কী এক উত্তেজনাতেই না আগের দিনই ঠিক করে রেখেছিলেন পর দিনই তার ফেরার প্রস্তুতি শুরু করবেন। তার আগে এই পর্দায় ফেরার ঘোষণাটি দিয়েছিলেন গত বছরের শেষের দিকে। ঘোষণায় আরও জানিয়েছিলেন 'রঙ্গনা' নামের একটি সিনেমায় চুক্তিবদ্ধ হয়েছেন তিনি। এরপর হলো সিনেমাটির মহরত অনুষ্ঠান। আর এই মহরত অনুষ্ঠানেই কিনা জানিয়ে দিলেন তার আরও একটি নতুন সিনেমায় চুক্তিবদ্ধ হওয়ার ঘোষণা। সিনেমাটির নাম 'এখনো ভালোবাসি'। এভাবেই চলচ্চিত্রে নতুন করে ফেরার ঘোষণাটি ওই মহরত অনুষ্ঠানের মধ্য দিয়েই আরও জমকালো উপস্থাপন করলেন বাংলা চলচ্চিত্রে নব্বইয়ের দশকের জনপ্রিয় অভিনেত্রী বিউটি কুইনখ্যাত শাবনূর।
'রঙ্গনা' সিনেমাটি পরিচালনা করছেন তরুণ নির্মাতা আরাফাত হোসাইন। সিনেমাটির প্রযোজনায় আছেন মৌসুমী আক্তার মিথিলা। এই একই প্রযোজনা প্রতিষ্ঠান এবং একই নির্মাতার পক্ষ থেকেই নির্মাণকাজ শুরু হবে শাবনূর ঘোষিত নতুন এই সিনেমাটি। যা হতে যাচ্ছে আরাফাতের ক্যারিয়ারেরও দ্বিতীয় চলচ্চিত্র।
অর্থাৎ একজন চলচ্চিত্র পরিচালক হিসেবে আরাফাত তার প্রথম দুটো চলচ্চিত্রেই নব্বইয়ের সবচেয়ে জনপ্রিয় অভিনেত্রী শাবনূরকে কাস্ট করে ঢাকাই চলচ্চিত্র ইন্ডাস্ট্রিতেই যেন তাক লাগিয়ে দিলেন। এতদিন যেখানে আরও নামকরা চিত্রপরিচালকসহ অনেকেই শাবনূরকে নতুন করে ঢাকাই চলচ্চিত্রে ফেরাতে পারছিলেন না সেখানে আরাফাত তার ক্যারিয়ারের প্রথম দুটো চলচ্চিত্রেই শাবনূরকে চুক্তিবদ্ধ করিয়ে সবাইকে বিস্মিত করিয়ে দিলেন। কিন্তু শাবনূর একজন নতুন পরিচালকের সিনেমার মধ্য দিয়ে ঢাকাই সিনেমায় এই যে নতুন করে ফেরার ঘোষণা দিলেন সেটা তিনি এমন কোনো ভরসায় এমন ঝুঁকিটি নিতে গেলেন যে, যদি ছবিগুলো একজন নতুন পরিচালক হওয়ার কারণে ব্যবসায়িকভাবে চরম মার খায় তখন তো সেটা শাবনূরের ক্যারিয়ারের জন্যও হতে পারে লজ্জাজনক।
এ কথা মনে রাখা উচিত যে, ১৯৯৩ সালে মুক্তি পাওয়া শাবনূরের প্রথম চলচ্চিত্র 'চাঁদনী রাতে' ছবিটি পরিচালনা করেছিলেন দেশের প্রখ্যাত চলচ্চিত্র নির্মাতা এহতেশাম এবং তার বিপরীতে নায়ক ছিল নবাগত সাব্বির। কিন্তু সেই প্রখ্যাত চলচ্চিত্র নির্মাতা এহতেশামের ওই ছবিটি ব্যবসায়িকভাবে চরম ব্যর্থ হয়। তখন যে ওই ছবিটি ব্যবসায়িকভাবে ব্যর্থ হলো এর পেছনে কি ছিল তখনকার নবাগত শাবনূর ও সাব্বিরের জন্য নাকি অন্য কোনো কারণে? নাকি ছবিটির গল্পটিই দর্শককে টানতে ব্যর্থ হয়েছিল সেজন্যও। নাকি বয়োজ্যেষ্ঠ হয়ে পড়া এহতেশাম সেই সময়ের দর্শকদের 'পালস' বুঝতেও ব্যর্থ হয়েছিলেন যে কারণে দর্শকের কাছে সেই সিনেমাটি জনপ্রিয় করতে পারেননি। তবে এটা ঠিক, যে এহতেশাম যদি একজন নবাগত শাবনূরকে না নিয়ে তখনকার জনপ্রিয় চম্পা বা অন্য কাউকে নিয়ে ছবিটি করলে কিছুটা দর্শক টানতে