বোধরা আন্দোলনের গতিপথই উপলব্ধি করতে পারেনি। যারা এসব আগাম বুঝতেই পারে না, তারা কিসের শিল্পী। শিল্পীরা তো সমাজের সবচে বেশি সংবেদনশীল হয়। যে সংবেদনশীলতা দিয়ে অনেক কঠিন ব্যাপারও আগাম বুঝে ফেলতে পারে। হৃদয়ঙ্গম করতে পারে। কিন্তু তা তারা অনুধাবন করতে পারেনি। তার মানে তারা কোনো যথার্থ শিল্পীই নয়। যে কারণে তারা সেই উচ্চতার সংবেদনশীন নয়। তারা বড় জোর অভিনেতা-অভিনেত্রী, কিন্তু শিল্পী নয়।
মোস্তাফা সরয়ার ফারুকীর রাজপথের আন্দোলনের পরিণতি বুঝতে পারার আগাম ক্ষমতা, এই ক্ষমতা আছে বলেই চলচ্চিত্র নির্মাণেও বুঝতে পারেন, কোনটাতে কী করতে যাচ্ছেন। বোঝাই যায়, ওই আন্দোলন ব্যর্থ হলে ইতিহাসের সব স্বৈরশাসকদের মতো কীরকম দমন-পীড়নের পড়তে হতো মোস্তাফা সরয়ার ফারুকীকে। তবে তিনি বুঝে ফেলেছিলেন হাসিনাই ব্যর্থ হবে কিন্তু এই আন্দোলন ব্যর্থ হওয়ার নয়। এই উপলব্ধি হয়েছিল বলেই এরপর হাসিনার পদত্যাগের দাবিতে হওয়া আন্দোলনকে সমর্থন জানিয়ে ফারুকীর পোস্ট ছিল, 'স্বাধীনতা থেকে অল্প একটু দূরে দাঁড়িয়ে আমরা।'
আর কী অবাক কান্ড এই স্ট্যাটাস দেওয়ার এক দিন পার না হতেই ফারুকীর এই পোস্টের কথাই সত্যি হয়। তার উপলব্ধি বাস্তব হয়। ছাত্র-জনতার অসহযোগ আন্দোলনের মুখে পদত্যাগ করে ভারতে পালিয়ে যান সাবেক স্বৈরাচার শেখ হাসিনা। গঠিত হয় অন্তর্র্বর্তীকালীন সরকার। যার প্রধান করা হয়েছে নোবেলজয়ী অর্থনীতিবিদ ড. মুহাম্মদ ইউনূসকে।
আর এসব বোঝার উপলব্ধি না হওয়াতেই বিগত স্বৈরাচারী সরকারের দোসর, টিভি-চলচ্চিত্র অভিনেতা-অভিনেত্রী, নির্মাতা, পরিচালক, সেন্সর বোর্ডের মূর্খ সদস্যরা বুঝতে পারেনি 'শনিবারের বিকেল' আসলে কী বলতে চায়।