ম্যাচ শেষের ভেপু্য বেজে উঠল। সঙ্গে সঙ্গে টার্ফে স্টিক উঁচিয়ে আনন্দ উলস্নাসে মেতে উঠেন বাংলাদেশের যুবারা। লাল সবুজের পতাকা নিয়ে ল্যাপ অব অনার ওমান স্টেডিয়ামের টার্ফ জুড়ে। বড়রা যা করতে পারেনি, তাই করে দেখালে যুবারা। প্রথমবারের মতো যুব হকির বিশ্বকাপে নাম লেখালো বাংলাদেশ।
বাংলাদেশের অন্যতম সম্ভাবনাময় খেলা হকি। বিশ্বকাপ পর্যায়ে খেলার সামর্থ্য বাংলাদেশ হকির রয়েছে। সামর্থ্য থাকলেও পরিকল্পনা-সাধ্য ও বাস্তবায়ন নানা বিষয় মিলিয়ে এতদিন স্বপ্নই ছিল। গতকাল মঙ্গলবার ওমানের মাসকাটে বাংলাদেশ অনূর্ধ্ব-২১ থাইল্যান্ডকে হারিয়ে প্রথমবারের মতো যুব হকি বিশ্বকাপ খেলা নিশ্চিত করেছে।
মঙ্গলবার ওমানে অনুষ্ঠিত পঞ্চম থেকে অষ্টম স্থান নির্ধারণী ম্যাচে থাইল্যান্ডকে ৭-২ গোলে বিধ্বস্ত করে এই কৃতিত্ব গড়ে বাংলাদেশ। জুনিয়র এশিয়া কাপ থেকে ছয়টি দল যাবে যুব বিশ্বকাপে। বাংলাদেশ থাইল্যান্ডকে হারিয়ে ষষ্ঠস্থান অর্জন করেছে। এখন পঞ্চম স্থানের জন্য তাদের লড়তে হবে চীন ও দক্ষিণ কোরিয়া ম্যাচে জয়ী দলের সঙ্গে। আগামী বছর ভারতে অনুষ্ঠিতব্য যুব বিশ্বকাপে এশিয়া থেকে সাত দলটি অংশ নেবে। স্বাগতিক ভারত সরাসরি খেলবে। বাকি ছয়টি দেশ চলমান জুনিয়র এশিয়া কাপ থেকে খেলার সুযোগ পাচ্ছে।
চীনের সঙ্গে ড্র করার পর বিশ্বকাপের সুবাস পাচ্ছিলো বাংলাদেশ। অপেক্ষাকৃত দুর্বল থাইল্যান্ডকে হারাতে পারলেই মিলবে জুনিয়র হকির বিশ্বকাপের টিকিট। স্থান নির্ধারণী ম্যাচে বাংলাদেশ কোনো ভুল করেনি। ওমানের মাস্কটে ম্যাচে বাংলাদেশের দাপট ছিল দেখার মতো। বিল্ডআপ খেলে একের পর এক গোল করেছেন হাসান, জয়রা। ম্যাচ বড় ব্যবধানে জিততে তাদের সেভাবে কোনো বেগই পেতে হয়নি। সিনিয়র, যুব দল কোনো পর্যায়ে থাইল্যান্ডের বিপক্ষে হারের রেকর্ড নেই বাংলাদেশের। জিতলেই বিশ্বকাপ এমন পরিস্থিতিতে বাড়তি চাপ ও অতিরিক্ত আত্মবিশ্বাস নিয়েই নেমেছিলেন বাংলাদেশের খেলোয়াড়রা। মাঠে বেশ স্বাভাবিক খেলা খেলেই কাঙ্ক্ষিত জয় এনেছেন মওদুদুর রহমানের শিষ্যরা। বাংলাদেশের হয়ে মোহাম্মদ জয় ও মোহাম্মদ আবদুলস্নাহ দুটি করে এবং আমিরুল ইসলাম, মোহাম্মদ হাসান ও মোহাম্মদ খান একটি করে গোল করেন। থাইল্যান্ডের হয়ে দুই গোল শোধ দেন চুয়েমকে কৃষ্টানা ও ফুমি কৃষ্টানা।
