একটা সময় ছিল যখন গানের শিল্পীরা তার গানের বাজার তৈরি করে দিতে অডিও বাজারে ঘোরাঘুরি করতেন। অনেক কষ্ট হতো নিজের গলা নিয়ে সেই গানের বাজারে পরীক্ষা দিতে গিয়ে। কত শিল্পীকেই না তখন ব্যর্থ হয়ে ফিরে আসতে হয়েছে সেই গানের বাজার থেকে। যেখানে তার গলাকে 'পণ্য' হিসেবে ব্যবহার করতে ব্যর্থ হয়েছেন। মনোকষ্টে কত শিল্পীই না অবশেষে গানই ছেড়ে দিয়েছেন। মাঝেমধ্যে বন্ধুদের আসরে টুকটাক গান গাওয়া ছাড়া। সেই দিনগুলো সেই কবেই হয়ে গেছে অতীত।
ক্যাসেট, সিডির যুগ অবসানের পর এখন অনলাইন ভিডিও শেয়ারিং পস্ন্যাটফর্ম সময়ের অন্যতম প্রধান মাধ্যম ইউটিউবকে বেছে নিয়েছেন শিল্পীরা। যা প্রকাশের পরই ছড়িয়ে যায় বিশ্বজুড়ে। বিশ্বজুড়ে যেখানেই বাংলা ভাষাভাষী আছেন শুনছেন তাদের গান। ফলে এই পস্ন্যাটফর্মে যে গানের ভিউ বেশি হয় সে গানকেই জনপ্রিয় হিসেবে বিবেচনা করা হয়। এক্ষেত্রে এমন গানচিত্রও আছে- যা ৫০ মিলিয়ন ভিউ অতিক্রম করেছে। অর্থাৎ ৫ কোটি দর্শক-শ্রোতারা গানটির ভিডিও দেখেছেন এবং শুনেছেন। আর এই রেকর্ডটি করেছেন হালের জনপ্রিয় সঙ্গীতশিল্পী ২০০৮ সালে চ্যানেল আই সেরাকণ্ঠের মঞ্চ থেকে ওঠে আসা ইমরান মাহমুদুল। সময়ের পরিক্রমায় যিনি এখন মিউজিক ভিডিওর একচ্ছত্র শিল্পী হয়ে উঠেছেন।
গানটি ইমরান তার নিজস্ব ইউটিউব চ্যানেলে ২০১৫ সালে ৫ এপ্রিল তার গাওয়া 'বলতে বলতে চলতে চলতে' গানটির ভিডিও প্রকাশিত হয়। আরেক সঙ্গীতশিল্পী শফিক তুহিনের কথায় গানটির সুর ও সংগীত করেছেন শিল্পী ইমরান নিজেই। গানটির ভিডিও চিত্র নির্মাণ করেছেন আশিকুর রহমান। মডেল ছিলেন ছোটপর্দার তানজিন তিশা।
এভাবেই হালে পুরুষ বিভাগের গানে যেন প্রায় একতরফাই হয়ে উঠেছেন ইমরান মাহমুদুল। বর্তমানে তিনি বাংলাদেশের সুপারস্টার গায়ক। ২০১১ সালে 'স্বপ্নলোকে' নামক একক অ্যালবাম দিয়ে তার একক মৌলিক গান গাওয়া শুরু করেন। ২০১তে 'তুমি' এবং ২০১৫তে 'বলতে বলতে চলতে চলতে', ২০১৬তে 'মন করিও' ও 'বাহুডোরে' নামক আরো চারটি একক অ্যালবামে নিজের মৌলিক গান প্রকাশ করেন। চ্যানেল আই 'সেরাকণ্ঠ' থেকে উঠে আসা এ শিল্পী এরপর থেকেই আস্তে আস্তে গীতিকার, সুরকার ও সঙ্গীত পরিচালক হিসেবে আত্মপ্রকাশ করে বাংলাদেশি সঙ্গীতাঙ্গনে নিজের অবস্থানকে সুসংহত করে তোলেন। গান ছাড়াও তিনি তার ফেসবুক, ইন্সট্রাগ্রাম ও ইউটিউব চ্যানেলের মাধ্যমে আয় করেন। সেইসঙ্গে স্টেজ পারফর্মেন্স করেও তিনি যথেষ্ট ভালো আয় করেন।
এরই মধ্যে তিনি চলে গেছেন বাংলাদেশ পেরিয়ে সীমানার ওপারেও। প্রকাশ পেয়েছে সেখান থেকে তার রোমান্টিক গানের মিউজিক ভিডিও 'তুমি কেমন করে'। যখন থেকে গানের ভুবনটি শাসন করতে শুরু করেছে মিউজিক ভিডিও, গানের সুরও বদলে যেতে থাকে মিউজিক ভিডিওর নাচ ও অভিনয়ের মাপে মাপে- সেই সময়ের গানের শিল্পী ইমরান। মিউজিক ভিডিওকে তিনি যেন প্রায় নিজের করে নিয়েছেন। এভাবেই তিনি এখন গানচিত্রের অন্যতম প্রধান শিল্পী হয়ে উঠেছেন।
