মঙ্গলবার, ০৫ নভেম্বর ২০২৪, ২০ কার্তিক ১৪৩১

পরিকল্পনা বাস্তবায়ন করতে না পারার হতাশা

ক্রীড়া প্রতিবেদক
  ১৪ অক্টোবর ২০২৪, ০০:০০
পরিকল্পনা বাস্তবায়ন করতে না পারার হতাশা

ভারতের বিপক্ষে তিন ম্যাচের টি২০ সিরিজে বাংলাদেশের প্রাপ্তির চেয়ে অপ্রাপ্তিই বেশি। ব্যাটিং, বোলিং, ফিল্ডিং; কোনো বিভাগেই আশানুরূপ কিছু করতে পারেনি নাজমুল হোসেন শান্তর দল। ভারতের দস্যিপনার বিপরীতে টাইগাররা ঠিক টাইগার হয়ে উঠতে পারেনি।

প্রথম ম্যাচে ৭ উইকেটের হার, দ্বিতীয়টিতে ৮৬ রানে। শেষ ম্যাচে টাইগাররা হেরেছে ১৩৩ রানের বিশাল ব্যবধানে। হোয়াইটওয়াশ হওয়ার এই সিরিজে অনেকগুলো লজ্জার রেকর্ড যুক্ত হয়েছে বাংলাদেশের

নামের পাশে।

পূর্ণ সদস্যরাষ্ট্র হিসেবে আন্তর্জাতিক টি২০'র এক ইনিংসে সর্বোচ্চ রান, সবচেয়ে বেশি বাউন্ডারি, সবচেয়ে বেশি ওভারে ১০+ রান হজমের লজ্জা এখন বাংলাদেশের। তৃতীয় টি২০তে ২৯৭ রান হজম করা বাংলাদেশ একটুর জন্য ছুঁতে পারেনি মঙ্গোলিয়াকে। গত বছর হাংঝুতে মঙ্গোলিয়ার বিপক্ষে ৩১৪ রান করেছিল নেপাল। মঙ্গোলিয়ার লজ্জার রেকর্ড অক্ষত থাকলেও বাংলাদেশ ৪৭টি বাউন্ডারি হজম করে মুক্তি দিয়েছে তুরস্ককে, ২০১৯ সালে তাদের বিপক্ষে ৪৩টি বাউন্ডারি মেরেছিল চেক প্রজাতন্ত্র। তৃতীয় ম্যাচে ১৮টি ওভারে ১০ বা তার বেশি রান দিয়েছে বাংলাদেশ।

সিরিজের সবকটি ম্যাচেই ছাইপাশ পারফরম্যান্স বাংলাদেশের। স্বভাবতই শান্তর কণ্ঠে হতাশা। নিজেদের ভুলের কথা ছাড়া আর কিছু বলতে পারেননি তিনি। দলপতি বলেন, 'আমরা আমাদের সেরা ক্রিকেট খেলিনি। ব্যাটিং ইউনিট হিসেবে আমরা পরিকল্পনা বাস্তবায়ন করিনি। কয়েক ওভার আমরা কিছু ম্যাচে ভালো বল করেছি কিন্তু আজ ভালো বল হয়নি। ঘরের মাঠে আমাদের উইকেটে পরিবর্তন আনতে হবে। আমাদের নিজেদের ওপর বিশ্বাস রাখতে হবে যে আমরা যে কোনো দলের বিপক্ষে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করতে পারি। আর উন্নতির জন্য খেলোয়াড়দেরই দায়িত্ব নিতে হবে।'

বাংলাদেশের হতশ্রী ফর্মের দিনে দেড়শ স্ট্রাইক রেটে ৬৩ রান করেছেন তাওহিদ হৃদয়। তার প্রশংসা করেছেন শান্ত। তিনি বলেন, 'হৃদয়

যেভাবে ব্যাট করেছে, সেটা দেখার মতো। পেসারদের ভালো লেগেছে। তারা চেষ্টা

করেছে পরিকল্পনা ফলাতে।'

কখনো পাওয়ার হিটিং, কখনো ইন্টেন্ট, কখনোবা আবার অ্যাপ্রোচ। বিগত সময়ে বাংলাদেশের টি২০ ব্যাটিংয়ে উন্নতির আলাপে এসবই আওয়াজ উঠেছে। এখন নিজেদের ঘাটতির পেছনে ঘরের মাঠের উইকেটের কারণ সামনে আনছেন ক্রিকেটাররা।

সদ্যসমাপ্ত ভারতের বিপক্ষে সিরিজের প্রথম ম্যাচের পর নাজমুল হোসেন শান্ত। দ্বিতীয় ম্যাচের পর তাসকিন আহমেদ। তৃতীয় ম্যাচের পর তাওহিদ হৃদয়। ঘুরে-ফিরে তিনজনই সংবাদ সম্মেলনে বলেছেন- ঘরের মাঠের পিচ ভালো করা প্রয়োজন। তিন ম্যাচের টি২০ সিরিজজুড়ে বাংলাদেশ দলের সদস্যদের মুখে পিচের প্রসঙ্গ যেভাবে এসেছে, কেউ ভেবে বসতেই পারেন, টাইগারদের লড়াইবিহীন একপেশে তিনটি হারের পেছনে সব দোষ বুঝি এদেশের ২২ গজের!