ওমানে বাংলাদেশ অ-২১ দলে ম্যানেজার হিসেবে আছেন ফেডারেশনের অ্যাডহক কমিটির সদস্য ও সাবেক কোচ কাওসার আলী। বাংলাদেশ হকির কিংবদন্তি ব্যক্তিত্ব ওমান থেকে বেশ উচ্ছ্বসিত কণ্ঠে বলেন, 'জীবনের প্রায় সায়াহ্নে এসে দারুণ এক মুহূর্তের সাক্ষী হলাম। বাংলাদেশ হকিতে বিশ্বকাপ খেলবে এটা এখন আর স্বপ্ন নয়, বাস্তব। আমাদের ছেলেরা এটা প্রমাণ করেছে তারা খেলতে পারে। এটা সম্ভব হয়েছে ছেলেদের পারফরম্যান্স, ফেডারেশনের পরিকল্পনা ও কোচিং স্টাফদের পরিশ্রমের কারণেই।'
অ-২১ হকি দলের সঙ্গে কয়েক মাস আগেই হেড কোচের দায়িত্বে ছিলেন সাবেক জাতীয় খেলোয়াড় মোহাম্মদ আশিকুজ্জামান। সিঙ্গাপুরে এএইচএফ কাপ চ্যাম্পিয়ন হয়ে জুনিয়র এশিয়া কাপে খেলার যোগ্যতা অর্জন করেছে বাংলাদেশ। তাই খেলোয়াড়দের খুব কাছ থেকে দেখা আশিকের পর্যবেক্ষণ, 'ছেলেরা অনেক কষ্ট করেছে দেশের জন্য। অনেক প্রতিবন্ধকতার মধ্যেও তারা দেশের জয়ের জন্য নিজেদের উজাড় করেছে।'
২০১৭ সালে যুব অলিম্পিকে বাংলাদেশ ফাইভ এ সাইড হকিতে খেলেছিল। ১৯৭৭ সাল থেকে যুব হকি খেলা বাংলাদেশের কখনোই বিশ্বকাপ খেলা হয়নি। ফেডারেশনের অ্যাডহক কমিটির সদস্য ও বাংলাদেশের হয়ে প্রথম যুব বিশ্বকাপ বাছাই খেলা দলের অধিনায়ক হোসেন ইমাম চৌধুরী শান্টা বলেন, '১৯৭৭ সালে মালয়েশিয়ায় আমরা এশিয়ার ১২ দলের মধ্যে পঞ্চম হয়েছিলাম। চতুর্থ হলে পরের বছর প্যারিসে যুব বিশ্বকাপ খেলতে পারতাম। আমরা না পারলেও চার যুগ পর বাংলাদেশ যুব বিশ্বকাপ খেলছে, এটা দেখতে পারছি এটাই বড় প্রাপ্তি।'
আশি-নব্বই দশকে বাংলাদেশের কয়েকজন খেলোয়াড় ছিলেন এশিয়ান মানের। জুম্মন লুসাই, রফিকুল ইসলাম কামাল, মামুনুর রশীদদের সময়ে বাংলাদেশ যুব বিশ্বকাপ খেলতে পারেনি। এর কারণ সম্পর্কে কামাল বলেন, 'আমরা ১৯৯৬ সালে খুব ভালো দল ছিলাম। যুব এশিয়া কাপের সেমিফাইনাল হেরে বিশ্বকাপ মিস করি। সেই সময় বিশ্বকাপে এশিয়ার কোটা কম ছিল, আবার প্রতিদ্বন্দ্বিতাও ছিল একটু বেশি।'
আগে যুব বিশ্বকাপে ১৬ দল অংশগ্রহণ করত। হকির বিশ্বায়নের জন্য আন্তর্জাতিক হকি ফেডারেশন সেই সংখ্যা বৃদ্ধি করে ২৪ এ উন্নীত করেছে। এতে কোটা বেড়েছে এশিয়ারও। ফলে জুনিয়র এশিয়া কাপে ছয়ের মধ্যে থাকলেই বিশ্বকাপ খেলার সুযোগ মিলছে। বাংলাদেশ হকিতে জুনিয়র এশিয়া কাপে ষষ্ঠ স্থানেই থাকে অধিকাংশ সময়। ফলে এবার বিশ্বকাপ খেলা অনেকটাই অনুমেয় ছিল।
নব্বই দশকের মাঝামাঝি পর্যন্ত বাংলাদেশে ফুটবলের পরই জনপ্রিয় খেলা ছিল হকি। হালের সবচেয়ে জনপ্রিয় ক্রিকেটের অবস্থান ছিল তৃতীয়। কালের বিবর্তনে হকি এখন বেশ পিছিয়ে।