শ্রদ্ধা ও ভালোবাসায় ফুটবলার জাকারিয়া পিন্টুর শেষ বিদায়

প্রকাশ | ২০ নভেম্বর ২০২৪, ০০:০০

ক্রীড়া প্রতিবেদক
ঢাকা মোহামেডান স্পোর্টিং ক্লাবে মঙ্গলবার জাকারিয়া পিন্টুর মরদেহে শ্রদ্ধা নিবেদন করেন ক্রীড়াঙ্গনের বিশিষ্ট ব্যক্তিরা -সংগৃহীত
বাংলাদেশের ফুটবলে জাকারিয়া পিন্টু এক কালজয়ী নাম। 'স্বাধীন বাংলা ফুটবল দল' বাংলার ইতিহাসের অন্যতম শক্তিশালী এক সংগঠনের বেড়ে ওঠা যুদ্ধের হিংস্রতার মাঝে। জাকারিয়া পিন্টুর নেতৃত্বে ১৩টি ম্যাচ খেলেছিল সেই দল। সারা দেশ ঘুরে উজ্জীবিত করেছিল বাংলার মানুষকে। সেই পিন্টু গত সোমবার চলে গেলেন না ফেরার দেশে। যাকে হারিয়ে শোকে আচ্ছন্ন দেশের ফুটবলসহ গোটা ক্রীড়াঙ্গন। দেশের ফুটবলে জাকারিয়া পিন্টুর অবদান অবিস্মরণীয়। ফুটবল ছাড়ার পর ক্রীড়া সংগঠক হওয়া পিন্টু জড়িত ছিলেন মোহামেডান ক্লাবের সঙ্গে। চেয়ারম্যান ছিলেন সেভ দ্য স্পোর্টসের। তাঁকে শেষবার দেখতে ক্রীড়াঙ্গনের মানুষরা ভিড় করেন মতিঝিলের ফুটবল পাড়ায়। ঢাকা জেলা প্রশাসন বীর মুক্তিযোদ্ধা ও স্বাধীন বাংলা ফুটবল দলের অধিনায়ক জাকারিয়া পিন্টুকে রাষ্ট্রীয় গার্ড অফ অনার প্রদান করে শেষবারের মতো চিরচেনা দুই স্থান মোহামেডান ক্লাব প্রাঙ্গণ ও বাফুফেতে গেলেন জাকারিয়া পিন্টু। ৮১ বছর বয়সে না ফেরার দেশে পাড়ি জমিয়েছেন স্বাধীন বাংলা ফুটবল দলের অধিনায়ক। তার প্রাণহীন দেহ যখন মতিঝিল পাড়ায় পৌঁছল, চারিদিকে তখন শোকাবহ পরিবেশ। ১৯৬১ সাল থেকে ১৯৭৫ সাল পর্যন্ত টানা মোহামেডান স্পোর্টিং ক্লাবে খেলেছেন। সেখানে নেয়া হয় তার মরদেহ। মঙ্গলবার সকাল ১০টায় মোহামেডান স্পোর্টিং ক্লাব প্রাঙ্গণে তার নামাজে জানাজা অনুষ্ঠিত হয়। ঢাকা জেলা প্রশাসন এই বীর মুক্তিযোদ্ধাকে প্রদান করে রাষ্ট্রীয় গার্ড অফ অনার। ক্রীড়াঙ্গনের সর্বস্তরের ব্যক্তিবর্গ এ সময় তাকে শেষবার দেখতে হাজির হন। সতীর্থ থেকে শুরু করে ক্রীড়াঙ্গনে তার দীর্ঘদিনের চলার সাথীরা তাকে শেষ ভালোবাসা ও বিদায় জানানোর সময় আবেগপ্রবণ হয়ে পড়েন। এরপর বেলা ১১টায় বাফুফে ভবনে পিন্টুর আরও একটি জানাজা অনুষ্ঠিত হয়। বাদ জোহর জাতীয় প্রেস ক্লাবে পিন্টুর দিনের তৃতীয় ও শেষ জানাজা অনুষ্ঠিত হয়। বাদ আসর মিরপুর শহীদ বুদ্ধিজীবী কবরস্থানে তাকে দাফন করা হয়। জাকারিয়া পিন্টুর সঙ্গে মাঠে যারা খেলেছেন, তাদের অনেকেই উপস্থিত ছিলেন। জাকারিয়া পিন্টুর স্মৃতিচারণ করলেন তারা। গোলাম সারোয়ার টিপু যেমন বলেন, 'পিন্টু ভাই খুব শৃঙ্খলাপরায়ন ফুটবলার ছিলেন। নিজেকে সব সময় ফিট রাখতেন। খেলোয়াড়ি জীবনে বলতে গেলে চোটে পড়েনইনি। তিনি বাংলাদেশের ক্রীড়া জগতের সত্যিকারের কিংবদন্তি। তিনি সৌভাগ্যবান, এ দেশের জন্মের ইতিহাসের সঙ্গে নিজেকে জড়িয়ে রেখেছেন।' স্বাধীন বাংলা ফুটবল দলে জাকারিয়া পিন্টুর অধিনায়কত্বে