বাংলাদেশিরা ঘরের মাঠে নিয়মিত ভালো ব্যাটিং পিচে খেলেন না ঠিক। সেই অভ্যাস না থাকায় বিদেশে ফ্ল্যাট পিচে খেলতে গেলেও বড় স্কোর করতে পারেন না তারা। প্রথম ম্যাচের পর বলা অধিনায়ক শান্তর এই কথা অস্বীকারের সুযোগ নেই। কিন্তু এদেশে বিদেশি ব্যাটারদের পারফরম্যান্স আবার শুধু উইকেটের দিকে আঙুল তুলতেও

দিচ্ছে না।

বাংলাদেশের মাটিতে গত তিন বছরে যা আন্তর্জাতিক ক্রিকেট ও বাংলাদেশ প্রিমিয়ার লিগের খেলা হয়েছে, এতে বিদেশি ১৮ জন ব্যাটার ১৩৫ এর বেশি স্ট্রাইক রেটে কমপক্ষে ২০০ রান করতে পেরেছেন। আর দেশি এমন ব্যাটার পাওয়া গেছে মাত্র তিনজন! সাকিব আল হাসান (১৫১.৬৭), তাওহিদ হৃদয় (১৩৬.৯৮) এবং জাতীয় দলের যোজন যোজন দূরে থাকা জিয়াউর রহমান (১৩৭.২৬)। তাহলে দেখা যাচ্ছে, একই ধরনের উইকেটে খেলে বিদেশিরা ঠিকই মানানসই স্ট্রাইক রেটে রান তুলতে পারছেন।

টি২০তে বাংলাদেশি ক্রিকেটারদের গড়ে ওঠা ও উঠে আসার মঞ্চ বিপিএলে তাকানো যাক। এদেশের সর্বোচ্চ পর্যায়ের ঘরোয়া টি২০ টুর্নামেন্টের পিচের দুর্নাম বহুদিনের। মোটাদাগে ব্যাটিংয়ের জন্য অত্যন্ত চ্যালেঞ্জিং উইকেটই যে থাকে এতে কোনো সন্দেহ নেই। তবে দেশিদের জন্যই যেন দুর্বোধ্য হয়ে ওঠে নিজেদের উইকেট!

বিপিএলের ইতিহাসে বাইরের ক্রিকেটাররা মানসম্মত স্ট্রাইক রেটেই ব্যাট করেছেন। ২০১২ সাল থেকে শুরু হওয়া আসরটিতে যেসব ব্যাটার অন্তত ২০০ রান করেছেন, তাদের হিসাবের মধ্যে অন্তর্ভুক্ত করে দেখা যাচ্ছে- বিদেশিদের স্ট্রাইক রেট যেখানে ১৩৪.০৯, দেশি ব্যাটারদের ক্ষেত্রে সেটি ১১৯.৫৪।

যত নষ্টের গোড়া দেশের পিচ, এই কথার জোর তাহলে থাকে আর কতটুকু? মাঝেমধ্যে অজুহাতের দ্বারস্থ না হয়ে ব্যর্থতা স্বীকার করে নেওয়াটাই সমীচীন হয়। জনপ্রিয় ধারাভাষ্যকার ও সাবেক ক্যারিবিয়ান ক্রিকেটার ইয়ান বিশপ তো বলেন, সাফল্যের অংশই হচ্ছে ব্যর্থতা।

অবশ্য দেশের উইকেটের সঙ্গে নিজেদের দক্ষতায় উন্নতির কথাও যোগ করেছেন শান্ত-হৃদয়রা। এদেশের ক্রিকেটাররা যেমন ছক্কা মারায় বেশ পিছিয়ে। নিম্ন স্ট্রাইক রেটের পেছনে তা অন্যতম কারণ। বিপিএলে দেশি ব্যাটারদের একটি ছয় মারতে লেগেছে প্রায় ২৩ বল। আর বিদেশিরা প্রতি ছয় মেরেছেন প্রায় ১৫ বলে।

ভিনদেশি ক্রিকেটাররা একটা পর্যায়ে উঠেই না তবে ফ্র্যাঞ্চাইজি লিগে ডাক পান। বিপিএল সেখানে দেশি ক্রিকেটারদের জন্য গড়ে ওঠার মঞ্চ। বড় রানের অভ্যাস গড়ে তোলা প্রয়োজন। ভালো উইকেটের তাই বিকল্প নেই। কিন্তু কেবল ভালো উইকেটই যে সমাধান নয়, সেটি নিশ্চয়ই মনে রাখছেন শান্তরা।

উদাহরণ হিসেবে চোখের সামনেই তো রয়েছে পাকিস্তান। দেশটিতে বিশ্বের মধ্যে অন্যতম সব ব্যাটিং সহায়ক উইকেটেই খেলা হয়। তবুও টি২০ সংস্করণে পাকিস্তানের অবস্থান কোথায়, সেটি অজানা থাকার কথা নয় বাংলাদেশিদের।

  • সর্বশেষ
  • জনপ্রিয়

উপরে