পারতো হয়ত। কিন্তু তাতেও খুব বেশি কি হতো? খুব বেশি হলেও তো বোঝা যেত সেই সিনেমাটির গল্প দর্শককে আকৃষ্ট করার মতো ছিল এবং সেরকম সম্ভাবনা থাকলেও শাবনূরের ওই প্রথম সিনেমাটি কিছুটা হলেও ব্যবসা করতে পারতো। কাজেই নবাগত হওয়ার কারণেই শাবনূরের সেই সিনেমাটি ব্যবসা করতে পারেনি এটাও বলা যাবে না। তাইতো নাঈম-শাবনাজ নবাগত হওয়া সত্ত্বেও নব্বইয়ের দশকের শুরুর দিকে এই এহতেশামেরই আরেকটি সিনেমা 'চাঁদনী' সুপারহিট ব্যবসা করেছিল সেটা তো ওই সিনেমার গল্পের কারণেই।
শাবনূর তার সেই প্রথম সিনেমাটি ব্যর্থ হওয়ার অভিজ্ঞতা থেকেই আবার যে নতুন করে ফেরার পিপাসায় পিপাসার্ত হয়ে উঠেছিলেন সেটা এই গল্পের ক্ষুধার কারণেই মূলত। চাইছিলেন এমন একটি গল্পের সিনেমা দিয়ে নতুন করে ফিরতে যে সিনেমার গল্পই তাকে সাফল্য এনে দেবে- পরিচালক নতুন নাকি প্রখ্যাত চলচ্চিত্র নির্মাতা এহতেশামের মতো প্রবীণ সেটা কোনো ফ্যাক্টর নয়। আবার ৫০ পেরিয়ে যাওয়া বর্তমান শাবনূরের বয়সও যেন কোনো ফ্যাক্টর না হয় এমন কোনো গল্প।
যেখানে শাবনূর নিজেই তিন দশক পেরনো অভিজ্ঞ অভিনেত্রী সেখানে যদি পরিচালক নবীনও হয় তাতে কোনো সমস্যা থাকার কথা নয়- যদি সেখানে শাবনূরের মতো একজন অভিজ্ঞ ও জনপ্রিয় অভিনেত্রী থাকেন এবং সেইসঙ্গে গল্পটি যদি দর্শক পছন্দের মতো হয়। তখন তিনি নিজেই পরিচালকে কোনো কোনো বিষয়ে এমন পরামর্শও দিতে পারবেন যেটা একজন নতুন পরিচালকের জন্যও সহজ হয়ে যেতে পারে।
কাজেই 'রঙ্গনা' দিয়ে চলচ্চিত্র পরিচালনায় নতুন নাম লেখানো আরাফাতের জন্যও কাজটি সহজ হয়ে যাবে শাবনূরের মতো একজন সিনিয়র অভিনেত্রীকে তার সিনেমার মুখ্য চরিত্রে পাওয়া। যিনি তার গল্পটি বুঝতে পারবেন। বুঝতে পারবেন তার চরিত্রটিও। এটা যদি একজন অভিনেতা বা অভিনেত্রী শতভাগ বুঝতে পারেন তখন পরিচালক নতুন হলেও তার কাজটি সহজ হয়ে যায়। দীর্ঘ বিরতি পেরিয়ে ফেরা প্রসঙ্গে শাবনূর বলেন, 'রঙ্গনা সিনেমার জন্যই দেশে এসেছি। এই সিনেমার গল্প ও গান আমাকে টেনে এনেছে।'
বলাই বাহুল্য, শাবনূরের এই কথাতেই পরিষ্কার হয়, তিনি এই যে ঢাকাই সিনেমায় নতুন করে ফেরার প্রস্তুতি সম্পন্ন করলেন সেটা সিনেমাটির গল্পের জন্যই। যে গল্পই তাকে নতুন করে এই 'কাম ব্যাক'কে অভিনন্দিত করতে পারে। একজন প্রখ্যাত চলচ্চিত্র নির্মাতা হওয়া সত্ত্বেও যেখানে তার জীবনের প্রথম সিনেমা 'চাঁদনী রাতে' দিয়ে নিজেও যেমন সাফল্য পাননি তেমন পরিচালককেও সাফল্য এনে দিতে পারেননি সেটা যেন তার এই 'কাম ব্যাক' সিনেমায় না হয় তার জন্য তো তিনি সিনেমার 'গল্প'কেই সুপারস্টার হিসেবে দেখতে চাইবেন সেটাই স্বাভাবিক। গল্পই তার বর্তমান বয়সকে উপেক্ষা করে যদি সুপারস্টার হয়ে উঠতে পারে তো সে সিনেমার ব্যবসাকে কে আর ঠেকাবে?