খেলেছে আশরাফ আলী, খেলেছেন মোহামেডানেও। স্বাধীনতার পর অবশ্য আবাহনীর জার্সিতে জাকারিয়া পিন্টুর প্রতিপক্ষ হয়েছেন। তার কথা, 'আপাদমস্তক একজন ভদ্রলোক পিন্টু ভাই। মাঠে কোনো দিন তার মুখ থেকে কোনো কটূ কথা শুনিনি। কাউকে বকা দিয়েছেন, সেটাও দেখিনি। সিনিয়র হিসেবে ছিলেন খুবই স্নেহশীল।' জাতীয় ক্রিকেট দলের সাবেক অধিনায়ক রকিবুল হাসানের কাছে পিন্টু যেন বাংলাদেশের ক্রীড়াজগতের সমার্থক, 'জাকারিয়া পিন্টু বাংলাদেশের ক্রীড়াজগতের অনেক বড় নাম। স্বাধীনতার আগে জাকারিয়া পিন্টু মানেই আমাদের ক্রীড়াজগৎ। তিনি স্বাধীন বাংলা ফুটবল দলের অধিনায়ক হিসেবেই অমর হয়ে থাকবেন চিরদিন, এ দেশের ইতিহাসে।' মোহামেডান ক্লাবে তার জানাজায় উপস্থিত ছিলেন মোহামেডানের সাবেক অধিনায়ক মেজর (অব.) হাফিজউদ্দিন। পাকিস্তান জাতীয় দলে এক সঙ্গে খেলেছেন, মোহামেডান ক্লাবেও ছিলেন সতীর্থ। তিনি স্মৃতিচারণ করে বলেন, 'জাকারিয়া পিন্টু এ দেশের ফুটবল ইতিহাসের অন্যতম সেরা একজন খেলোয়াড়। তার সঙ্গে অনেক স্মৃতি। পাকিস্তান জাতীয় দলের সতীর্থ ছিলাম আমরা, মোহামেডানে তো ছিলামই। তার সঙ্গে ইরান ও তুরস্কে খেলতে যাওয়ার স্মৃতি কখনো ভুলব না। তাকে আজ বিদায় জানাতে এসেছি, আমরা সবাই আজ বিষাদগ্রস্ত।' ক্লাব প্রাঙ্গণে একপাশে চুপচাপ দাঁড়িয়ে ছিলেন জাকারিয়া পিন্টুর দীর্ঘদিনের বন্ধু, স্বাধীন বাংলা ফুটবল দলের সহঅধিনায়ক প্রতাপ শংকর হাজরা। ইমতিয়াজ সুলতান জনি তার হাত ধরে নিয়ে আসেন বন্ধুর মরদেহের সামনে। প্রতাপ শংকর হাজরার হাতে তুলে দেন একটি ফুলের তোড়া। বন্ধুর মরদেহে সেটি রাখার সময় স্বাভাবিকভাবেই আবেগাপস্নুত ছিলেন প্রতাপ শংকর হাজরা। বন্ধু সম্পর্কে বললেন, 'আমার অনুভূতিগুলো সব ভোঁতা হয়ে গেছে। কাকে হারালাম আমিই বুঝি। আমার প্রিয় বন্ধু, প্রিয় সতীর্থ। কত শত স্মৃতি। খুব শিগগির পিন্টুর সঙ্গে দেখা হবে ওপারে।' আবেগাপস্নুত হাসানুজ্জামান বাবলুও, 'স্বাধীন বাংলা ফুটবল দলের সঙ্গে ঘুরেছি, মুক্তিযুদ্ধের সময়। পিন্টু ভাই আমার বড় ভাই, খুব আদর করতেন। খেলোয়াড় হিসেবে তিনি কত বড় ছিলেন, সেটা শুধু তার খেলা যারা দেখেছেন, তারাই বলতে পারবেন।' মোহামেডান ক্লাবে নামাজে জানাজার আগে ক্লাবের পক্ষ থেকে তার মরদেহে ফুলেল শুভেচ্ছা জানান মোহামেডান ক্লাবের সভাপতি লেফটেন্যান্ট জেনারেল (অব.) আবদুল মুবীন, মোহামেডানের ফুটবল কমিটির প্রধান গোলাম মোহাম্মদ আলমগীর ও ক্লাবের আজীবন সদস্য মোসাদ্দেক আলী। আজীবন মোহামেডানের সঙ্গে থাকা জাকারিয়া পিন্টুর স্মরণে ক্লাবের উদ্যোগ সম্পর্ক দুই পরিচালক মাহবুব আনাম ও গোলাম মোহাম্মদ আলমগীর বলেন, 'আমরা সামনে একটি স্মরণ/শোকসভা করব। সেখানে অনেক প্রস্তাবনা উঠে আসতে পারে। সেই ভিত্তিতে ক্লাবের পরিচালনা পর্ষদ পিন্টু ভাইয়ের স্মরণে আনুষ্ঠানিক পদক্ষেপ গ্রহণ করবো।'