মিউজিক ভিডিও আসার কারণে আগের প্রজন্মের শিল্পীরা গেলেন পিছিয়ে। অনিচ্ছা সত্ত্বেও তাদের যারা গানচিত্র বানাচ্ছেন যুগোপযোগী বিনোদনটা দিতে পারছেন না। সেখানে ইমরান নিজেকে যেন মানানসই করে নিলেন। খ্যাত হলেন মিউজিক ভিডিওর বিশিষ্ট রূপকার হিসেবে।
এ পর্যন্ত বহু মিউজিক ভিডিও প্রকাশ পেয়েছে ইমরানের। এক সময় এসব মিউজিক ভিডিওতে মডেল হিসেবে পারফর্ম করতেন অচেনা সব মডেলরা। একপর্যায়ে এটা জনপ্রিয় হতে থাকলে সেই মিউজিক ভিডিওতে মডেল হিসেবে পারফর্ম করতে এগিয়ে আসেন টিভি ও চলচ্চিত্র অভিনেত্রীরাও। এর মধ্যে একটিতে ইমরানের সঙ্গে পারফর্ম করেছেন টিভি অভিনেত্রী সাবিলা নূর। যেটি ছিল মডেল হিসেবে সাবিলা নূরের প্রথমবারের মতো মিউজিক ভিডিওতে পারফর্ম করা। সঙ্গীতশিল্পী ইমরান মাহমুদুলের সুর ও সঙ্গীতে 'তুমি আমি' টাইটেলের এই গানচিত্রে সাবিলার বিপরীতে অভিনয় করেছেন গায়ক নিজেই।
এ ছাড়া ইমরানের অন্যান্য জনপ্রিয় মিউজিক ভিডিওর মধ্যে আছে- 'ভালোবাসা', 'বলেছে মন', 'কে রাখে আমারে', 'প্রেম', 'ভাগ্যবান', 'দূরত্ব', 'দিল দিল', 'বাহুডোরে', 'মানেনা মন', 'দূরে দূরে', 'সখী ভালোবাসা কারে কয়' প্রভৃতি।
মিউজিক ভিডিওর প্রভাব পড়ছে এখন পেস্ন-ব্যাকেও। যে কারণে বদলে গেছে পেস্ন-ব্যাকের ধারাও। যারা মিউজিক ভিডিওতে সুনাম কুড়িয়েছেন তারাই ডাক পাচ্ছেন পেস্ন-ব্যাকে। সেদিক থেকে পেস্ন-ব্যাকও প্রায় একচেটিয়া করে নিয়েছেন ইমরান। বরেণ্য শিল্পী সাবিনা ইয়াসমিনের সঙ্গে 'ভালোবাসার লাল গোলাপ' নামক সিনেমায় পেস্ন-ব্যাক করার মাধ্যমে তিনি তার ক্যারিয়ারের সূচনা করেন। এরপর তার সঙ্গে জুটি হিসেবে আসছেন কখনো কোনাল, কখনো কনা, কখনো বা কর্ণিয়া। এছাড়া আরও অনেকে। জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কারও অর্জন করেছেন একাধিকবার। পেস্ন-ব্যাক তো করছেনই সেইসঙ্গে সুর ও সঙ্গীত পরিচালনায়ও ডাক পাচ্ছেন তিনি। একে একে এত সাফল্য এখন যেন তিনি গানের জগতে কেবলই উড়ছেনই।
পা যেন মাটিতেই পড়তে চাচ্ছে না তার!
এখন ঢাকাই সিনেমার পেস্ন-ব্যাকে প্রায় একচেটিয়া কারবার ইমরানের। এরই মধ্যে প্রথমবারের মতো 'বিশ্ব সুন্দরী' সিনেমায় 'তুই কি আমার হবি রে' গানের জন্য জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কার লাভ করেছেন তিনি। যদিও গান ভাইরাল গানের মতোই ইতোমধ্যেই আবার প্রায় হারিয়ে গেছে। গানটির জন্য ইমরান সুরকার এবং গায়ক একসঙ্গে দুটি বিভাগেই সেরা হওয়ার কৃতিত্ব অর্জন করেছেন। তবে এরকম ভাইরাল উপযোগী গান দিয়ে নিজের অর্জনগুলো কতটা দৃঢ়তার সঙ্গে ধরে রাখতে পারবেন সেটা অবশ্য সময়ই বলে দেবে। কিন্তু বর্তমানে এটা অস্বীকার করার উপায় নেই গানচিত্র উপযোগী গানে এগিয়ে আছেন ইমরানই।