এটা কি দেশের চলচ্চিত্রে নতুন পরিচালক হিসেবে রায়হান রাফীও দেখাননি? মেজাবাউর রহমান সুমন, হিমেল আশরাফ দেখাননি? কী করে গল্পই একটি সিনেমার সুপারস্টার হয়ে উঠতে পারছে সেটা তো সাম্প্রতিক কয়েকটি ব্যবসাসফল সিনেমাতেই তার উদাহরণ হয়ে দেখা দিয়েছে।
তবে 'রঙ্গনা' সিনেমাটি নিয়ে ইতোমধ্যেই সোশ্যাল মিডিয়ায় একটা 'বিতর্ক' দেখা দিয়েছে। যে সিনেমাটি আদৌ সম্পন্ন হবে কিনা। এ নিয়ে অবশ্য শাবনূর নিজেই কথা বলেছেন। তিনি বলেছেন, 'গত ১/০৩/২০২৪ তারিখ থেকে আমি লক্ষ্য করছি, আমার অস্ট্রেলিয়া ফিরে আসাকে কেন্দ্র করে মিডিয়াতে বিভ্রান্তিকর খবর। দেখে-শুনে মনে হচ্ছে উদ্দেশ্যপ্রণোদিত ভুয়া গুজব ছড়ানো হচ্ছে আমার বিরুদ্ধে। কিছু অনলাইন ও সোশ্যাল মিডিয়া বলবার চেষ্টা করছে আমি নাকি সিনেমার ঘোষণা দিয়ে গোপনে দেশ ছেড়েছি, কবে ফিরব সেটা জানেন না কেউ, চিন্তায় পড়েছেন সিনেমাগুলোর পরিচালকরা। তারা রং-ঢং মাখিয়ে আরও কত কিছু রটাচ্ছে! আশ্চর্যের ব্যাপার, এদের দেখাদেখি মূলধারার প্রিন্ট ও ইলেকট্রনিক মিডিয়াও মনগড়া খবর প্রকাশ করে ভাইরাল হওয়ার প্রতিযোগিতায় যোগ দিয়েছে।'
শাবনূর আরও বলেন, 'আমার সঙ্গে কথা না বলেই যে যার মতো করে মনগড়া সংবাদ পরিবেশন করেই যাচ্ছে। দেশের প্রায় সবাই জানেন, আমি এবং আমাদের পরিবারের অন্য সদস্যরা স্থায়ীভাবে অস্ট্রেলিয়ায় বসবাস করি। আমার ছেলে এখানে স্কুলে পড়াশোনা করে। কোনো দরকার হলে বা লং হলিডেতে দেশে ঘুরতে আসি, আবার যখন প্রয়োজন হয় অস্ট্রেলিয়ায় ফিরে যাই। তাই আমাকে কি ঢাকঢোল পিটিয়ে বলতে হবে কখন দেশে আসব বা কখন দেশ ছাড়ব? এখানে গোপনে দেশ ত্যাগের কি আছে? আমি প্রায় তিন সপ্তাহ আগেই অস্ট্রেলিয়ায় চলে এসেছি। কিন্তু এতদিন পর মনে হয় কারো কারো ঘুম ভাঙল! আরও একটি কথা, যে ছবির মহরত হয়েছে সেটার শুটিং সময়মতোই হবে। আমার অস্ট্রেলিয়ায় ফিরে আসার কারণ ও সময় নেওয়ার বিষয়ে সিনেমার সঙ্গে সংশ্লিষ্টরা অবগত আছেন। আমি সবাইকে বিনীত অনুরোধ করব, আপনারা কোনো গুজবে, বা ভুয়া খবরে বিভ্রান্ত হবেন না। কোনো গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হলে বা অন্য কোনো সিনেমার আপডেট থাকলে আমিই আপনাদের সময় মতো জানাব।'
শাবনূরের এই কথাতেই পরিষ্কার হয়, সিনেমায় তার নতুন করে ফেরার পিপাসা তার মিটে যায়নি। তিনি অবশ্যই একটা উজ্জ্বল 'কাম ব্যাক' করতে চান। তবে ভয় হয় এখানেই, ঢাকাই সিনেমার ইতিহাসে এমন বহু সিনেমা আছে যেগুলোর প্রি-প্রোডাকশন থেকে শুরু করে মহরতও হয়েছে। কিন্তু সেই সিনেমা শেষ পর্যন্ত শুটিং স্পটেই গড়ায়নি। যেমন ঢাকাই সিনেমার আরেক 'বিউটি কুইন'খ্যাত শাবানার 'বেগম রোকেয়া' নামে একটি সিনেমায় নাম চরিত্রে অভিনয় করার কথা ছিল। সুভাষ দত্ত'র পরিচালনায় সেই সিনেমাটির মহরতও হয়েছিল। পরে সেই সিনেমাটি আর শুটিংস্পটেই গড়ায়নি।